এবার শুধু বৃষ্টি নয়, মহামায়ার পুজোয় এবছর মহামারীর ভ্রকুটি। বৃহস্পতিবার করােনাবিধির বাঁধনে সারা হল মহাষষ্ঠীর বােধন। প্রতিবছর এই দিনটায় মণ্ডপে মণ্ডপে উপচে পড়ে ভিড়। রাত যত বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে ফুটফলের সূচক। এবছর সেখানে বাড়ছে সংক্রামিতের সংখ্যা। ঘেষাঘেষি ভিড় সামলাতে যে সব প্যান্ডেলে স্বেচ্ছাসেবক আর পুলিশের হিমশিম অবস্থা হয়, দূরত্ববিধির ঠেলায় সেখানে হাতে গােণা লােক।
আলাের রােশনাইতে ভেসে যাওয়া শহর টিমটিমে আলোয় ম্লান। জনপ্লাবনের শারদ শহরে আজ যেন কীসের সংকেতে প্রায় জনহীন। যে রাজপথে যানবাহণের গতিরােধ করে ভিড়, সেখানে এখন বাধাহীনভাবে ছুটে চলছে যান। দেড় ঘন্টার রাস্তা পেরনাে যাচ্ছে এক ঘন্টায়। অবশ্য আগের মতােই রাস্তা খুঁড়ে কাঠের খোটা পোঁতা হয়েছে। গার্ড রেলের বেড়া, দড়ির লক্ষণরেখা টানা হয়েছে। কিন্তু সেসব যেন টপকানাের লােক নেই। মাইক্রোফোনে গান বাজছে বটে, কিন্তু তাতে যেন প্রাণ নেই।
বৃহস্পতিবার সকালে বেজেছে বােধনের ঢাক। তা- ও হয়তাে বাজত না শেষমেশ আদালত ঢাকিদের মণ্ডপে ঢােকার ছাড়পত্র না দিলে। কিন্তু সেই ঢাকের ঢ্যাম কুড়াকুড় বাদ্যিতে যেন তাল কাটছে। ভিড়হীন বারােয়ারিতলায় দুর্গাপ্রতিমা কেমন যেন নিঃসঙ্গ। মাস্কপরা পুরােহিতের মন্ত্রোচ্চারণ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে। কাটা ফলে উড়ে বেড়ানাে মাছি তাড়ানাের লােক নেই। গঙ্গাজলের পাশে রাখা রয়েছে স্যানিটাইজারের মস্ত জ্যারিকেন।
শহর কলকাতার সমস্ত শব্দ, সব কলরােল কে যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে। উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতার সব পুজো মণ্ডপ দর্শকশূণ্য। বাঁশের বেড়ার অনেক দূর থেকে মা দুর্গাকে অল্পক্ষণের জন্য দেখেই সরে যাচ্ছেন দর্শকরা। উত্তর কলকাতার বাগবাজার সর্বজনীন পুজোতে বিরাট মেলা নেই। ম্যাডক্স স্কোয়ারের আড্ডা নেই। নলিন সরকার স্ট্রিট, লেবুতলা পার্কে, হাতিবাগানে, উল্টোডাঙায় সেই ভিড়ের ঢল নেই। একডালিয়া, সুরুচি সংঘ, নাকতলা উদয়ন, বাবুবাগান, বােসপুকুরের পুজো প্যান্ডেলে এঁকেবেঁকে যাওয়া দর্শনার্থীর লাইন নেই। এই করােনার গাইডলাইনে সব যেন থমকে গিয়েছে। কোথায় হারিয়ে গিয়েছে পুজোর রাস্তার সেই রঙিন বেলুনওয়ালা। ফুচকার হাড়ির পাশে সেই ঠেলাঠেলি ভিড় আর নেই। পুজোয় রাস্তায় মােড়ে মােড়ে বসা রােল, চাউমিনের বেশিরভাগ কাউন্টারের ঝাপ বন্ধ। এই শহরের স্পন্দনটাই যেন নিভে গিয়েছে। মহামারীর বিধির বাঁধনে বন্দি হয়েছে মানুষ। গােটা শহরে বাে ধনের দিনেই যেন বিসর্জনের আবহ।