চলে গেলেন নব্বইয়ের দশকের কবি মানসকুমার চিনি। কলকাতার এক নার্সিংহোমে ১৭ অগাস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মানস। দীর্ঘদিন নার্ভের অসুস্থতায় ভুগছিলেন। কর্মজীবনে ছিলেন পূর্বরেলের একজন করণিক। সারাটা জীবন কাটিয়েছেন সাহিত্যকে ভালোবেসে, কবিতাকে ভালোবেসে। কবিতার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে মানস ছিলেন এক গৃহী-সন্ন্যাসী। শেষের দিকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাএকা নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতেন সল্টলেকে। হয়তো অনিচ্ছায়, বাধ্য হয়ে। কোথায় তার যন্ত্রণা কাউকে জানতে দেয়নি সে।
কিন্তু এটা জানতাম মফসসলের ছেলে, মেদিনীপুরের ছেলে মানসের প্রিয় বাসভূমি ছিল খড়গপুর। খড়গপুরের রেল কলোনির ছোট্ট ঘরে মানস গড়ে তুলেছিলেন অসংখ্য পত্র-পত্রিকার সংগ্রহশালা। লিটল ম্যাগাজিনের লেখক মানস তৈরি করেছিলেন লিটল ম্যাগাজিনের সংগ্রহ। সব ধরনের পত্র-পত্রিকা সে নিজের হাতের কাছে রাখতে চেয়েছিল ভালোবেসে। এই সব মিলিয়ে নিজের ছোট্ট সংসার নিয়ে একটি সুখের নীড় বাঁধতে চেয়েছিলেন মানস। কিন্তু কোথায় যেন তার এক উৎপীড়ক যন্ত্রণা শেষ পর্যন্ত তাকে একা করে দেয়। নাকি নিজেই সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে বিপন্ন বিস্ময়ে একাকীর জীবন বেছে নিয়েছিলেন মানস!
মানসের সঙ্গে আমার দেখা হত মাঝে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে। কখনও হলদিয়া উৎসবে, কখনও ‘কবিতাপাক্ষিক’-এর অনুষ্ঠানে। কবিমাত্রেই সবাই ছিল তার আপন। সবার সঙ্গেই তার আন্তরিক সম্পর্ক। বোধহয় সে জর্দা খেত। মুখ থাকতো তার লাল। কথা যখন বলত, একসঙ্গে অনেক খবর সে পেতে চায়। অনেক খবর সে জানাতে চায়। হাসি মুখের লালা তার গড়িয়ে পড়ত।
বলাবাহুল্য, সেসব খবর শুধু কবিতার। নতুন বই প্রকাশের, নতুন কবিতা ছাপার। নিজের বই সে নিজেই প্রকাশ করত। ফলে এক ফর্মা কবিতার বই ছিল তার এক স্বপ্নের উড়ান। দেখা হলেই নতুন বই ব্যাগ থেকে বের করে বড় বড় অক্ষরে উপহার এঁকে দিত। কবিতার কথায় সে ছিল অক্লান্ত। খানিকটা বিশৃঙ্খল। খানিকটা বেসামাল, আনমনা। অসংখ্য কবিতাগ্রন্থের প্রণেতা সে। ‘আয়ু’ নামের একটি কবিতায় মানস লিখেছিলেন, ‘জল পতনের শব্দ হয়/ মধ্যরাতে মানুষের আয়ু নিভে যায়/ শ্যাওলা জমা রাস্তায় এসেছ কেন ?/ এ কথা ভাবার পর ঘরে টিম-টিম আলো জ্বলে’…
টিমটিম আলো পেরিয়ে, স্বপ্নের ভোর পেরিয়ে একদিন সাত সকালে মানস চলে গেল, আমাদের নব্বইয়ের দশককে বিবশ করে দিয়ে। সে রেখে গেল অন্তত ৪১টি ষোলো পাতা, পাতলা মলাট কবিতার আগুন ও অন্ধকার।