বড়দিনের উৎসবে মাতল তিলােত্তমা

বড়দিনে সেজে উঠেছে কলকাতা। (Photo: Kuntal Chakrabarty/IANS)

এই শহরই পারে বিদ্রোহের মশাল আলাে থেকে উৎসবের মােমবাতি জ্বালিয়ে নিতে। বিদ্রোহের স্লোগানের সুরকে ক্রিসমাস ক্যারলের সুরে মিলিয়ে দিতে। মিছিলের পথকে উৎসবের আঙিনায় এনে মিশিয়ে দিতে। প্রতিবাদের আগুন আঁচে বড়দিনের কেক-পেস্ট্রি সেঁকে নিতে।

তা না হলে মঙ্গলবার ভরসন্ধেতেও যখন শহরে আনাচে কানাচে ‘ক্যা ক্যা…’ নিয়ে ছিছিক্কার উঠছে, কিংবা যাদবপুর নিয়ে আচার্য আর উপাচার্যের তরজায় ‘আজাদি’র ধ্বনি চলছে, তার একটু পরেই সেই মানুষগুলােই গেয়ে উঠতে পারে ‘জিংগল বেল, জিংগল বেল, জিংগল অল দ্য ওয়ে…’। দিনভর আন্দোলন বাঁক নিতে পারে বড়দিনের আনন্দে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে গির্জার ঘন্টা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অশান্ত তিলােত্তমা শুনিয়েছে শান্তি সুর। শহরজোড়া আন্দোলনের নেত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ও জোড়হস্ত হয়েছেন প্রার্থনার পর্বে। অন্ধকার থেকে আলাের পথযাত্রী হয়েছে আমজনতা।

বুধবার সকালে শীতের কামড়টা একটু কমই ছিল। তবে কুয়াশার আস্তরণ শহরটাকে ঢেকে রেখেছিল মনখারাপের মতাে। বেলা একটু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই আস্তরণটা টেনে সরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে মানুষ। ভিক্টোরিয়া মেমােরিয়াল, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানায় উপচে পড়েছে দর্শনার্থীর ভিড়। মূলত যারা স্রেফ হুল্লোড় মেতে উঠতে ভালােবাসে তাদের ভিড় ছিল নলবন, ইকো পার্ক, নিকো পার্কে। আর সন্ধের আলাের রােশনাইতে ভেসে যাওয়া শহরে গা ভাসিয়েছে আট থেকে আশি সব বয়সের মানুষ। তাদের গন্তব্য ছিল পার্ক স্ট্রিট, অ্যালেন পার্ক, বাে ব্যারাকের ভিড়ে। গানের ছন্দে নাচের তালে পা মিলিয়ে, খাদ্য পানীয়ের স্বাদে রসনা ডুবিয়ে মেতে উঠেছে মানুষ।


মানুষের ঢল সামলাতে বুধবার মেট্রোর সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রান্তিক স্টেশন থেকে শেষ মেট্রোর সময়সীমা বাড়িয়ে ১১-২০ করা হয়েছে। বাড়ানাে হয়েছে ট্রেনের সংখ্যাও। বুধবার সকাল থেকেই মেট্রোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়।

সকালের ভিক্টোরিয়া মেমােরিয়ালে সবুজের মধ্যে প্রাতঃভ্রমণকারীরা বুধবার ছিলেন ব্যাকফুটে। এদিন ভিক্টোরিয়ার সবুজের মধ্যে লম্বা শ্বাস নিতে সকাল রং বেরঙের পােশাকে সেজে ভিড় করেছে ছাপােষা গেরস্ত থেকে বিদেশি দর্শনার্থী। ভিক্টোরিয়া চত্বরে রাস্তার চাওয়ালাদের এদিন পােয়া বারাে। ভিক্টোরিয়ার কিউরেটর জয়ন্ত সেনগুপ্ত জানিয়েছেন এদিন প্রায় ৩২,৪৭৩ জন মানুষ এসেছিলেন ভিক্টোরিয়ায়। তুলনায় ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের ভিড়টা একটু কম, ১২ হাজারের মতাে। তবে যাঁরা এদিন মিউজিয়ামে এসেছিলেন, অনেকটা সময় নিয়ে মনােযােগ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন দ্রষ্টব্যগুলাে।

চিড়িয়াখানার ভিড়টা ছিল সবেচয়ে বেশি। কচিকাচাদের হাত ধরে পরিবারকে নিয়ে প্রায় ৬৮ হাজার মানুষ এসেছিলেন পশুদের সংসার দেখতে। ক’দিন আগেই নতুন দুই সিংহশাবক ইশা আর নিশা জন্ম নিয়েছে চিড়িয়াখানায়। এই সিংহছানাগুলিই ছিল এদিন চিড়িয়াখানার মূল আকর্ষণ। সঙ্গে দোসর চারটে বুনাে কুকুর। বাঘ, হাতি, শিম্পাঞ্জির সঙ্গে খুনসুটিতে মেতেছিল খুদেরা। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছােটবেলায় ফিরে গিয়েছেন প্রাপ্তবয়স্করাও।

ওদিকে ইকো পার্কে বড়দিনের উৎসবের উত্তাপে মেতে উঠেছে যাঁরা মূলত এখানে আসে একটু উষ্ণতার জন্যই। পরিবেশ রক্ষার জন্য এদিন ইকো পার্কের মধ্যে খাওয়া দাওয়া নিয়ে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী, আনন্দ তাতে একটু ফিকে হয়ে যায়নি। বরং পার্কের বাইরেই তারা ঝালমুড়ি, ভেলপুরির হুশহাস ঝাঁঝ ঠোটে নিয়ে পার্কে প্রবেশ করেছেন। তুলনায় নলবন, ইকো পার্কের চেহারাটা একটু অন্যরকম। নলবনের অ্যাকোয়াটিকায় বা ইকো পার্কের ওয়াটার বডির ধারে হিমেল বাতাসে এদিন হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াল অনেকেই। শীতকে উপেক্ষা করেই।

এখন অনলাইন বুকিং-এর সৌজন্যে সিনেমা হলগুলােতে হাউসফুল স্টেট্যাস রয়েছে অনেক আগে থেকেই। মাল্টিপ্লেক্স থেকে পাড়ার হল সর্বত্রই একই অবস্থা। তবে এদিন সাঁঝবেলার ভিড়টা মূলত ছিল পার্ক স্ট্রিটমুখী। সেই আদ্যিকালের কলকাতা থেকে বড়দিনের সঙ্গে একটা সুতাের বন্ধনে জড়িয়ে গিয়েছে পার্ক স্ট্রিট। বেক-পেস্ট্রির ম ম করা গন্ধ, ঝিম আলাের রেস্তোরায় নেশা। নেশা ঝিমধরা আবহ, উষা উত্থাপের গিটারের ঝংকার, রঙিন আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া পার্ক স্ট্রিট দেখে বােঝার উপায় ছিল না এই শহরের বুকের মধ্যে কতটা ক্ষত রয়েছে।

আর উৎসব শেষে শীতরাতের ওম মেখে যখন ক্লান্ত মানুষ বাড়ি ফিরছে, তখন তিলােত্তমার ফুটপাতে কাঠকুটো জ্বালিয়ে আগুন পােহাচ্ছে ফুটপাতের বাসিন্দা মানুষগুলো। সেই উষ্ণতা তাদের কাছে বড়দিনের নয়, জীবনযুদ্ধের রােজদিনের।