রদবদলের খড়গপুর: পারফরমেন্সের বিচারে স্বস্তিতে নেই কোন তৃণমূল নেতাই

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।

তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় সংগঠনের খোলনলচে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই সিদ্ধান্ত কবে কার্যকর হয় সেদিকেই তাকিয়ে দার্জিলিং থেকে দীঘা তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী ও নেতারা । খড়গপুর শহরও তার ব্যতিক্রম নয়। বিধানসভার উপনির্বাচন শেষ হওয়ার পরেই সাংগঠনিক রদবদল হবে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতারা ।

খড়গপুর শহরে এই মুহূর্তে কোনো স্থায়ী সভাপতি নেই । বিদায়ী সভাপতি সূর্য প্রকাশ রাও দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশে থাকায় তার বদলে সভাপতি হিসেবে দলীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করার কথা বলা হয়েছে পুরপ্রধান কল্যাণী ঘোষকে । কিন্তু খোদ পুরপ্রধান কল্যাণী ঘোষের উপর অনাস্থা জানিয়ে ২০ জন কাউন্সিলর লিখিত আকারে দলীয় নেতৃত্বের কাছে দরবার করেছেন। পাশাপাশি দলের যুব সংগঠনের দায়িত্বে রয়েছেন রাধেশ্যাম ওরফে সনু সিং । তাকে বদল করা হতে পারে। দলের মহিলা সংগঠনের দায়িত্ব রয়েছে কল্যাণী ঘোষের কাঁধে। এই পদেও নতুন কাউকে আনা হবে বলে জানা গিয়েছে।

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন নেতাদের পারফরমেন্সই হবে দায়িত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে শেষ কথা। পুর নির্বাচনে ওয়ার্ডে নিজেরা জয়ী হচ্ছেন অথচ লোকসভা বা বিধানসভা ভোট এলে উল্টো ছবি দেখা যাচ্ছে, এটা আর বরদাস্ত করা হবে না। তরতাজা মুখ দলের সামনের সারিতে নিয়ে আসা হবে । অভিষেকের এই কথায় স্বাভাবিকভাবেই অনেক নেতার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে ।


খড়গপুর শহরে পুরসভার ৩৫ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২০২২ সালে তৃণমূল ২০ টি, বিজেপি ৬ টি, কংগ্রেস ৬ টি, সিপিআই একটি, সিপিএম একটি এবং নির্দল একটি ওয়ার্ডে জয়ী হয় । পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের দুজন, সিপিআইয়ের একজন, বিজেপির একজন এবং নির্দল একজন তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। পুরপ্রধান হন প্রদীপ সরকার। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রদীপের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেন তৃণমূলের বেশিরভাগ কাউন্সিলর । ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে পুরপ্রধান করা হয় কল্যাণী ঘোষকে। কিন্তু কল্যাণীর কাজকর্মে অনাস্থা জানিয়ে ২০ জন কাউন্সিলর দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে চিঠি দেওয়ায় খড়গপুর পুরসভায় পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠেছে।

২০২২ সালের পুর নির্বাচনে কল্যাণী ঘোষ ৭৬২ ভোটে বিজেপি প্রার্থীকে হারিয়ে সাত নম্বর ওয়ার্ড থেকে জয়ী হন। ওয়ার্ডের সাতটি বুথেই কল্যাণী জয়ী হন। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখা গিয়েছে এই সাতটি বুথেই জয়ী হয়েছে বিজেপি । এই ওয়ার্ডে বিজেপির জয়ের ব্যবধান ৮৩৫ অর্থাৎ পুরপ্রধান হিসেবে অন্তত নিজের ওয়ার্ডে ছাপ ফেলতে ব্যর্থ কল্যাণী ঘোষ। তৃণমূলের এই ওয়ার্ডে ভোট কমেছে ৫২২টি। পরিসংখ্যানই সেই কথা তুলে ধরছে ।

৯ নং ওয়ার্ডে পুরসভার কাউন্সিলর ইন চার্জ প্রবীর ঘোষ ৪৮১ ভোটে জয়ী হয়েছিল। এই ওয়ার্ডের সাতটি বুথের মধ্যে দুটি বুথে বিজেপি জয়ী হয়েছিল। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সাতটি বুথেই বিজেপি জয়লাভ করেছে । তাদের জয়ের ব্যবধান ৮৩৬ । কিন্তু এই ওয়ার্ডে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে ৫৪টি। ১৭ নং ওয়ার্ডে পুর নির্বাচনে তৃণমূল ২৬১৭ ভোটে জিতেছিল । ওয়ার্ডের আটটি বুথেই জিতেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। লোকসভা নির্বাচনে আটটি বুথেই জিতেছে বিজেপি । বিজেপির জয় ১৪৭৮ ভোটে । তৃণমূলের ভোট কমে গিয়েছে ৭৫৯ টি । ১৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পুরসভার সিআইসি নমিতা চৌধুরী। ২১ নং ওয়ার্ডে পুর নির্বাচনে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির ভোটের ফারাক ছিল ১৩২১ । সাতটি বুথেই জিতেছিল তৃণমূল। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই ওয়ার্ডে ১০৮৫ টি ভোটে জিতেছে। ছটি বুথেই বিজেপি জিতেছে। এই ওয়ার্ডে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট কমেছে ৭৬৫ টি। ২১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পুরসভার কাউন্সিলর ইনচার্জ ডি. বাসন্তী। ২৭ নং ওয়ার্ডে পুর নির্বাচনে নটি বুথেই তৃণমূল জিতেছিল । তাদের জয়ের ব্যবধান ছিল ১১৬৭। লোকসভা নির্বাচনে এই ওয়ার্ডে বিজেপি চারটি বুথে জয়ী হয়। তৃণমূল এই ওয়ার্ডে বিজেপিকে ২৯৬ ভোটে হারায়। ২৭ নং ওয়ার্ডে তৃণমূলের ভোট পুর নির্বাচনের তুলনায় বেড়েছে ৫০ টি । এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পৌরসভার অন্যতম কাউন্সিলর ইন চার্জ রোহন দাস। ২৮ নং ওয়ার্ডে পুর নির্বাচনে সাতটি বুথেই জিতেছিল তৃণমূল। বিজেপিকে তারা হারায় ৭৫৮ ভোটে। লোকসভা নির্বাচনে ঠিক তার উল্টো ছবি। সাতটি বুথেই জয়ী হয় বিজেপি। বিজেপির জয়ের ব্যবধান হয় ৯৬৫। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পুরসভার সিআইসি রীতা পান্ডে। ২৯ নং ওয়ার্ডে পুর নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস সাতটি বুথে জয়ী হয়েছিল। ভোট পেয়েছিল ৩৪৭৮ । জয়ের ব্যবধান ছিল ২৫৪০ । লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ১০৮৪ টি কমে যায়। বিজেপি এই ওয়ার্ডে জয়ী হয় ২৭৬ ভোটে । তিনটি বুথে তারা জয়ী হয়। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চন্দন সিং পুরসভার অন্যতম সিআইসি।৩৪ নং ওয়ার্ডে পুর নির্বাচনে আটটি বুথেই তৃণমূল এগিয়েছিল। কাউন্সিলর তথা পুরসভার অন্যতম কাউন্সিলর ইন চার্জ অপূর্ব ঘোষ ১৭৩৫ ভোটে জয়ী হন। লোকসভা নির্বাচনে তিনটি বুথ দখল করে বিজেপি । এই ওয়ার্ডে মাত্র ৬৫ ভোটে হেরে যায় তৃণমূল। এই ওয়ার্ডে তৃণমূলের ভোট কমেছে ৯৬৭ টি। ৬ নং ওয়ার্ডে পুর নির্বাচনে ২২৩০ টি ভোটে জয়ী হন প্রাক্তন পুর প্রধান প্রদীপ সরকার । সাতটি বুথেই জয়ী হয় তৃণমূল । লোকসভা নির্বাচনে সাতটির মধ্যে ছটি বুথে বিজেপি এগিয়ে যায়। বিজেপির জয়ের ব্যবধান হয় ৪৪৬ । এই ওয়ার্ডে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ১১১৪ টি ।

সংখ্যালঘু অধ্যুষিত তিনটি ওয়ার্ড বাদ দিলে খড়গপুর পুরসভার ৩৫ টি ওয়ার্ডের মধ্যে শুধুমাত্র ২৭ নং ওয়ার্ডে তৃণমূল কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির থেকে এগিয়েছিল। লোকসভা নির্বাচনে মাত্র দুটি ওয়ার্ডে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট বেড়েছে। ২৭ নং ওয়ার্ডে বেড়েছে ৫০ টি এবং ৯ নং ওয়ার্ডে বেড়েছে ৫৪ টি। লোকসভা নির্বাচনে বুথ দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছে ২৭ ও ৩৪ নং ওয়ার্ড । ২৭ নং ওয়ার্ডে নটি বুথের মধ্যে তৃণমূল পাঁচটি বুথে এবং ৩৪ নং ওয়ার্ডে আটটির মধ্যে পাঁচটি বুথে তৃণমূল কংগ্রেস এগিয়ে রয়েছে । সুতরাং পুর নির্বাচনের সঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল তুলনা করলে খড়গপুর শহরে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত তিনটি ওয়ার্ড বাদ দিলে রোহন দাস, অপূর্ব ঘোষ এবং প্রবীর ঘোষ এই তিনজন কাউন্সিলর কথা বলার মত জায়গায় রয়েছেন। এই তিনজন কাউন্সিলরের মধ্যে অভিজ্ঞতাযর নিরিখে এগিয়ে রয়েছেন অপূর্ব ঘোষ। তিনি ২০০০ সাল থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত । ২০১০ থেকে ২০১৫ তিনি কাউন্সিলর ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তার স্ত্রী কাউন্সিলর হন। ২০২২ সালে তিনি ফের কাউন্সিলর হন । অন্যদিকে রোহন দাস ও প্রবীর ঘোষ দুজনেই রাজনীতিতে নবাগত । ২০২২ সালেই তারা প্রথম নির্বাচনী ময়দানে নেমেছেন।

নির্বাচনী ফলাফলের এই মার্কশিট হাতে নিয়েই খড়গপুর পুরসভার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে সাংগঠনিক রদবদল প্রসঙ্গে তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, গোটা শহরকে তিনটি জোনে ভাগ করে তিনজন সাংগঠনিক সভাপতি করা হবে। যাদের সঙ্গে তাল মিল বজায় রাখার কাজ করবেন একজন কো-অর্ডিনেটর। যুব ও মহিলা সংগঠনের দায়িত্ব অবশ্য একজনের হাতেই থাকবে।