মর্যাদার লড়াইয়ে নিজের গড়েই ধুলিসাৎ হয়ে গেলেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘােষ। ২০১৬ সালে চাচা জ্ঞান সিং সােহনপালকে হারিয়ে খড়গপুরের দখল নিয়েছিল বিজেপি। ২০১৯ সালের লােকসভা নির্বাচনে ব্যবধান বাড়িয়ে ৪৫ হাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন দিলীপ ঘােষ। বিজেপি আরও পরিষ্কারভাবে বললে দিলীপ ঘােষ মনে করেছিলেন খড়গপুর তাঁদের দুর্গ। এখানে একটা বাঁশকে দাঁড় করালেও বিজেপি জিতবে। দিলীপবাবুর এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই খড়গপুরে বিজেপির পতন ডেকে আনল।
৪৫ হাজারের ব্যবধান ঘপিয়ে গিয়ে তৃণমূল প্রার্থী প্রদীপ সরকারের ২০ হাজার ৮১১ ভােটে জয় নিঃসন্দেহে মিরাক্যাল। এই মিরাক্যাল যিনি ঘটিয়েছেন তিনি শুভেন্দু অধিকারী। খড়গপুর দখলের জন্য একদিকে সাংগঠনিক শৈথিল্য দূর করেছেন, অন্যদিকে কাজে লাগিয়েছেন পুলিশ প্রশাসনকে। এর পাশাপাশি তৃণমূলকে সাহায্য করেছে প্রার্থী নিয়ে বিজেপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, দিলীপবাবুর একগুঁয়েমি মনােভাব। ভােটার যে কোনও রাজনৈতিক দলের কেনা গােলাম নয়, সেকথাও প্রমাণ করল6 খড়গপুরের উপনির্বাচন।
কেন এই ফলাফল? বিজেপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, জেলা, রাজ্য থেকে শ’খানেক নেতা এসেছে। প্রেমহরি ভবনে থেকেছেন, খেয়েছেন, সভায় ভাষণ দিয়েছেন, চলে গিয়েছেন। এভাবে নির্বাচনে জেতা যায় না। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বুথ কমিটি তৈরি হয়নি। বুথ কমিটি কীভাবে কাজ করবে, তার নজরদারি চালানাের জন্য কেউ ছিলেন না। যাঁরা কাজের ছেলে, তাদের সুযােগ দেওয়া হয়নি। বুথ কমিটির সঙ্গে সমন্বয় তৈরি হয়নি। এই পরাজয়ের জন্য দিলীপ ঘােষ একা দায়ী নন। জেলা নেতৃত্বও দায় এড়াতে পারেন না। প্রার্থী নিয়ে প্রথম থেকেই ক্ষোভ ছিল।
বিজেপির জোনাল কনভেনর তুষার মুখার্জিও বলেন, এটা দল নয়, প্রার্থীর পরাজয়। তৃণমূল কংগ্রেসের শহর সভাপতি রবিশঙ্কর পাণ্ডে বলেন, বিজেপির আচ্ছে দিন শেষ হয়ে আসছে। এই ফল তারই প্রমাণ দিচ্ছে। জয়ের পর প্রার্থী প্রদীপ সরকার বলেন, এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের জয়। শুভেন্দু অধিকারী না থাকলে এই জয় সম্ভব ছিল না।
শুভেন্দুর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে বিজেপিকে অসহায় লেগেছে। প্রেমচন্দ্র ঝা প্রার্থী হচ্ছেন, এটা ভেবে অনেক আগেই পরিকল্পনা কষতে শুরু করে তৃণমূল। ১৫ বছর আগেকার একটি মামলা তুলে এনে প্রেমচন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযােগ দায়ের করা হয়। প্রেমচন্দ্রের ইমেজকে ড্যামেজ করতে মাঠে নামানাে হয় প্রদীপ পট্টনায়ককে। বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির প্রাক্তন সদস্য প্রদীপবাবু মাত্র ৭৫৩টি ভােট পেলেও দিলীপ ঘােষ এবং ঝাকে নিয়ে তাঁর অভিযােগ, ঝাকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেয়।
তৃণমূলের কর্পোরেট স্টাইলের প্রচারের পাশে বিজেপির প্রচার ছিল নিতান্তই দায়সারা। সাংগঠনিক এই দুর্বলতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে তৃণমূল। ফলে ভােটের দিন বুথের পর বুথে শাসক দল নীরব সন্ত্রাস চালালেও বিজেপি মুখ খুলতে পারেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজেপি নেতা বলেন, কংগ্রেসের মতাে দলও যখন চাচার গড়ে এবার চিত্তজাতীয় স্লোগান দিয়ে প্রচারে নেমেছে, তখন সেখানে বিজেপির প্রচার ছিল স্লোগানবিহীন। নির্দিষ্ট অভিমুখও ছিল না। কোন বিষয় নিয়ে আক্রমণ শানানাে হবে, সেরকম কোনও নির্দেশও পাননি নীচুতলার নেতারা। ফলে তৃণমূলের প্রচারের পাল্টা প্রচার করতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি।
এছাড়াও এনআরসি নিয়ে আতঙ্কও মানুষকে ভীত, ত্রস্ত করেছে। এনআরসি’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৃণমূলকে মানুষ বিশ্বাসযােগ্য মনে করেছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই টগবগ করে ফুটছিল তৃণমূল শিবির। প্রথম রাউন্ডে কংগ্রেস প্রার্থী এগিয়ে যান। পরের তিন রাউন্ডে এগিয়েছিলেন বিজেপির প্রেমচন্দ্র ঝা। কিন্তু তারপর থেকে প্রতিটি রাউন্ডে পিছিয়ে যেতে থাকেন ঝা। এগােতে থাকেন প্রদীপ সরকার। খারাপ ফলের জন্য পুলিশ ও মাফিয়ার যৌথ সন্ত্রাসকে দায়ী করেছেন ঝা। তিনি বলেন, পুলিশ আর গুন্ডাদের চাপে সাধারণ মানুষ ভােট দিতে পারেনি। ভােট দিলে বিজেপিই জয়ী হত।
ঝা যাই বলুন, খড়গপুরের অবাঙালি মানুষ তৃণমূলকে অস্পৃশ্য ভাবতেন, সেই অবাঙালি ভােটে এবার থাবা বসিয়েছে তৃণমূল। ইন্দায় এক অবাঙালি ব্যবসায়ী বলেন, আমরা প্রদীপকে দেখে ভােট দিয়েছি। ব্যক্তি প্রদীপের এই ভােট, সিপিআই-সিপিএমের একাংশের ভােট আর পুলিশ প্রশাসনের সাহায্যে প্রদীপের জয়ের দরজা খুলেছে বলে রাজনৈতিক মহলের দাবি। কিন্তু গত লােকসভা নির্বাচনের থেকে প্রায় ২৪ হাজার ভােট বৃদ্ধির পিছনে বিদায়ী বিধায়ক দিলীপ ঘােষের উপর মানুষের ক্ষোভও কাজ করেছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের রেল সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতি, বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে মানুষ ভােট দিয়েছেন। ফলে রেল এলাকার আটটি ওয়ার্ডেই তৃণমূল এগিয়ে থেকেছে। বিজেপির হাত ছেড়ে তৃণমূলের হাত ধরবে, রেল এলাকার মানুষ, এটা অনেকের কাছেই গ্রহণযােগ্য মনে হয়নি। কিন্তু অমূল্য মাইতি, দেবাশিস ভুইয়ার মতাে দাঁতে দাঁত চেপে প্রচার চালিয়ে যাওয়া নেতারা এই উলটপুরাণের গন্ধ পেয়েছিলেন, ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছিলেন। ছােট ছােট পুঁতি দিয়ে যেমন বড় মালা তৈরি হয়, ঠিক সেইরকম ছােট ছােট নানা কারণের দরুন প্রদীপের জয়মাল্য তৈরি হয়েছে খড়গপুর সদরে।