পর্যটনে ঝাড়গ্রাম

সুখেন্দু হীরা

এর পরদিন আমরা সকাল সকাল ঝাড়গ্রাম থেকে বেরিয়ে পড়বো৷ প্রথমেই ঢু মারবো শিলদা রাজবাডি়তে৷ ঝাড়গ্রাম থেকে শিলদার দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার৷ রাজা মানগোবিন্দ মল্লদেব এবং রানি কিশোরমনির স্মৃতি বিজডি়ত এই গড়বাডি়৷ রাজবাডি়টি উঁচু ঢিবির মত হয়ে আছে৷ তোরণটি শুধু টিকে আছে৷ রানি কিশোরমনির প্রতিষ্ঠিত রাধাকৃষ্ণের মন্দিরটি এখনো আছে৷ মাকরা পাথরের তৈরি মন্দির, বিগ্রহ পিতলের৷ মানগোবিন্দের প্রপিতামহ দক্ষিণ দেশ থেকে এসে তৎকালীন রাজা বিজয় সিংহকে পরাজিত করে শিলদা পরগনা দখল করেন৷ শিলদা পরগনার পূর্বের নাম ছিল ঝাঁটিবনি৷ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দশসালা বন্দোবস্তো অনুযায়ী শিলদা পরগনার মানগোবিন্দ জমিদার ছিলেন৷ তাঁর মৃতু্যর পর ১৮০৬ সালে তাঁর স্ত্রী কিশোরমনি রাজ্যভার গ্রহণ করেন৷

শিলদা থেকে ডানদিকে বাঁকুড়া যাওয়ার রাস্তায় দু কিলোমিটার গেলে ওরগোঁদা৷ ফাঁকা মাঠের মধ্যে দুটি পাথরের মাকড়া পাথরের উঁচু বেদি৷ একটি ভৈরব থান এবং অন্যটি রঙ্কিনী দেবীর থান৷ ভৈরব থানটি মাটির হাতি ঘোড়া দ্বারা পরিবৃত৷ মনে হয় এখানে আগে মাকড়া পাথরের মন্দির ছিল বর্তমানে শুধু ভিত অবশিষ্ট আছে৷ দেখে মনে হবে আমরা যেন ইনকা সভ্যতার দেশে চলে এসেছি৷


এখানে দুর্গাপূজার সময় দশমীর দিন এবং তারপর দিন, মোট দুদিন পাতাবেঁধা পরব উপলক্ষে বিরাট মেলা বসে৷ প্রথম দিন সবশ্রেণীর মানুষদের জন্য এবং দ্বিতীয় দিন কেবলমাত্র আদিবাসীদের জন্য৷ এই মেলা জঙ্গলমহলের অন্যতম জনপ্রিয় ও জনবহুল মেলা৷

আমরা শিলদা থেকে বাম দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাব বেলপাহাডি়র দিকে৷ শিলদা থেকে বেলপাহাডি় মাত্র ৮ কিমি৷ বেলপাহাডি়’র নাম শুনলেই এখনও শিহরণ জাগে৷ বেলপাহাডি় একটা গঞ্জ৷ বিনপুর-২ বিডিও অফিস, থানা, ফরেস্ট অফিস, বাজার-হাট সবমিলিয়ে জমজমাট৷ একটি একটি সুন্দর ফরেস্ট বাংলোও আছে৷ এসব দেখে এখন আর ভয় করবে না৷ বেলপাহাডি় থানার পেছনদিকে আছে নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ৷ নীল যে তৈরি হতো, তা পরিকাঠামো দেখলে বোঝা যায়৷ আর বেলপাহাডি় থানা মাওবাদী আন্দোলন বহু ঘটনার সাক্ষী৷ এসব দেখে যদি সময় নষ্ট করতে চান, তবে একটু জিডি়য়ে নেবার জন্য গাডি় থামিয়ে চা খেয়ে নিতে পারেন৷

বেলপাহাডি় থেকে ডান দিকে সোজা সাডে় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঘাগড়া প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র৷ এখানে তারাফেনী নদীর জলপ্রবাহ শিলার ওপর ক্ষয়কার্যকরে বেশ বড় বড় গর্ত সৃষ্টি করেছে৷ বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় তারাফেনীর সংকীর্ণ ধারার পাশে পাথরের বুকে এই অপরূপ সৌন্দর্য সবাইকে অবাক করবে৷

ঘাগড়া থেকে আমরা আবার ফিরবো বেলপাহাডি়৷ এবার এখান থেকে বাম দিকে আগুইবিলের দিকে ৯ কিলোমিটার দূরে গাড়রাসিনি পাহাড়৷ ১৭৫ মিটার উঁচুতে ওঠার জন্য পাথুরে পথ আছে৷ একেবারে চূড়ায় আছে শিবমন্দির৷ কেউ চাইলে উঠে একটু গায়ের ঘাম ঝরাতে পারেন৷ নিচে আছে আচার্য সত্যানন্দ আশ্রম৷
এখান থেকে আমরা চলে যাব খাঁদারানি ড্যাম৷ গাড়রাসিনি থেকে জঙ্গল পথে খাঁদারানি মাত্র আড়াই কিমি৷ খাঁদারানি বাঁধের ভরা জল দেখে আপনার মন ভরে যাবে৷ মনে হবে কে যে এর নাম ‘খাঁদারানি’ রাখল৷ এতো বেলপাহাডি়র রানি৷ সবুজ পাহাড় ঘেরা সবুজ-নীল জল দেখে মন বলবে এখানেই শেষ করি ঝাড়গ্রাম ভ্রমণ৷

কিন্ত্ত খাঁদারানীর মোহ কাটিয়ে আমাদের যেতে হবে লালজল৷ বেলপাহাডি় থেকে বাঁশপাহাডি় যাওয়ার রাস্তায় জামতলাগোড়া পেরিয়ে লালজল মোড় থেকে দু’কিলোমিটার ভিতরে লালজল গ্রাম৷ খাঁদারানি থেকে দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার৷ দেব পাহাড় এবং সিংলহর পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই গ্রাম৷ দেব পাহাডে়র উপর একটি বিশাল প্রাকৃতিক গুহা আছে৷ সামান্য পরিশ্রম করে যদি গুহামুখে যাওয়া যায়, তখন মনে হবে, ‘আমি এলেম কোন আদিম দেশে’৷ অনেকে বলেন এখানে আগে লাল জলের ঝর্ণা ছিল তাই এই এরকম নামকরণ৷

লালজল ত্যাগ করে আমরা এগিয়ে যাব বাঁশপাহাডি়র দিকে৷ কিছুক্ষণ বাদে পড়বে সিয়ারবিন্দা চড়াই৷ আগে এখানে গাডি় নিয়ে যাওয়ার সময় গাডি় থেকে নেমে যেতে হতো সবাইকে৷ এতটা খাড়াই ছিল রাস্তা৷ বর্তমানে বেশ মসৃণ রাস্তা৷ তবে চড়াইয়ের আমেজটা এখনো আছে৷ দু’পাশে মায়াবী জঙ্গল নেমে গেছে৷ জঙ্গলের নির্জনতা ভেঙে মাঝে মাঝে গাডি় ছুটে যাচ্ছে৷ সিয়ারবিন্দা টপে গাডি় দাঁড় করিয়ে, একটু নেমে দাঁড়ালে মনে হবে, লোকালয়ের কোলাহল ছেডে় আজ আমি কত উঁচুতে৷

এরপর আমাদের গন্তব্য কাঁকড়াঝোড়৷ এখন আপনাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে কাঁকড়াঝোড় কোন পথে যাবেন? কাঁকড়াঝোড় যাবার দুটি পথ আছে৷ একটি ভুলাভেদা হয়ে সনাতনী টেকিং রুট৷ আগে এ পথ ছিল বড় বড় বোল্ডারের৷ এখন মোরামে রাঙ্গা৷ এখান থেকে কাঁকড়াঝোড় ১৬ কিলোমিটার৷ পথে পড়বে দলদলি৷ এখানে বাংলায় প্রথম মাওবাদীদের দ্বারা ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণ হয়েছিল ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে৷ এই পথটি নির্ধারিত আছে ট্রেকিং-এর জন্য৷ তবে যারা গাডি় নিয়ে যাবেন তাদের আরেকটু এগিয়ে চাকাডোবা থেকে ডাইনে ঘুরে ছুরিমারা হয়ে কাঁকড়াঝোড় যাওয়াই ভালো৷

ছুরিমারাতে একটি পুলিশের ক্যাম্প আছে৷ ক্যাম্পে একটি পুলিশের পাঠশালা চলে৷ সকালে গেলে এটি দেখা যায়৷ বেলপাহাডি় ভ্রমণে লক্ষ থাকে কাঁকড়াঝোডে় পদার্পণ৷ কাঁকড়াঝোডে় পদার্পণ না করলে এর মাহাত্ম্য বোঝা যাবে না৷ অদূরে নীলপাহাড়, সবুজ বনানী আর লাল কাঁকুডে় মাটি৷ মনে হবে এখানে না এলে জীবন বৃথা৷ কাছেই বিখ্যাত আমলাশোল গ্রাম৷ দু কিলোমিটার দূরে ময়ূর ঝরনা, আরো এক কিলোমিটার দূরে আম ঝরনা৷ ভাববেন না ঝরনা মানে ঝিরিঝিরি ঝরনা৷ ঝরনা মানে এখানে পুকুর৷

আম ঝরনা পেরিয়ে ত্রিসীমানা৷ এটি ঝাড়খন্ড, পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রামের বর্ডার৷ এখান থেকে ঝাড়খণ্ডের মধ্যে দিয়ে পুরুলিয়ার দুয়ারসিনি যাওয়া যায়৷ আগে কাঁকড়াঝোডে় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এবং টু্যরিজম ডিপার্টমেন্টের পাশাপাশি দুটো বাংলো ছিল৷ ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে মাওবাদীরা এ দুটো উডি়য়ে দেয়৷ বর্তমানে সেখানে সিআরপিএফ ক্যাম্প৷ এখন এখানে থাকতে চাইলে স্থানীয় কিছু বাডি়তে হোমস্টে -র ব্যবস্থা আছে৷
আমাদের যাত্রা এখানেই শেষ করতে পারি৷ যদি কেউ দীর্ঘায়িত করতে চান বা আরো বেশি গভীরে যাওয়ার আগ্রহ থাকে তবে আমরা যাব শিমুলপাল অঞ্চলে৷

শিমুলপাল অঞ্চলে আমরা প্রথমে যাব ঢাঙ্গিকুসুম৷ পথে পড়বে কদমডিহা, বুডি়ঝোড় ও চিড়াকুটি৷ কাঁকড়াঝোড় থেকে দূরত্ব ১৫ কিমি৷ চিড়াকুটি থেকে ডান দিকে মোড় নিতে হবে৷ গ্রামে যেতে গেলে পেরোতে হবে এক পাহাড় ভেদ করা রাস্তা৷ এ রাস্তায় যতবার যাবেন ততবার পুলকিত হবেন৷ দু’ধারে অনুচ্চ পাহাড়৷ পাহাড় কেটে যে পথ বার করা হয়েছে তার চিহ্ন প্রকট৷ মনে পডে় যাবে ‘মাঞ্জি – দ্যা মাউন্টেন ম্যান’ সিনেমার কথা৷ এই পথ অবশ্য দশরথ মাঝি’র মতো কোনও ব্যক্তি তৈরি করেননি৷ এটা সরকারি ভাবে বানানো হয়েছে৷

পাহাড় পেরোলে মনে হবে, এখান থেকে সভ্যতা অনেক দূর৷ গ্রামে প্রবেশ করলে মনটা হয়ে যাবে ম্রিয়মাণ৷ খুব গরীব প্রত্যন্ত গ্রাম৷ যখন এই রাস্তা ছিলনা তখন অনেক কষ্ট করে এদের সদর বেলপাহাডি়তে যেতে হতো৷ এখানে কয়েক ঘর পাথর শিল্পীর বাস৷ সারাদিনে হয়তো একটা থালা তৈরি করে সপরিবারে৷ সেটা হয়তো বেলপাহাডি় হাটে ১০০ টাকায় বিকোয় কিনা সন্দেহ (২০১৬ সালের কথা বলছি)৷

ঢাঙ্গিকুসুম গ্রামে না ঢুকে বাঁদিকে ২০০ মিটার গেলে পড়বে ‘হদহদি ফলস্’৷ ঝরনাটা হদহদ করে অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত মোটা ধারায় পড়ছে বলে এরূপ নাম৷ এটি একদম ঝাড়খণ্ড সীমান্ত৷ পাহাড় চোঁয়া প্রাকৃতিক জলাধারা কিছুটা সমতলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হঠাৎ পাহাড় থেকে খাদে লাফ দিয়েছে৷ তারপর এই জলধারা চলে গেছে ঝাড়খণ্ডের ভিতরে৷

২০১৮ সালের আগে স্থানীয় মানুষজন ছাড়া বাইরের পৃথিবীর কাছে এই নির্ঝর ছিল অজানা৷ ২০১৮ সালে কয়েকজন ইউটিউবার এসে ভিডিও করে জনসমক্ষে এনেছেন৷ সত্যি এটা দারুণ আবিষ্কার৷ নৈসর্গিক দৃশ্য অপূর্ব৷ এজন্য জনগনের আগমন অনেক বেডে় গেছে এই প্রত্যন্ত এলাকায়৷ এখন এখানে ঝর্ণা যাওয়ার পথে স্থানীয় পাথর শিল্পীর তাদের শিল্পসামগ্রী নিয়ে বসেন৷ এটা এই আবিষ্কারের ভালো ও অর্থকরী দিক৷
ঢাঙ্গিকুসুম থেকে এবার শিমুলপাল, দূরত্ব ১০ কিমি৷ আবার চিড়াকুটি আসতে হবে তারপর ডাইনে শিমুলপাল৷ শিমুলপাল গ্রামেও কয়েক ঘর পাথর শিল্পীর বাস আছে৷ এখানে পাথরের থালা, বাটি, গ্লাস বানায়৷ অর্ডার মাফিক বানায় মূর্তি, পঞ্চপ্রদীপ ইত্যাদি৷ শিল্পীদের জন্য বিডিও অফিস থেকে পাশে ঠাকুরপাহাডি় গ্রামে একটি কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করে দিয়েছে৷ সেখানে বসে জিনিস তৈরি বিপনন এবং প্রদর্শনী করতে পারবে৷

শিমুলপালের পর শেষ গন্তব্য কানাইসর পাহাড়৷ ঠাকুরপাহাডি় থেকে দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার৷ একেবারে ঝাড়খণ্ড সীমান্তে অবস্থিত পাহাড়৷ এই পাহাড়কে দেবতা জ্ঞানে পূজা করা হয়৷ আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবার বার্ষিক পূজা৷ সেদিন বিরাট মেলা বসে৷ পাহাড় ৭০০ মিটার উঁচু৷ বেশ কষ্ট করে উঠতে হয়৷ বিপদের সম্ভাবনাও আছে৷ তবে মেলা হয় নীচে৷ এবার ফেরার পালা৷ কানাইসর থেকে বেলপাহাডি় মাত্র ১০ কিলোমিটার৷

ঝাড়গ্রাম থেকে খুব সকালে বেরোলে একদিনের মধ্যে কুলিয়ে যাবে হয়তো এই পুরো ভ্রমন৷ তবে একদিন কাঁকড়াঝোডে় থেকে পরের দিন শিমুল পাল অঞ্চলের ভ্রমণটি করলে ভালো হয়৷ ঝাড়গ্রাম থেকে একটি গাডি় ভাড়া করে নিয়ে আসলে ভালো হয়৷ সব জায়গাগুলো ঘুরে দেখার জন্য সর্বত্র গণ পরিবহন মাধ্যম নেই৷ নিজের গাডি় থাকলে তো কথাই নেই, তবে পথপ্রদর্শক লাগবে৷

[চলবে]