শঙ্খ অধিকারী
প্রতি বছর রথ এলেই মনে পড়ে যাত্রার কথা আসলে রথ আর যাত্রা যেন একে অপরের পরিপুরক আসরে আসরে, গ্রামে গঞ্জে যাত্রার মাহাত্ম্য যদিও আর আগের মতো আর নেই, তবুও এই রথের সময়েই যাত্রার বায়নার চল রয়েছে আজও কলকাতার যাত্রা পাড়া বলে পরিচিত চিৎপুরে এসময় হালখাতার আবহ বিরাজ করত এদিন থেকেই নতুন নতুন পালার বিজ্ঞাপন, বায়নায় ডিসকাউন্ট এসব থাকতো তারপর পুজোর আগে থেকে শুরু করে সারা শীতের সন্ধ্যা জুড়ে এখানে ওখানে পড়তো যাত্রার প্যান্ডেল অসংখ্য যাত্রামোদি মানুষের ভীড়ে গমগম করে উঠতো প্যান্ডেল ভীড় সামলানোর জন্য ডাক পড়ত স্থানীয় প্রশাসনের পালাকার, যাত্রা নির্দেশক থেকে শুরু করে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম তখন মানুষের মুখে মুখে ঘুরত দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সামাজিক যাত্রাপালা পালাকার ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভু বাগ সেসময় যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদী যাত্রাপালায় উঠে আসেন পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় প্রথাগত ভাবে শিক্ষা লাভ না করেও তিনি একের পর এক সাড়া জাগানো পালা উপহার দেন সেসময়ের মানুষের মুখে মুখে ফিরতো তার যাত্রা পালার নাম, অচল পয়সা, রক্তে রোয়া ধান, পদধ্বনি, একটি পয়সা, দিন বদলের ডাক এইসব তখন যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গ্রাম বাঙলার পাড়ায় পাড়ায় যাত্রার এক কালচার গড়ে ওঠে সেই সময় শুধু কলকাতার নট্য কোম্পানি নয়, গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠে শখের যাত্রা দল গ্রাম বাঙলার আকাশে বাতাসে তখন প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ঝড়, সেসময় এই পালা গুলি মানুষের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য গনমাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে তাছাড়া, মানুষের মধ্যে বিনোদনের ক্ষেত্রেও যাত্রা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান জুড়ে ছিল এসময় সন্ধ্যা বেলায় মানুষের তেমন কিছু বিনোদন ছিল না, আজকের টিভি সিরিয়াল সংস্কৃতি তখনো মানুষ কে গ্রাস করে নি সুস্থ বিনোদন চর্চায় যাত্রা সেই বিনোদন দিয়ে গেছে যাত্রায় বিনোদনের সঙ্গে সঙ্গে শেখার উপাদানও ছিল প্রচুর যাত্রার এই অভিনয়কে ঘিরে অর্থনীতিও যথেষ্ট চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল এক একটা প্যান্ডেলে দশ পনের হাজার লোকের সমাগম হতো ধীরে ধীরে এই পালার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে প্রচুর লাইভ ইন্সট্রুমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে নানা রেকর্ডেড মিউজিক এসেছে, মাইকের ব্যবহার শুরু হয়েছে, চারদিক খোলা মঞ্চ থেকে তিন দিক খোলা হয়েছে, মেকাপ, লাইট– সব দিকেই পরিবর্তন হয়েছে বাংলার যাত্রাকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে গেছেন অভিনেতা শান্তিগোপাল তারপর নব্বইয়ের দশক থেকেই নানা করনে ভাটা পড়তে থাকে এই শিল্পে এর কারন হিসেবে কেউ বলেন, টিভি সিরিয়ালের প্রতি দর্শকদের অধিক আগ্রহ, কেউ বলেন মানুষের রুচির পরিবর্তন, আবার কেউ বলেন সিনেমার অভিনেতাদের যাত্রায় অনুপ্রবেশ যাত্রা এবং সিনেমা আলাদা দুটি শিল্প মাধ্যম এবং এর চরিত্রও আলাদা, অনেকে বলেন সিনেমার প্রতিভাবান অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ে যাত্রার মাটির গন্ধ কোথায় যেন হারিয়ে গেল মানুষেরাও তাই এই শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল এভাবে বছর কয়েক চলার পর যাত্রা শিল্পের কফিনে পেরেক ঠোকার কাজ করল করোনা কালীন লকডাউন এইসময় সম্পূর্ণ রূপে বেকার হয়ে গেল হাজার হাজার যাত্রা শিল্পী সেই দিনের ধাক্কা আজও ঠিকঠাকভাবে পূরন করতে পারেনি এই শিল্প কিছু বছর আগেও প্রতি বছর রথের দিনে খবরের কাগজ গুলোতে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দেখা যেত যাত্রা পালার আজ সেই বিজ্ঞাপনের বাহুল্য আর দেখা যায় না তবুও সংখ্যায় কম হলেও কিছু মানুষ দল বেঁধে যাত্রা কে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে আজও কোথাও কোথাও হয়তো ছোটো আকারে প্যান্ডেল বেঁধে যাত্রা পালা অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু সেই প্যান্ডেল ভালো ভাবে পূর্ন হয় না সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যাওয়ার রেওয়াজ যেমন একেবারে কমে গেছে, তেমনি যাত্রা প্যান্ডেলেও মানুষ আর ভীড় বাড়াচ্ছে না সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন, সেখানে আঙুলের এক চাপে হাজারো বিনোদন এক ঝটকায় হাজির যাত্রা প্যান্ডেলে ভীড় জমানোর লোক কোথায় আর! তবুও আশা জাগে প্রান্তিক কিছু দলগুলোর অভিনয় দেখলে রাজ্যে বর্ধমান, হুগলি এবং দুই মেদিনীপুর জেলায় বেশ কিছু ছোটো খাটো পেশাদারী দল আছে এরা অল্প টাকায় গ্রামের কোনো উৎসব বা মেলায় যাত্রাপালা পরিবেশন করে থাকে তা হলেও যাত্রার অতীতের গৌরব তাতে ফিরবে কিনা, তা সন্দেহের তাহলে গ্রামের প্রাচীন এই শিল্প যা কিনা সেই চৈতন্যদেবের সময় থেকে তার তীব্র অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করছে, তার কি শেষের শুরু হয়ে গেছে না কি নতুন দের হাত ধরে এই শিল্প আবার প্রান ফিরে পাবে, — শেষ কথা বলবে আগামী সময়