বছর শেষ হওয়ার আগেই সন্দেশখালিতে এলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন তিনি সরাসরি সন্দেশখালি কাণ্ড প্রসঙ্গে কথা না বললেও টাকার অঙ্কে খেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করলেন। মানুষকে মিথ্যা বোঝানো হয়েছিল বলে দাবি করেন মমতা। পাশাপাশি সন্দেশখালিতে দাঁড়িয়ে তিনি জানান, জেলায় নতুন মহকুমা তৈরি করা হবে। এছাড়াও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নিয়েও এদিন বড় ঘোষণা করেন মমতা। তিনি জানান, যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন মা–বোনেরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পাবেন।
সোমবার সন্দেশখালির ঋষি অরবিন্দ মিশনের মাঠে প্রশাসনিক সভা ও পরিষেবা প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুপুর ১টা নাগাদ হেলিকপ্টারে করে সভাস্থলে আসেন তিনি। এই অনুষ্ঠান থেকে মমতা সাধারণ মানুষের হাতে রাজ্য সরকারি প্রকল্পের সুবিধা তুলে দেন। কন্যাশ্রী, বাংলার বাড়ি, সবুজ সাথী, মেধাশ্রী ইত্যাদি প্রকল্পের উপভোক্তাদের হাতে সুবিধা তুলে দেন তিনি। এদিনের সভায় মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। নিজের বক্তব্যের শুরুতেই মা–বোনেদের অন্তর থেকে প্রণাম জানান মমতা। মুখ্যমন্ত্রী জানান, সোমবার ১২৩ কোটি টাকা খরচ করে ৬৬ প্রকল্পের উদ্বোধন হল। বেশ কয়েকটি প্রকল্পের শিলান্যাসও করেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিনের সভা থেকে সরকারি প্রকল্পের জন্য কাউকে টাকা না দেওয়ার আহ্বান জানান মমতা। তাঁর কথায়, ”আপনার টাকা, আপনার অধিকার। আমাদের প্রকল্পের জন্য টাকা লাগে না। কাউকে টাকা দেবেন না।” এছাড়াও তিনি ঘোষণা করেন, সন্দেশখালি গ্রামীণ হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা ৩০ থেকে বেড়ে ৬০ করা হবে। গর্ভবতী মহিলাদের জন্য এই হাসপাতালে সিজার করার ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি তৈরি হবে অপারেশন থিয়েটার। যাতে অন্য কোথাও রোগীকে যেতে না হয়।
এদিন তিনি ঘোষণা করেন, জেলায় নতুন মহকুমা ও ধুলিয়া খালের উপর নতুন সেতু তৈরি হবে। সন্দেশখালির মানুষকে যাতে পরিষেবা নিতে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে না হয় তাই নতুন মহকুমা তৈরি হচ্ছে। সন্দেশখালিতে সন্দেশের হাব তৈরি করতে চান মমতা। সোমবার প্রশাসনিক সভা মঞ্চ থেকে তিনি তাঁর এই ইচ্ছার কথা জানান। পাশাপাশি মঞ্চ থেকে তিনি সন্দেশখালি নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চান।
সন্দেশখালির মানুষকে মিলেমিশে থেকে দুষ্টু লোকের খপ্পরে না পড়ার পরামর্শ দেন মমতা। এক্ষেত্রে বিশেষ করে মহিলাদের সতর্ক করে দেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘ দুষ্টু লোকের খপ্পরে পড়বেন না। মহিলাদের বলছি কেউ ডাকলে চলে যাবেন না।’ সরাসরি সন্দেশখালি কাণ্ড নিয়ে মুখ না খুললেও মমতা বলেন, ”টাকার অঙ্কে খেলা হয়েছে। মানুষকে ভুল বোঝানো হয়েছিল। কিন্তু মিথ্যা বেশি দিন চলে না। সবটাই ভাওতা। মিথ্যা একদিন প্রকাশ পায়। যা হয়েছে আমি তা ভুলে গিয়েছি। আমি চাই সন্দেশখালির ছেলে মেয়েরা এক নম্বর স্থানে আসুক।” তিনি আরও বলেন, ”অত্যাচারকে ভাঙো, কুৎসাকে ভাঙো, দাঙ্গাকে ভাঙো, এটা দাঙ্গার জায়গা নয়। আমরা যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। মৃত্যু নয়, জীবন চাই, ধ্বংস নয় সৃষ্টি চাই।” মমতা জানান, তৃণমূল সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৩ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এই জেলায় জল স্বপ্ন প্রকল্পের আওতায় ১৫ লাখ বাড়িতে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার জন্যে ৩৫২৮ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ৯ লক্ষ বাড়িতে জলের কানেকশন পৌঁছে গিয়েছে।
এদিন আবাস যোজনায় টাকা না দেওয়ার অভিযোগ তুলে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন মমতা। তাঁর দাবি, ৩ বছর ধরে কেন্দ্র টাকা দেয় না। বাংলার বাড়ি প্রকল্পের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ১২ লক্ষ বাড়ি তৈরির জন্য প্রথম কিস্তির টাকা দিয়েছে রাজ্য সরকার। আগামী দেড় বছরের মধ্যে আরও ১৬ লক্ষ বাড়ি তৈরির আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এছাড়াও রাজ্য সরকারের একাধিক প্রকল্পের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন তিনি। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প নিয়েও এদিন গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, ৬০ বছর পর্যন্ত নয়, যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এই ভাতা পাবেন। তাঁর কথায়, ”এটা মা–বোনেদের অধিকার, এটা মা–বোনেদের সম্মান, মা–বোনেদের জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার অঙ্গিকার।” ২৬ জানুয়ারির পর প্রত্যন্ত এলাকায় আরও একটি করে দুয়ারে সরকার করার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে সন্দেশখালির বাসিন্দাদের জাতিগত শংসাপত্রের সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ওবিসিদের সমস্যা হচ্ছে কারণ আদালতে মামলাটি আটকে রাখা হয়েছে। আমরা আইনি লড়াই লড়ছি, এর জন্য লক্ষাধিক নিয়োগ আটকে রয়েছে।’ মমতা আরও বলেন, ‘আমি কথা কম বলি, আমি আজেবাজে ভাষণ দিই না। কিন্তু মনে রাখবেন, আমি যেটুকু বলি, সেটুকু করি। আমি যেটা পারি না সেটা বলি না। কারণ আমি কটূ কথা, মিথ্যা কথা বলতে শিখিনি। সৎ থাকলে আল্লার দোয়া পাওয়া যায়, ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাওয়া যায়।’
এদিন সভায় কয়েকজন একটি পোস্টার নিয়ে হাজির হন। যাতে লেখা ছিল, বিদ্যাধরী নদীর উপর জেলিয়াখালী ও রামপুর সংযোগকারী সেতু চাই। এই পোস্টার দেখে মমতা বলেন, ”একটা ব্রিজ এখনই দিলাম। তোমরা বলছ তাই বিষয়টা আমি নজরে রাখব। একসঙ্গে তো সব হয় না। টাকা জোগার করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার তো টাকা দেয় না।” বিজেপি আক্রমণ করে তিনি বলেন, ”ওদের অনেক টাকা আছে। এগুলো অন্যায়ের টাকা। এই টাকায় হাত দেবেন না।” বিজেপির পাশাপাশি এদিন সিপিএমকেও আক্রমণ করেন মমতা। তাঁর কথায়, ”বামফ্রন্ট সবথেকে বেশি অত্যাচার করে গিয়েছে। আমাদের খুন করতে দ্বিধাবোধ করেনি। তাঁরা এখন বড় বড় কথা বলতে শুরু করেছে। নরকঙ্কাল, পাসণ্ড, মানুষকে মেরে ফেলার দল। এদের মিথ্যা কথায় ভুলবেন না। মনে রাখবেন, সন্দেশখালিতে কোনও ঘটনা ঘটলে আমার কানে এক সেকেন্ডের মধ্যে আসে। কারণ আমি মানুষের পাহারাদারির কাজ করি।’ এদিন ‘সন্দেশখালি জিন্দাবাদ’ বলে নিজের বক্তব্য শেষ করেন মমতা।
• ১২৩ কোটি টাকা খরচে ৬৬টি প্রকল্পের উদ্বোধন
• উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় নতুন মহকুমা
• ঝুপখালিতে নতুন সেতুর নির্মাণ
• সন্দেশখালি গ্রামীণ হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা বৃদ্ধি
• সন্দেশখালিতে তৈরি হবে ‘সন্দেশের হাব’
• ২৬ জানুয়ারির পর থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিশেষ দুয়ারে সরকার ক্যাম্প