অভিনেতা, পরিচালক নারায়ণ রায় – বিশ্বাস করেন কাজই পরিচয়      

নিশীথ সিংহ রায়

সালটা তখন ২০০৩। সিনেমার পর্দায় চলছে মিঠুন চক্রবর্তীর সুপার-ডুপার হিট বাংলা ছবি ‘সন্ত্রাস’। অভিনেতা মিঠুনের মুখে গরমাগরম সংলাপ এবং গা হিম করা অ্যাকশনে মুহুর্মুহু করতালিতে ভরে যাচ্ছে সিনেমা হল। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের প্রেক্ষাগৃহ থেকে সন্ত্রাস সিনেমাটির সাফল্যের এই খবর যত আসছে ততই চওড়া হচ্ছে প্রযোজকের হাসি। বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং টেলি মিডিয়াতে আলোচিত হতে শুরু করে এই ছবিটির পরিচালকের নাম। সুখেন দাস, অঞ্জন চৌধুরী, স্বপন সাহা – এই সমস্ত নামী পরিচালক যারা কিনা বাংলার সাধারণ দর্শকদের জন্য সুন্দর সুন্দর সিনেমা তৈরি করে গেছেন, ঠিক তার পরবর্তী সময়ই চলে আসে সন্ত্রাস সিনেমা খ্যাত এই পরিচালক নারায়ন রায়ের নাম। বরানগরের কুঠি ঘাটে অবস্থিত নারায়ণ বাবুর বাড়িতে আমাদের আলাপচারিতায় উঠে আসে নারায়ণ বাবুর সুদীর্ঘ কর্মজীবনের নানা কথা।
পূর্ব নির্ধারিত দিন ও সময়মতো বরানগরের কুঠি ঘাটে নারায়ণবাবুর বাড়িতে পৌঁছতেই হাসিমুখে দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানালেন স্বয়ং নারায়ণবাবু। দীর্ঘদেহী সুদর্শন প্রায় সত্তরোর্ধ্ব নারায়ণবাবুর সাথে আলাপপরিচিতায় উঠে এল এক সংগ্রামী এবং সফল পরিচালক হয়ে ওঠার কাহিনী।

প্রতিবেদক : নমস্কার নারায়ণ বাবু এখন কেমন আছেন?
নারায়ণ: হ্যা, আপাতত ভালো আছি। মাঝখানে কিছুটা অসুস্থতা হয়েছিল তবে এখন কাজের জন্য পুরো ফিট মানে কাজে নামার জন্য ছটফট করছি।


প্রতিবেদক : আপনার শুরুর দিকটা যদি একটু বলেন?
নারায়ণ : দেখুন আমার জন্ম উত্তরবঙ্গের বালুরঘাটে।তবে তারপরেই আমরা এখানে চলে আসি, কারণ বাবার ট্রান্সফারের চাকরি ছিল ।আমরা এসে কুঠি ঘাটে বসবাস শুরু করি। আমার পড়াশোনা এই আমাদের পাশেই ভিক্টোরিয়া স্কুলে। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করি শ্যামবাজারের মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজ থেকে। ছোটবেলা থেকেই নাটক এবং তার সাথে গানের প্রতি একটা আকর্ষণ আমার ছিলই। প্রচুর নাটক করেছি পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন নাট্য সংস্থায়। আর গানও শিখেছি প্রায় দীর্ঘ পাঁচ সাত বছর। গান শেখার সাথে সাথে তবলা চর্চা শুরু করি ।তবলাও বাজাতাম একসময়। ঈশ্বরের আশীর্বাদেই বিভিন্ন নাট্যদল থেকে এই চেহারাটার জন্য অভিনয়ের অফার আসতে শুরু করে। এক সময় চুটিয়ে প্রচুর নাটক করেছি। প্রচুর নাট্য প্রতিযোগিতায় আমাদের দল অংশগ্রহণ করত এবং পুরস্কার হিসেবে যে টাকা পয়সা আমরা পেতাম সেটা দিয়ে আবার পরবর্তী নাট্য প্রযোজনার  জন্য প্রস্তুত হতাম। নাটকের অভিনয়ের পাশাপাশি ছোট থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান মঞ্চে সঞ্চালনার কাজ করতাম। এভাবেই একদিন হঠাৎ পরিচয় হয়ে গেল প্রখ্যাত পরিচালক অজয় বিশ্বাসের সাথে। পরিচালক অজয় বিশ্বাস আমার চেহারা দেখে আমাকে সিনেমায় অভিনয়ের জন্য উৎসাহ দেন। দূরদর্শনে রাজা সেনের পরিচালনায় শুরু হয় একটি সিরিয়াল ‘দেশ আমার দেশ’। সেখানে মিলন রায় চৌধুরী, দেবেশ চৌধুরী, অরিন্দম গাঙ্গুলী এরকম দিকপালদের সাথে আমিও একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করি। চরিত্রটির নাম ছিল উল্লাস কর দত্ত। কিছুদিনের মধ্যেই সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগও চলে আসে। শান্তনু ভৌমিক পরিচালিত ‘প্রত্যাঘাত’ এবং ‘প্রেম সংঘাত’ সিনেমা দুটিতে আমি অভিনয় করি। প্রত্যাঘাত ছবিটিতে আমার সহ অভিনেতা ছিলেন মুম্বাইয়ের বিশিষ্ট খলনায়ক শক্তি কাপুর। শক্তি কাপুরের সাথে অবশ্য আমি পরবর্তীকালে গুন্ডারাজ বলে একটি ছবিতেও অভিনয়ের সুযোগ পাই।

প্রতিবেদক : স্বাধীন পরিচালক হিসেবে আপনার প্রথম কাজ?
নারায়ণ : সে সময় দূরদর্শনে ‘করুণাময়ী বালিকা বিদ্যালয়’ নামে একটি সিরিয়াল শুরু হয়েছিল। যেটি পরবর্তীকালে আনন্দলোক উজালা এওয়ার্ডের জন্য বিবেচিত হয় এবং সেখানে সেরা সহ অভিনেত্রীর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য লিলি চক্রবর্তী পুরস্কৃত হন।পরিচালক স্বপন বসুর ‘উত্তরাধিকারী’তে আমি সহযোগিতা করি। পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর শেষের দিকের একটি সিনেমা ‘বাঙালি বাবু’ যেখানে মিঠুন চক্রবর্তী নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সেখানে আমি অঞ্জনদাকে নির্দেশনার ব্যাপারে বেশ কিছু সহযোগিতার সুযোগ পাই এবং পরবর্তীতে অঞ্জনদা আমাকে অনেক কাজের সুযোগও দিয়েছিলেন।

প্রতিবেদক: তারমানে আপনি এরপর থেকে শুধু সিনেমার কাজেই নিজেকে নিয়োজিত করেন?
নারায়ণ :  না না ঠিক এই একটা কথাই আমি আপনাকে বলতে চাইছিলাম। আমি মুম্বাই এবং কলকাতার বিভিন্ন প্রখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করতে থাকি এর সাথে সাথেই। ছন্দম বলে আমার একটি গ্রুপ ছিল, যেখান থেকে আমরা এই অনুষ্ঠানগুলো আয়োজনের ব্যবস্থা করতাম। সেই সময় বলিউড এবং টলিউডের প্রচুর নামকরা অভিনেতা গায়ক গায়িকাকে নিয়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠান করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল এবং অনুষ্ঠানের আয়োজক হিসেবে আমার একটা আলাদা পরিচিতিও সেই সময় গড়ে ওঠে।

প্রতিবেদক : নারায়ণবাবু আমরা আপনার পরিচালনায় বেশ কয়েকটি সিনেমার নাম ইতিমধ্যেই জেনেছি তবুও তার মধ্যে আপনার দৃষ্টিতে যেগুলি উল্লেখযোগ্য বলে আপনি মনে করেন একটু যদি বলেন।
নারায়ণ :  দেখুন সিনেমা পরিচালনা আমি বেশ কয়েকটি করেছি। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য যদি বলেন, মিঠুনদা কে নিয়ে আমার কাজের অভিজ্ঞতা। ‘সন্ত্রাস’ বলে একটি সিনেমায় মিঠুনদা নায়কের ভূমিকায় ছিলেন। পরবর্তীকালে ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ এবং ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি’ এই দুটি সিনেমাও আমার কাছে বেশ মনে রাখার মত কাজ। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ছবিটিতে অঞ্জন চৌধুরী অভিনয়ও করেছিলেন।

প্রতিবেদক : নারায়ণ বাবু বর্তমানে আপনাকে খুব বেশি ছবি পরিচালনার কাজে আমরা দেখতে পাচ্ছি না কেন?
নারায়ণ : দেখুন ছবি পরিচালনা করতে আমার ভালো লাগে এটা ঠিক। একই ভাবে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে টলিউড বলিউডের শিল্পীদের নিয়ে দর্শকদের সামনে হাজির হওয়ার মধ্যেও আমি আনন্দ খুঁজে পাই। কাজেই দুদিকের এই কাজে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে অনেক সময়ই ছবি পরিচালনার কাজ হাতে আসা সত্ত্বেও করে উঠতে পারিনি। তবে কিছুদিন আগেও কিডন্যাপ বলে একটি সিনেমা আমি পরিচালনা করেছি। আর সম্প্রতি একটি ছবির কাজ শেষ করলাম ক্রিমিনাল নেভার বর্ন।

প্রতিবেদক : আপনি এতদিন ধরে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছেন। মুম্বাই থেকে কাজের ডাক আসেনি কখনো?
নারায়ণ : একাধিকবার মুম্বাইতে কাজ করার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম কিন্তু এই বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা,  বাংলা সিনেমার কাজ এবং আমার ভালবাসার কাজ নাটক এই সব কিছুতে এত ব্যস্ত ছিলাম যে সুযোগ পেয়েও আমি মুম্বাই যেতে পারিনি। আরেকটি কথা এই প্রসঙ্গে আপনাকে জানানো উচিত বলে আমি মনে করি। আমি কিন্তু তদানীন্তন সি এম ডি এ বর্তমানে কে এম ডি এ তে একটি চাকরিও করতাম এবং চাকরির পূর্ন সময়টি আমি অতিবাহিত করেছি।

প্রতিবেদক : আচ্ছা নারায়ণবাবু আপনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছেন বহুদিন ধরে তা মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে কাজের কোন সুযোগ হয়েছে আপনার?
নারায়ণ : না সরাসরি মহানায়কের সাথে কাজ করার সুযোগ আমার আসেনি, কি পরিচালক কি অভিনেতা কোন দিক দিয়ে কাজের সুযোগ আমার আসেনি বা সৌভাগ্য হয়নি কিন্তু আমাদের এলাকায় নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ির আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন উপলক্ষে মহানায়কের সাথে আমার আলাপের সৌভাগ্য ঘটে। সেটা ১৯৭৭ সাল নাগাদ।

প্রতিবেদক : বাংলা সিনেমার বর্তমান প্রজন্মের অভিনেতাদের মধ্যে কার কার কাজ আপনার ভালো লাগে?
নারায়ণ : দেখুন বর্তমান প্রজন্মের দেব, জিৎ কিংবা অনির্বাণ ভট্টাচার্য এবং আরও অন্যান্য যারা রয়েছেন সবার কাজই আমার ভালো লাগে। তবে হ্যাঁ, যেহেতু আমরা একটু আগের প্রজন্মের তাই আমার কাছে প্রসেনজিৎ, মিঠুনদা এখনো অনেকের চাইতেই একটু বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকেন কিন্তু আমি মনে করি বর্তমান প্রজন্মের অভিনেতারাও আগামীতে ওনাদের তৈরি করা মাইলস্টোনে পৌঁছতে পারবেন।

প্রতিবেদক : বর্তমানে যে সমস্ত পরিচালক কাজ করছেন তাদের মধ্যে কাদের কাজ আপনার মনে রেখাপাত করেছে?
নারায়ণ : দেখুন এই মুহূর্তে বাংলা চলচ্চিত্রে অনেক পরিচালক কাজ করছেন। প্রত্যেকেই ভালো তবে আমার ভালো লাগে পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলী বা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের কাজ। এরা সত্যিই খুব ভালো কাজ করছেন। মনে রাখার মত কাজ করছেন।

প্রতিবেদক : বর্তমানে আমরা অনেক অভিনেতা এবং পরিচালককে দেখি কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। আপনি সেরকম কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করেন কি?
নারায়ণ : না না, আমি সেরকম কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যুক্ত নই। আমি মনে করি পরিচালক হিসেবে নিরপেক্ষ ভাবেই কাজ করে গেছি এবং আগামীতেও সুযোগ পেলে আমি সেই ধারাই বজায় রাখার চেষ্টা করবো।

প্রতিবেদক : নমস্কার। ভাল থাকবেন।
নারায়ণ : আপনাকেও নমস্কার সাথে দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ আমার জীবনী প্রকাশ করার জন্য।