একটানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত জনজীবন  ডিভিসির জলে গ্রামে প্লাবন

দুর্যোগ কমে গেলেও একটানা তিন দিন ভারি ও মাঝারি বৃষ্টিতে রাজ্যের কৃষি প্রধান পূর্ব বর্ধমান জেলার জনজীবন এখনও কার্যত বিপর্যস্ত। গ্রাম ও শহরে একই অবস্থা। অবিরাম বৃষ্টিতে জলমগ্ন  পূর্ব বর্ধমান জেলার বেশিরভাগ এলাকা। কোথাও ভেঙে পড়েছে মাটির বাড়ি, আবার কোথাও ধস নেমেছে রাস্তায়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ফসলের। রাজ্যের অন্যতম কৃষি প্রধান এই জেলায় চাষিরা ভয়াবহ বিপদের মুখে।

একদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষতি হয়েছে ভাতার এলাকায়। অন্যদিকে ডিভিসি জলাধার থেকে জল ছাড়তে শুরু করায় নতুন করে বন্যার আশংকা দেখা দিয়েছে পূর্ব বর্ধমানে। হু হু করে দামোদর নদের মাধ্যমে জল ঢুকতে শুরু করায় বন্যার আশংকা দেখা দিয়েছে জামালপুরে। মঙ্গলবার সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ পরিদর্শনে বের হন বিডিও পার্থ সারথি দে, পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ভূতনাথ মালিক, পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ মেহেমুদ খান। সকলকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা নেন তাঁরা। বেশ কয়েকটি গ্রামে সোমবার রাত থেকেই জল ঢুকতে শুরু করেছে। ব্লক প্রশাসনের উদ্যোগে তাঁদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার  তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এদিকে গুসকরা পৌরসভা এলাকায় সবচেয়ে বেশি সংকটে বাসিন্দারা। বেশিরভাগ ওয়ার্ডে কয়েকশো বাড়ি পুরোপুরি জলের তলায়। সকলকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এদিকে নিম্নচাপের বৃষ্টির ফলে বর্ধমান শহরের বেশ কিছু ওয়ার্ডে মঙ্গলবারও জল নামেনি। বেহাল নিকাশি ব্যবস্থার জন্য ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সকলে। বর্ধমান পৌরসভার বাসিন্দাদের অভিযোগ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ও ড্রেনের জল বাড়িতে ঢুকে আছে। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে তাঁদের। শহরের অতিরিক্ত জল বাঁকা নদীতে গিয়ে পড়ে। কিন্তু সেই বাঁকা নদী এখন জলে ভরে আছে। তার মধ্যে ডিভিসি জল ছাড়ার ফলে সেই জলে বাঁকা কোথাও কোথাও উপচে পড়ছে। সেই জলই নিচু এলাকাগুলোকে ডুবিয়ে দিয়েছে বলে দাবি অনেকেরই। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জেলার গুসকরা পৌরসভায়। বেশিরভাগ ওয়ার্ডে তিন দিনের বৃষ্টিতে জলমগ্ন। তার মধ্যে ৩ ,৪ এবং ১২ নং ওয়ার্ডের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। প্রায় পাঁচশো বাড়ি জলের তলায়। দুর্গতদের উদ্ধার করে ত্রাণ শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্লক প্রশাসন ও পৌরসভা যৌথভাবে কাজে নেমেছে বলে জানান চেয়ারম্যান কুশল মুখোপাধ্যায়। তবে ত্রাণ নিয়ে অনেকেই অভিযোগ জানিয়েছেন। গুসকরার পাশাপাশি আউশগ্রাম- ১ ব্লকের পরশুরামপুর, সিলুট, বসন্তপুর, বাঘরাই গ্রামগুলোতে বেশ কিছু কাঁচা বাড়ি ভেঙ্গে পড়েছে। বিডিও শেখ কামরুল ইসলাম জানান দুর্গত পরিবারের লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বর্ধমান শহরের কিছুটা দুরে বর্ধমানের বৈকুণ্ঠপুর – ২ অঞ্চলের চান্দাইপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বাঁকা নদী। যার পাড় ধরেই গ্রামের মানুষের যাতায়াত।


গ্রামের মানুষের যাতায়াতের জন্য বাঁকা নদীর পাড় ধরে তৈরি হয়েছে কংক্রিটের ঢালাই রাস্তা। গত তিন দিনের বৃষ্টিতে ধস নেমে সেই রাস্তা ভেঙ্গে গেছে। মানুষের যাতায়াতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। যেভাবে ধস নামছে, তাতে গোটা রাস্তাটাই বাঁকার গর্ভে চলে যেতে পারে বলে এলাকার মানুষের আশঙ্কা। এ নিয়ে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ওই রাস্তা দিয়ে আরও তিন চারটে গ্রামের লোকজন যাতায়াত করেন। ব্যাপক বর্ষণের ফলে গলসির বাহিরঘন্যার কাছে কাঠের সেতু খড়ি নদীর জলের তলায়। ফলে প্রায় দশটি গ্রামের লোকজনের যাতায়াত বন্ধ। ডিভিসি ও বাঁকা নদীর জলে গলসীর একাধিক গ্রামে আমন ধানের জমি সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। জল নেমে গেলেও ধান বাঁচানো সম্ভব নয় বলে হতাশ চাষিরা। অন্যদিকে বৃষ্টির জলে  কালনা পৌরসভার  বিভিন্ন এলাকা থেকে জল নামে নি। যার মধ্যে সব থেকে বেশি অসুবিধার মধ্যে পড়েছেন কালনা শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের যুগিপাড়া এলাকার মানুষজন। এলাকার রাস্তার পাশাপাশি রাস্তা পেরিয়ে বেশিরভাগ ঘরেই ঢুকেছে জল। এই সমস্যা শুধু এবারের নয়, বিগত কুড়ি বছরের উপর ধরে এই সমস্যায় ভুগছেন এলাকাবাসী, এমনটাই অভিযোগ করে পৌরসভার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সকলে। স্থানীয় মানুষ জানান, নিকাশি ব্যবস্থা ঠিক নেই এলাকায়। ঠিক মতন ড্রেন পরিষ্কার হয় না। তাই এই সমস্যা। জলের মধ্যে বিষধর সাপের উপদ্রব হয়, তার উপরে রয়েছে মশা। কার্যত জনজীবন বিপর্যস্ত। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুজয় সিদ্ধান্ত জানান, ড্রেন পরিষ্কার হয় না বিষয়টি ঠিক নয়, সপ্তাহে আগে তিন দিন পরিষ্কার করা হতো, এখন বিকেলেও এই এলাকা পরিষ্কার করা হবে।

অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে গলসীর জাগুলিপাড়ায় একটি মাটির দোতলা বাড়ি ভেঙ্গে পড়েছিল।  আউশগ্রাম ব্লকের রামচন্দ্রপুরে মাটির দেওয়াল চাপা পড়ে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। মৃত মহিলার নাম বেনু রুইদাস। বাড়ির বারান্দায় বসে রান্না করছিলেন তিনি। সে সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে বর্ধমান জেলার অধিকাংশ গ্রামেই চাষের জমি জলে ডুবে গেছে। জামালপুর পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ভূতনাথ মালিক বলেন এখানকার বেশিরভাগ ধান জমি জলের তলায়। কতটা কি ক্ষতি হবে সেটা পড়ে জানা যাবে। এরই মধ্যে জামালপুর- ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ প্রধান সাহাবুদ্দিন মন্ডল বাড়ি বাড়ি ঘুরে খোঁজ খবর নিয়ে ত্রিপল অনান্য সামগ্রী দিচ্ছেন। ডিভিসির জলে যে সব এলাকায় সমস্যা দেখা দিতে পারে সেই সব দামোদর নদ সংলগ্ন এলাকায় সকলের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলেছেন জামালপুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ মেহেমুদ খান। দামোদর নদ লাগোয়া এলাকার রায়না ২ ব্লকের চাষিরা এই অবিরাম বৃষ্টিতে তাঁদের চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে  বলে দাবি করেন। এখানকার দেবখাল দীর্ঘ বছর ধরে সংস্কার হয়নি। ফলে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই খাল উপচে সেই জল জমিতে জমে যায়। জেনো, আদমপুর, বড় বৈনান সহ গ্রামের চাষিরা এখন ফসল পচে যাবার আশংকা করছেন।

বামুনিয়া হিজলনা অঞ্চলে ফি বছরই এ সময়ে বিঘের পর বিঘে জমিতে সবজি চাষ হয়। দামোদর নদের পাড় বরাবর এই সব এলাকায় সবজির জমি পুরোপুরি জলের তলায়। এলাকার এক চাষি ফজলে রাব্বি ফারুকী বলেন মাঠে পটল,করলা, ঝিঙে সহ সব সবজির মাচা ভেঙ্গে গেছে। আর কোন ভাবেই ফসল বাঁচানোর সম্ভাবনা নেই। শুধুমাত্র রায়না, খন্ডঘোষ ব্লকই নয়, কাটোয়া,কালনা, জামালপুর,মেমারিতে এই সময় কাঁচা আনাজের চাষ করে এক শ্রেনীর চাষিরা কিছুটা আয় করেন। খেতমজুররা কাজ পেয়ে থাকেন। কালনাতে এই দুর্যোগে ফুলকপির চাষ মার খেল। জেলার সহ কৃষি আধিকারিক পার্থ ঘোষ স্বীকার করেন বৃষ্টির জলে যে ভাবে আনাজের জমিতে জল জমেছে তাতে ক্ষতিটা ঠেকানো যাবে না। অন্যদিকে একরের পর একর জমি জলের তলায় তলায় চলে যাওয়ার ফলে ফসল উদ্ধারের কোন সম্ভাবনা নেই বলে চাষিরা জানিয়েছেন। আবার এ ভাবে জমি জলে ডুবে থাকলে ধান গাছেরও ক্ষতি হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন চাষিরা। ওই সব এলাকার ফসল ও সবজি বর্ধমান শহরের বিভিন্ন বাজারে  যোগান দেওয়া হয়। ফলে ঘাটতি হতে পারে বলে আশংকা। এরই মধ্যে তার প্রভাব পড়েছে মঙ্গলবার। বেশ কয়েকটি সবজির দাম বাড়তে শুরু করেছে।

এই গ্রামগুলির পাশাপাশি পূর্ব বর্ধমানের পৌরসভা এলাকাগুলোতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় সকলকে। কালনা, কাটোয়া, গুসকরা, মেমারি পৌরসভার নিচু এলাকাগুলোতে জল জমে থাকার খবর মিলেছে। গত তিন দিনের বৃষ্টির ফলে শহরের রাস্তা এতটাই খানা খন্দে ভরেছে যে যানবাহন চলাচলে চরম সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশ্বকর্মা পুজোয় মঙ্গলবার সব দোকানপাট খোলা থাকলেও বেচাকেনার অবস্থা খারাপ বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। একই অবস্থা শহর বর্ধমানে। শহরের মূল কেন্দ্র বিসি রোড, তেঁতুলতলা বাজার,জিটি রোডের একাংশ ব্যাবসা কেন্দ্র ফাঁকা। গত তিন দিনে গ্রামের লোকজন খুব একটা শহর মুখি হতে পারেন নি। বর্ধমানের অন্যতম মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী প্রসেনজিৎ দত্ত বলেন দুর্যোগ এর বাড়তি লোক না আসায় বেচাকেনা তলানিতে। এমনিতেই শহরে বাস চলাচল অনেক আগেই বন্ধ। ফলে গ্রামীণ মানুষের সংখ্যা কমেছে শহরে। তারপর এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তারা আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিশ্বকর্মা পুজো থাকায় দু একদিন আগে বাজারে কেনাকাটা শুরু হয়। কিন্তু এবার অবিরাম বৃষ্টিতে সেই বেচাকেনাও এক প্রকার বন্ধ।