উৎসবের আবহে বন্যা কবলিত মানুষকে না ভোলার বার্তা দিলেন মমতা

বৃষ্টি ও ধসের জেরে বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গ। নেপালের বন্যার জেরে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে প্লাবনের। এই পরিস্থিতিতে রবিবার শিলিগুড়িতে প্রশাসনিক বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্লাবনের এই আশঙ্কার মাঝে উত্তরবঙ্গে কী রকম প্রস্তুতি রয়েছে তা খতিয়ে দেখেন তিনি। বৈঠক শেষে উত্তরকন্যা থেকে সাংবাদিক বৈঠক করে বন্যা কবলিত মানুষকে ভুলে না যাওয়ার বার্তা দেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি প্রতিটি দপ্তরকে নিজেদের কাজ বুঝিয়ে দেন তিনি। এদিন শিলিগুড়িতে যাওয়ার আগে দক্ষিণবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ফের কেন্দ্রকে তোপ দাগেন মমতা।  তিনি বলেন, ‘কেউ খবরও নেয়নি, এক পয়সাও দেয়নি। বাংলাই একমাত্র বন্যার অর্থ থেকে বঞ্চিত।’

উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে কোথায় জল রয়েছে, কোথায় নেই, প্লাবনের জেরে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে, কী কী প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এই নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। পাশাপাশি ছিলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ এদিন মমতা জানান, ছয় জেলায় দুজন করে সচিব পর্যালয়ের আমলা থাকবেন। তিনি বলেন, ‘ওই সচিবেরা সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করবেন। কোথাও সমস্যা হলে আমাদের জানাবেন, সেই অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।’

মমতা এদিন আরও বলেন, ‘এক দিকে পুজো। অন্য দিকে বন্যার ফাঁড়া। প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের পাশে থাকতে হবে। পুজো বলে বন্যা ত্রাণের কাজে মানুষের পাশ থেকে সরে গেলে হবে না। এটিও একটি সেবা। বন্যাত্রাণে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।’ পাশাপাশি মমতা কৃষকদের উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি তিনি জানান, শস্য বিমা আবেদনের সময়সীমা ৩১ সেপ্টেম্বরের বদলে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।


এদিন শিলিগুড়ি থেকেও কেন্দ্রকে দুষলেন মমতা। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার বন্যায় আমাদের এক পয়সাও দেয় না। যদিও বন্যা নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কেন্দ্রের অধীনে। ফারাক্কা বাঁধও ড্রেজ়িং করা হয় না। ঠিক মতো ড্রেজ়িং করলে ফরাক্কা বাঁধে আরও জল জমা রাখতে পারত। সেই কারণে বিহারও ডোবে, বাংলাও ডোবে। ড্রেজ়িং করা হলে আরও ৪ লক্ষ কিউসেক জল ধারণ করতে পারত। তা হলে এই জায়গাগুলি অনেকটা কম ভুগত।’ এদিন মমতা গঙ্গা পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করে দেন। পাশাপাশি বন্যা কবলিত এলাকায় বাসিন্দাদের কয়েকদিন ত্রাণ শিবিরে গিয়ে বসবাস করার পরামর্শ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘দয়া করে কষ্ট করে কয়েকটা দিন ত্রাণ শিবিরে থাকুন। জীবন থাকলে বাড়িও বাঁচবে। কিন্তু জীবন চলে গেলে, শুধু বাড়ি থেকে কোনও লাভ নেই। একটি জীবন খুব দামি।’

রবিবার গজলডোবায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত চারজনের পরিবারের একজনের হাতে ৫ লক্ষ টাকা এবং আর এক জনের হাতে ৩ লক্ষ টাকার চেক তুলে দেন মমতা। পাশাপাশি ভুতনিতে নৌকাডুবি হয়ে মৃতদের পরিবারের হাতেও ২ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সাহায্য তুলে দেওয়া হয়। সম্প্রতি শিলিগুড়ির বিধানমার্কেটে আগুন লেগেছে। এই আগুনে ৬টি দোকান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দোকানের ব্যবসায়ীদের ১ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মমতা। পাশাপাশি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দেওয়া হবে ৫০ হাজার টাকা।
উল্লেখ্য, ডিভিসি-এর ছাড়া জলে বানভাসি হয়েছে দক্ষিণবঙ্গ, এই অভিযোগ তুলে পূর্বেই ‘ম্যান মেড বন্যা’র তত্ত্ব খাঁড়া করেছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। দক্ষিণবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুরে পাড়ি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়েই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভপ্রকাশ করেছিলেন। এই আবহে উত্তরবঙ্গের বন্যা-পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে রবিবার দুপুরে রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরে পাড়ি দেন মমতা। উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ফের একবার কেন্দ্র সরকারকে নিশানা করেন তিনি।
এদিন উত্তরে পাড়ি দেওয়ার আগে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগে মমতা বলেন, ‘আজ বিশ বছর হয়ে গিয়েছে ফারাক্কা ব্যারাজ ড্রেজিং করে না কেন্দ্র। সেই কারণে পলি জমে গিয়েছে। ফলে ওই ব্যারাজে জলধারণের ক্ষমতা কমেছে। নিয়মিত ড্রেজিং করানো হলে ফারাক্কা জল ধরতে পারতো এবং মালদা, সুতিতে বন্যার আশঙ্কা কম থাকতো। কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেটা করেনি। আগে কেন্দ্র ফারাক্কা ব্যারাজের ১২০ কিলোমিটার দেখভাল করতো, এখন সেটা কমিয়ে ২০ কিলোমিটারে এসে গেছে। কিছুই করা হয় না! পুরো উত্তরবঙ্গ ভাসছে। শুধু নির্বাচনের সময় আসবে, আর বড় বড় কথা বলে চলে যাবে।’ রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে কোনও রকম সাহায্য মেলেনি বলেও অভিযোগ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের। এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কেউ খবরও নেয়নি, এক পয়সাও দেয়নি। বাংলাই একমাত্র বন্যার অর্থ থেকে বঞ্চিত।’
উত্তরবঙ্গের বন্যা-পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আরও একবার কেন্দ্রকে দুষে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দক্ষিণবঙ্গ যেমন ডিভিসি-এর জলে ভেসেছে, তেমনই উত্তরবঙ্গ ভেসেছে নেপাল থেকে কোশী নদীর ছাড়া জলে, যার পরিমাণ ৫ লক্ষ কিউসেক টন।’ এরপরই গোটা উত্তরবঙ্গের বেহাল পরিস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘একদিকে সঙ্কোচ নদীর জলে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার প্লাবিত।অন্যদিকে, নেপালের ছাড়া কোশী নদীর জল বিহার হয়ে বাংলায় প্রবেশ করতে শুরু করেছে। যার জেরে মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ দিনাজপুরে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।’ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ-প্রশাসনের তৎপরতার প্রভূত প্রশংসা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
শনিবার রাতেই মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে পুলিশ মাইকিং করে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে এনেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায়, ‘পুলিশ যথেষ্ট ভালো কাজ করেছে। জনগণকে সতর্ক করা থেকে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, সবই যথা সময়ে হচ্ছে।’ প্রবল বৃষ্টির কারণে উত্তরবঙ্গের একাধিক নদীর জলস্তর বেড়েছে। পাড় উপচে জল রাস্তায় চলে এসেছে কোথাও কোথাও। দার্জিলিং, কালিম্পং-সহ পাহাড়ি এলাকায় ধস নেমেছে। যার জেরে বিপর্যস্ত জনজীবন। বন্যার পাশাপাশি ধস-বিদ্ধস্ত পাহাড়ি এলাকার পরিণতির প্রসঙ্গও বৈঠকের আলোচ্য বিষয়, জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রবিবার সকালেই উত্তরবঙ্গে পৌঁছেছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। তারপর জলপাইগুড়ি জেলাশাসককে সঙ্গে নিয়ে পরিদর্শন করেছেন গজলডোবা ব্যারাজের পরিস্থিতি। এরপর রবির দুপুরেই উত্তরবঙ্গ পাড়ি দেন মমতা বন্দোপাধ্যায়।