রাজ্যে গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১১ জোন। ফলে এই রাজ্যে করোনা অ্যাক্টিভ রোগির সংখ্যা দাঁড়াল ৪৯। পাশাপাশি গত ২৪ ঘন্টায় একজনেরও মৃত্যু হয়নি। শনিবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে এই পরিসংখ্যান দিলেন মুখ্যসচিব রাজীব সিন্হা।
করোনা আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ফারাক, করোনায় নিজামুদ্দিন যোগের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি যাবতীয় বিতর্কের মধ্যে সবচেয়ে স্বস্তির খর করোনা মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে থাকা। যার নেপথ্যে রাজ্য সরকারের সদর্থক ভূমিকার উল্লেখ করে মুখ্যসচিব। এদিন প্রত্যয়ী সুরে বলেন, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা জয়ী হবই।
শনিবার নবান্নে তিনি বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দিলেন করোনা মোকাবিলায় রাজ্যের পক্ষ থেকে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাঁর কথায়, এই মুহূর্তে রাজ্য সরকারের মূল লক্ষ্য দুটি। প্রথমটি হল করোনা প্রতিরোধে রাজ্যের চিকিৎসা পরিষেবাকে প্রস্তুত রাখা। অন্যটি লকডাউনকে সার্বিকভাবে সফল করে তুলতে সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া।
মুখ্যসচিব শনিবার করোনা আক্রান্তের পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়ে দেন রাজ্যে গত চবিশ ঘন্টায় যতজন আক্রান্ত হয়েছেন তার মধ্যে কালিম্পং-এর একটি পরিবারেরই ৬ জন রয়েছেন। বাকিরা এসেছেন বিভিন্ন জায়গা থেকে। তবে গত চব্বিশ ঘন্টায় একজনেরও করোনায় মৃত্যু হয়নি।
এদিন মুখ্যসচিব আবারও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, রাজ্যে এখনও পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। তবে আগামী কয়েক সপ্তাহে বৈজ্ঞানিক এবং প্রাকৃতিক কারণেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে। তাই করোনা প্রতিরোধে রাজ্য সবরকম ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানিয়ে দেন রাজ্যের মুখ্যসচিব।
এই মুহুর্তে করোনা মোকাবিলায় রাজ্যে মোট সাতটি পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে বেলেঘাটার নাইসেড, পিজি, স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিন, উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল এবং মেদিনীপুর জেলা হাসপাতাল নিয়ে মোট পাঁচটি সরকারি কেন্দ্র। বাকি দুটি বেসরকারি কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে অ্যাপোলো এবং টাটা মেডিকেল সেন্টার। তবে আরও পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেজন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে।
মুখ্যসচিব জানান, করোনায় চিকিৎসার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত রয়েছেন তাদের জন্য এ পর্যন্ত ১ লক্ষ ৮০ হাজার ৫০০’টি পিপিই দেওয়া হয়েছে। এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক দেওয়া হয়েছে ৬৫ হাজার। এছাড়া টু লেয়ারড, থ্রি লেয়ারড মাস্ক দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজারের মতো। এখনও পর্যন্ত ৩৩,৬০০ লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেওয়া হয়েছে।
রাজীব সিনহার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজ্যে এখন পর্যন্ত কলকাতার ৪’টি এবং বিভিন্ন জেলায় ৪৫’টি হাসপাতালকে কোভিড় ১৯ চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। রাজ্যে সরকারি (৪৩২) ও বেসরকারি (৮৪) মিলিয়ে মোট ৫১৬’টি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার রয়েছে। হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছে ৫২ হাজার ৮০ জন। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩৬ জন হোম কোয়ারেন্টাইন থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এ পর্যন্ত ১০৪০ জলের করোনা পরীক্ষা হয়েছে। ভবিষ্যতে আইসিএমআর-এর নির্দেশিকা মেনে করোনা চিকিৎসাকে অ্যাপ নির্ভর করা যায় কিনা সেই বিষয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে।
করোনা সন্দেহে কোনও রোগি এলে তার আইসোলেশনের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে সেই বিষয়েও স্বাস্থ্য দফতর হাসপাতালগুলিকে নির্দেশিকা পাঠিয়েছে। এছাড়া সিভিয়র অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইলনেস (সারি) চিকিৎসার জন্যও প্রত্যেকটি সরকারি হাসপাতালকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তবে লকাডাউনকে মানতে হবে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে।
মুখ্যসচিবের সঙ্গে একই সুরে সুর মিলিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ডা. অভিজিৎ চৌধুরী এদিন বলেন, এই মুহূর্তে যেসব করোনা রোগি চিকিৎসাধীন, তারা কেউই আশঙ্কাজনক অবস্থায় নেই।
বেলেঘাটা আইডিতে যে ২৪ জন ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে দু’জনের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তারদের কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যাঁরা অন্যান্য অসুখে ভুগছেন অর্থাৎ যাঁদের কো-মরবিডিটি আছে তারা ছাড়া করোনা চিকিৎসা তেমন একটা কঠিন নয়। এমনকী এক্ষেত্রে হাইড্রোক্সি ক্লোরোকুইন ট্যাবলেটও প্রয়োগ করা এমনকী সবক্ষেত্রে ভেন্টিলেশনে দেওয়ারও দরকার পড়ছে না।
তবে ডা. অভিজিৎ চৌধুরী জানিয়ে দেন এজন্য ডাক্তাররা অবশ্য মোটেও করোনা চিকিৎসাকে হাল্কাভাবে দেখছেন না। তবে করোনায় যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের অনেকেই ডায়াবেটিস, রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস, হাইপারটেনশন ইত্যাদি অসুখে ভুগছিলেন। তাই যাঁদের অন্য অসুখ রয়েছে কিংবা বয়স একটু বেশির দিকে তাদের সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেন অভিজিৎবাবু।
এদিকে রাজ্যে করোনা নিয়ে নবান্ন’র দেওয়া পরিসংখ্যানের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের দেওয়া পরিসংখ্যানের ফারাক নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। রাজ্য সরকার বলছে শনিবার নতুন করে ১১ জন আক্রান্ত নিয়ে করোনা অ্যাক্টিভ রোগির সংখ্যা ৪৯ জন। সেখানে শনিবার সকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রকের বুলেটিনে বলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ জন। এদিকে গত দু’দিন ধরে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরও বুলেটিন দেওয়া বন্ধ করেছে। এক্ষেত্রে রাজ্য না কেন্দ্র কার দেওয়া পরিসংখ্যান সঠিক বলে ধরা হবে?
সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যসচিব বলেন, আমাদের সংখ্যা দেখবেন নাকি ওদেরটা (কেন্দ্রীয় সরকারের) মানবেন সেটা আপনাদের বিষয়। তাহলে কি কেন্দ্রীয় সংখ্যা রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখাচ্ছে? এজন্য কি রাজ্যের তরফে কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলা হবে? এই প্রশ্নের জবাবে মুখ্যসচিব জানিয়ে দেন, আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে বা বাড়িয়ে দেখানো কোনও বিষয় নয়। কেউ কমিয়ে বা বাড়িয়ে দেখাচ্ছে বলে মনে করি না। রাজ্যের তথ্য দেওয়ার বিষয়ে কোনও ঘাটতি থাকছে কিনা খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়ে দেন মুখ্যসচিব।
এদিকে শনিবার কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের তরফে এক বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে হলদিয়া বন্দরের এক কর্মী করোনায় আক্রান্ত, যার সঙ্গে নিজামুদ্দিন যোগ রয়েছে। এই রোগির ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার কি বিশেষ কোনও পদক্ষেপ নেবে?
উত্তরে ওই আক্রান্তের নিজামুদ্দিন যোগের প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়ে মুখ্যসচিব বলেন, রাজ্যের সব করোনা আক্রান্ত রোগির ট্র্যাভেল হিস্ট্রি নিয়ে নজরদারি করা রাজ্যের কাজ নয়। কেউ বিদেশ থেকেই আসুন কিংবা ভিনরাজ্য থেকে, রাজ্য সরকারের মূল অ্যাকশন পয়েন্ট হল কোনওভাবে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকলে কিংবা সেই আক্রান্তের সংস্পর্শে কেউ এলে তাদের কোয়ারেন্টাইনে সেন্টারে ভর্তি করা। কিংবা ক্ষেত্র বুঝে হোম আইসোলেশনে পাঠানো।
মুখ্যসচিব এদিন জানান, পূর্ব মেদিনীপুরের এক করোনা আক্রান্তের খবর পাওয়ার পর তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে ওই ব্যক্তি যাঁদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাদেরও সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে।