তিনি ছিলেন এক বর্ণময় রাজনীতিক। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মিলিয়ে দিলেন লাল সবুজ গেরুয়া সব রাজনৈতিক রঙকে। আরক্ত হয়ে উঠলেন রাগে অনুরাগে। এক ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুললেন খেলার মাঠ থেকে রুপোলি পর্দার সব তারকা আলোকে।
শুক্রবার রবীন্দ্রসদনে রাখা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নিথর শরীরটা যেন জানিয়ে দিল আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে পিস ওয়ার্ল্ডে শায়িত ছিল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দেহ। যা রবীন্দ্রসদনে এসে পৌঁছল সকাল ৯-৫১ মিনিটে।
আগে থেকেই সাজিয়ে রাখা এক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সদাহাস্যময় মুখের ছবির সামনে রাখা হল চন্দনে আর লাল পাঞ্জাবিতে সাজানো তার প্রাণহীন শরীরটা। মৃদু স্বরে বেজে চলেছে একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত। রাশি রাশি ফুলের স্তুপে নিমেষে ঢেকে গেল শরীরটা। শোক বোধহয় সব বৈরিতার অবসান ঘটায়। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের শেষ যাত্রায় সেকথাই প্রকট হল।
শুক্রবার রবীন্দ্রসদনে বেলা দুটো পর্যন্ত যাঁরা সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে যাঁরা এসেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ডান-বাম, শাসক-বিরোধী, ঘটি-বাঙাল, অনুগামী-অনুরাগী, সাধারণ থেকে সেলিব্রিটি সক্কলে।
বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য বললেন, পাঁচ দশক ধরে শরীর-মন দিয়ে রাজনীতিকে ছুঁতে পেরেছিলেন। বিরোধী রাজনীতিকদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রাখতেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে ‘রাজনৈতিক মেসি’ আখ্যা দিয়েছিলেন শমীক ভট্টাচার্য।
অত্যন্ত রসবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। এদিন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে রবীন্দ্রসদনে এসেছিলেন। কেন্দ্রীয়মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক, মেদিনীপুরের সাংসদ দিলীপ ঘোষ, জিতেন্দ্র তেওয়ারি, রাহুল সিন্হা সকলেই।
একসময় সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক সঙ্গী আব্দুল মান্নান, প্রদীপ ভট্টাচার্যরাও এদিন রবীন্দ্রসদনে এসে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন। কেউই সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের এই আকস্মিক মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছেন।
প্রিয়-সোমেন-সুব্রত এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের শেষজনের বিদায় তাঁদের কাছে একটা অধ্যায়ের যতিচিহ্ন। বামফ্রন্টের অশোক ভট্টাচার্য শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, রাজনৈতিক লড়াই থাকলেও সুব্রতবাবুর সঙ্গে কখনও সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। একই কথা বললেন বিমান বসুও। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে রায়দিঘি থেকে ছুটে আসেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়।
বিধানসভায় সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের উল্টোদিকে আসনে বসা প্রাক্তন মন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, সুজন চক্রবর্তী, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রমুখ বামফ্রন্টের প্রথম সারির নেতারাও এদিন অন্তিম বিদায় জানাতে রবীন্দ্রসদনে এসেছিলেন।
শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন পিডিএস নেতা সমীর পুততুণ্ডও। বিরোধী নেতাদের পাশাপাশি শাসক দলের সতীর্থরাও এদিন রবীন্দ্রসদনে শোকজ্ঞাপন করেন। কংগ্রেস থেকে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গী সব্রত বক্সি। মাঝে দল বদল হলেও তাদের বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি।
বন্ধুকে শেষ বিদায় জানানোর সময় চোখে জল সুব্রত বক্সির। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। মালা রায়, অতীন বোস, সাংসদ সুদীপঢাকা দেহের পাশে বন্দ্যোপাধ্যায়, শশী পাঁজা, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য সকলেই এদিন রবীন্দ্রসদনে শোকাহত অবস্থায় বসেছিলেন।
শুধু রাজনীতির আঙিনাতেই নয়, সমাজের নানা ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণ ছিল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। তিনি ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের সহ সভাপতি। সবুজ-মেরুনের অতীতের দিকপালদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। এদিন তাই প্রিয় ‘দাদা’কে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন প্রাক্তন ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্য।
সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মরদেহে জড়ানো হয় মোহনবাগানের পতাকা। মোহনবাগানের সচিব সৃঞ্জয় বোস বলেন, ওঁকে সবসময় পাশে পেয়েছি। রাজনীতিতে পথ হাঁটলেও তার বাইরে সংস্কৃতির জগতেও তার অবাধ বিচরণ ছিল।
আশির দশকে মুনমুন সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে ‘চৌধুরী ফার্মাসিউটিক্যালস’ নামে একটি টেলি ধারাবাহিকে মুনমুন সেনের সাহসী অভিনয় করেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় ‘বন্ধু’র মৃত্যুতে শোকবিহ্বল মুনমুন সেন সরু পাড় সাদা শাড়ি পরে, সাদা ফুলের তোড়া হাতে এদিন ছুটে আসেন রবীন্দ্রসদনে। কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে চোখের জলে বিদায় জানান সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে।
আবার এদিন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন ভারত সেবাশ্রমের মহারাজরাও। সব মিলিয়ে শুক্রবার রবীন্দ্রসদনে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মরদেহ জানান দিয়েছিল, মৃত্যুর পারে এসেই সব সীমারেখা মুছে যায়।