এনআরসি-ক্যাব করলে আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে করুন : মমতা

এনআরসি-ক্যাবের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। (Photo: IANS)

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ যেভাবে পথে নেমেছিলেন, স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশভাগ রুখতে মহাত্মা গান্ধি যেরকম জীবন বাজি রাখার কথা বলেছিলেন- মহাজ্ঞানী, মহাজনদের সেই পথেই হাঁটলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সােমবার রাজপথে নেমে এনআরসি-ক্যাবের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তৃণমূল সুপ্রিমাে। হুংকার দিয়ে বলেন, এই রাজ্যে এনআরসি-ক্যাব আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে করতে হবে। সরকার ফেলে দিলেও আন্দোলনের পথ থেকে সরবেন না বলে জানিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

পূর্বঘােষিত সময়মতাে সােমবার বেলা ঠিক একটায় সংবিধানের স্থপতি বাবাসাহেব আম্বেদকরের মূর্তি থেকে এনআরসি-ক্যাব-এর বিরুদ্ধে পথ হাঁটা শুরু করেন তৃণমূল নেত্রী। সেই মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে কয়েক হাজার মানুষের ভিড়। ভিড়ের চেহারাই বলে দিচ্ছিল, সেখানে নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের মানুষের সমাবেশ। ভিড়ের মধ্যে শুধু তৃণমূলের প্রতীকী পতাকাই নয়, অনেক বেশি করে উড়েছে জাতীয় পতাকা।

বুকের কাছে আঁকড়ে ধরা প্ল্যাকার্ডে নানান বিপ্লবী স্লোগান। ‘অসাংবিধানিক নাগরিক সংশােধনী আইন মানছি না, মানব না’, ‘বেঙ্গল স্ট্যান্ডস ইউনাইটেড, ইন্ডিয়া উইল বি ইউনাইটেড’, ‘রেডি টু ডাই, বাট নট রেডি টু অ্যাকসেপ্ট ক্যাব’ ইত্যাদি স্লোগানগুলিই এদিন হয়ে ওঠে তৃণমূল নেত্রীর ডাকা গণআন্দোলন আহ্বানবাণী, প্রতিবাদের ধ্বনি। বাংলার মাটি থেকেই জন্ম হয় গণআন্দোলনের। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, ডেপুটি মেয়র অতীন ঘােষ, সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায় সকলেই এদিন মিছিলে পথ হেঁটেছেন দলীয় কর্মী হিসেবে, সাধারণ প্রতিবাদী নাগরিক হিসেবে।


মহামিছিল শুরু করার আগে শপথ পাঠ করান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সবাই উচ্চারণ করে, ‘আজকের শপথ, আমরা সবাই নাগরিক। সর্ব ধর্ম সমন্বয় আমাদের জীবন আদর্শ। কাউকে বাংলা ছাড়তে দেব না। নিশ্চিন্তে থাকব, শান্তিতে থাকব। বাংলায় এনআরসি ও ক্যাব করতে দিচ্ছি না, দেব না। শান্তি বজায় রাখতে হবে’।

এদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিছিলে যােগ দেওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। মাথার ওপরে সূর্য ততটা প্রখর তাপ ছড়ায়নি। মিছিলের পথে কলেজস্ট্রিট অঞ্চলে জ্বলন্ত টায়ারের আগুনটা তখনও মরে আসেনি। তবে মিছিলকে শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য পুলিশ ছিল তৎপর। ক্রমশ মিছিল দীর্ঘ দীর্ঘ হতে থাকে। অহিংস আন্দোলনের জনক গান্ধিমূর্তিকে স্পর্শ করে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে এগিয়ে চলে জোড়াসাঁকোর দিকে। বিজেপির সদর দফতরের কাছে এসে সেই মিছিল কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। গেরুয়া কার্যালয়ের সামনে তুমুল বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তৃণমূল কর্মীরা। মিছিলের পথ হাঁটা শেষ হয় রবীন্দ্রনাথের পায়ের চিহ্ন বিজড়িত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে।

সেখানে প্রথমে সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এনআরসি ও ক্যাবের বিরুদ্ধে জননেত্রী তথা ‘দেশনেত্রী’র সুরে সুর মিলিয়ে সকলকে আন্দোলনের জন্য আহ্বান জানান। এরপর তৃণমুল নেত্রী রবীন্দ্রনাথের বাংলার মাটি, বাংলার জল গান… এক হউক, হউক…’ গানের বাণীরই প্রতিধ্বনি করে বলেন,– আমাদের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ নেই, আমরা ভাগাভাগি করি না। ধর্ম যার যার, বাংলা সবার, দেশ সবার, সংবিধান সবার। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি সংলগ্ন অঞ্চলে এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের মধ্যে হিন্দি ভাষার আধিক্য শােনা যায়।

মমতা মােদি সরকারকে আক্রমণ করে বলেন, বিজেপি পার্টি ক্ষমতায় এসে নিজেদের ‘আসমান সে ভি উঁচা’ ভাবছে। কে নাগরিক আর কে নয়, সে কি তারা বেছে দেবে? বিজেপি চায়, হিংসা হােক, আর ওরা তার ফায়দা নেবে। তিনি সবার কাছে আবেদন করেন, ট্রেনে আগুন জ্বালাবেন না। পােস্ট অফিসে আগুন ধরাবেন না। রাস্তা অবরােধ করবেন না। তাহলে যারা আমাদের সমর্থন করছে, তাদেরকে আঘাত করা হবে। মমতা বলেন, কেউ কেউ বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছে । তাদের কাছে আবেদন ভুল পথে যাবেন না । কেউ ভয় দেখালেও ভয় পাবেন না।

এনআরসি এবং ক্যাবের প্রতিবাদে বাংলায় যে বিচ্ছিন্ন অশান্তির ঘটনা ঘটছে, সেজন্য এদিন বিজেপি সাংসদ দিলীপ ঘােষ নেত্রীকে সাবধান করে মন্তব্য করেছেন, ‘বাংলার যে আন্দোলন হচ্ছে তা সামাল দিতে পারছেন না মুখ্যমন্ত্রী’। সেই আক্রমণের বিরুদ্ধে নেত্রী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন, এই রাজ্যকে সামলানাের জন্য বিএসএফ, সিআরপিএফ লাগবে না। রাজ্য পুলিশই পরিস্থিতি সামলে দেবে। তবে দেশজুড়ে এনআরসি আর ক্যাবের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার তা সামাল দিতে পারবে তাে?

বস্তুত এনআরসি আর ক্যাব-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রথম ধ্বনি তুলেছিল তৃণমূলই। সেই একলা চলাে’র পথে এখন গােটা দেশের অনেক রাজ্যই সামিল। তৃণমূল নেত্রী বলেন, আজ আর আমরা একা নই। বিহার, উত্তরপূর্ব ভারত, পাঞ্জাব, ছত্তিশগড়, কেরল, মধ্যপ্রদেশ রাজ্যগুলােও আমাদের পাশে রয়েছে।

নেত্রী এদিন ঘােষণা করেন, যতক্ষণ এই লড়াইকে শুধু সংখ্যালঘুদের লড়াই বলে ভাববেন না। এটা সর্বধর্ম সমন্বয়ের লড়াই। বিভেদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার লড়াই। জানিয়ে দেন, যতক্ষণ না ক্যাব, এনআরসি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ততক্ষণ শান্তিপূর্ণ পথে এই লড়াই চলবে। মমতা ধ্বনি তােলেন, কালা কানুন বাতিল কর, ক্যাব-এনআরসি নেহি চলেগা- জনতা প্রতিধ্বনি করে ওঠে বাতিল কর, বাতিল করাে। নেই চলেগা, নেই চলেগা।