বিভীষিকার বগটুই, রাজধর্ম পালনে মানবিক মমতা রাফ অ্যান্ড টাফ

বগটুইয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Photo:SNS)

ক্ষোভে ফুটছে বগটুইয়ের স্বজন হারানো পরিবারের লোকেরা। ক্ষোভের আগুনে বগটুই জুড়ে যেন ফের বদলার ইঙ্গিত। ছবির মতো এই গ্রামের নারকীয় হত্যাকাণ্ড রাতারাতি সংবাদের শিরোনামে নিয়ে এসেছে বগটুইকে। যা কখনও কাঙ্খিত ছিল না।

মৃত্যুমিছিল বগটুই এখন রাজ্য রাজনীতির সবচেয়ে চর্চিত বিষয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে কার্টুইতে পা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যেমন তাঁর মানবিক মুখ ফের দেখা গেল ঠিক একইভাবে রাজধর্ম পালনে তিনি যে রাফ অ্যান্ড টাফ তাও তিনি বুঝিয়ে দিলেন।

নিজের দলের ব্লক সভাপতিকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে সেই সঙ্গে রামপুরহাট থানার আইসি এবং এসডিপিওকে সাসপেন্ড করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি কতটা রাফ অ্যান্ড টাফ হতে পারেন।


এর পাশাপাশি বগটুইয়ে স্বজন হারানো পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের হৃদয়ের ক্ষতে প্রলেপ দিতে মানবিক মমতা একাধিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের আশ্বস্ত চেষ্টা করলেন।

মৃতদের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা নগদ, পুড়ে যাওয়া বাড়ি তৈরি করতে এক লাখ টাকা প্রয়োজনে দুই লাখ, আগুনে পুড়ে যারা ৬০ শতাংশ জখম তাদের এক লাখ, আগুনে পুড়ে জখম হওয়া তিন বাচ্চাকে ৫০ হাজার এবং সেইসঙ্গে তাদের যাবতীয় চিকিৎসার দায়িত্ব রাজ্য সরকার নেবে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন।

সেই সঙ্গে প্রতি পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি ইন্টারভিউ ছাড়াই মুখ্যমন্ত্রীর কোটায় এই চাকরি হবে। মাসিক বেতন হবে প্রথমে ১০ হাজার টাকা এক বছরের মধ্যে গ্রুপ ডি পদে তাদের স্থায়ী চাকরি হবে।

• তৃণমূল নেতা আনারুল গ্রেফতার

• আইসি, এসডিপিও সাসপেন্ড

• মৃতদের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা

• পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি

এভাবেই এদিন বগটুইতে আশ্বাস দিলেন মমতা। তবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না বখরার লড়াই, শেষ পর্যন্ত কীভাবে বদল্লার আগুনে পরিণত হয়ে ছবির মতো একটা গ্রামকে ছারখার করে দিল।

ভাদু শেখ এবং আনারুল হোসেনের মধ্যে অনেক অমিল থাকলেও এই দুজনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হল রাতারাতি গরিব থেকে বড়লোক হয়ে উঠেছিলেন দুজনেই। তৃণমূল নেতা ভাদু শেখ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ছিলেন। আনারুল হোসেন স্থানীয় তৃণমূলের ব্লক সভাপতি। দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমাতে ভাদু শেখ খুন হন। তার পাল্টা আটজনকে পুড়িয়ে মারা হয়।

এক্ষেত্রে নিহতদের আত্মীয়রা অভিযোগ করেছেন আনারুল হোসেনের বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বগটুই গ্রামে পা রাখতে না রাখতেই আনারুলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন জীবন্ত দগ্ধ হওয়া পরিবারের পরিজনেরা।

সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশকে নির্দেশ দেন দ্রুত আনারুলকে গ্রেফতার করার। তারাপীঠ থেকে আনারুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে তার আগে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বীরভূমের রামপুরহাট শহর লাগোয়া সন্ধিপুর এলাকার বাসিন্দা বছর ৫২’র আনারুলের বাড়ি পুলিশ নিমেষে ঘিরে ফেলে।

এবার একনজরে দেখে নেওয়া যাক কে এই আনারুল? একসময় আনারুল রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। প্রথমে তিনি কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন। তৃণমূল তৈরি হওয়ার পর আনারুল কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। দক্ষ সংগঠন হিসেবে আনারুলের যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে।

সাংগঠনিক ক্ষমতার জোরে তিনি ধীরে ধীরে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও বিধানসভার বর্তমান ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ হন। সেইসঙ্গে বীরভূম জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলেরও ঘনিষ্ঠ বৃত্তে চলে আসেন।

এরপর রামপুরহাট ১ নম্বর ব্লকের সভাপতি করা হয় আনারুলকে। বগটুই গ্রামের সংগঠন দেখতেন আনারুল। রাজমিস্ত্রি থেকে রাজকীয় উত্থান হয়েছিল আনারুলের তা তার বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। তৃণমূলের উপপ্রধান ভাদু শেখ আনারুলের ছত্রছায়ায় লালিতপালিত হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের কথায় আনারুল ছিলেন ভাদুর যেন বড় ভাই।

কিন্তু সেই ভাদু শেখ খুন হওয়ায় এবং তারপর বগটুইয়ে আগুনে পুড়ে আটজনের মৃত্যুর ঘটনায় অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা আনারুলকে এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বগটুইয়ের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন পুলিশকে।

এই আনারুলের কথায় স্থানীয় থানার আধিকারিকরা উঠতেন বসতেন বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার দিন আনারুল নিষ্ক্রিয় থাকায় পুলিশ প্রশাসনও উদ্যোগী হননি এই ঘটনা রুখতে। এমনটাই অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে মমতার রোষানলে পড়লেন তার দলেরই ব্লক সভাপতি।

এদিকে বাগটুইয়ের হত্যালীলা নাড়িয়ে দিয়েছে সমাজের ভিত। এ ধরনের ঘটনা অভিপ্রেত নয়। যুগ এখন অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। তারপরেও কেন এ ধরনের ঘটনা এড়ানো গেল না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বুধবার বিভিন্ন বেসরকারি সংবাদমাধ্যমের পর্দায় বাড়িতে আগুন লাগার দাউ দাউ ছবি দেখানো হয়েছে।

সেই ছবিতে আগুন নেভানোর কোনও উদ্যোগই দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন আটজন যার মধ্যে শিশু ও মহিলারাও রয়েছেন। তৃণমূলের উপপ্রধান ভাদু শেখের মৃত্যুকে ঘিরে এই পাল্টা খুন কিনা, তার উচ্চপর্যায়ের তদন্ত চলছে।

এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কে এই ভাদু শেখ? প্রথমে ভাদু দিনমজুরের কাজ করত। তারপর কাজ জোটে মুরগির মাংসের দোকানে। ভাদু সেই দোকানের হেল্লার ছিলেন। তার কাজ ছিল পালক ছাড়িয়ে, রক্ত ধুয়ে দেওয়া। আর সেই তিনিই কিনা রাতারাতি দিনমজুর থেকে উঠে এলেন প্রাচুর্যের চুড়োয়।

কুঁড়েঘরের ভাদু হয়ে উঠেছিলেন প্রাসাদের মালিক। সমাজে ভাদুর উত্থান রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। মনের মতো করে বাড়ি তৈরি করেছিলেন। শুধু বাড়ি নয় বাড়ির নিচে ছিল দু’দুটি গ্যারেজ সেখানে থাকত এসইউভি গাড়ি। মাংসের দোকানে হেল্পারের কাজ করা ভাদুর এই আর্থিক বাড়বাড়ন্তের পিছনে কী রহস্য রয়েছে তা স্থানীয় মানুষের অজানা নয়।

অভিযোগ, অবৈধ বালি আর পাথর খাদান থেকে চোরাই সাপ্লাইয়ের বেতাজ বাদশা হয়ে উঠেছিলেন গ্রামের প্রায় সকলেরই পরিচিত ভাদু। তৃণমূল কংগ্রেসকে কাজে লাগিয়ে ভাদু তৈরি করে এই প্রাসাদোপম বাড়ি। তবে তার আগেই নিজের ক্ষমতার বিস্তার অনেকটাই বাড়িয়ে নিয়েছিলেন এই নেতা।

অলিখিতভাবে ব্রহ্মাণী নদীর মালিক হয়ে উঠেছিলেন ভাদু। কিন্তু সেই সুখ দীর্ঘদিন স্থায়ী হল না, খুন হতে হল ভাদুকে। বিগত বাম সরকারের আমলে লালগড়ের অনুজ পান্ডের বাড়ি আজ আর কারো অজানা নয়।

জনরোষে অনুজ পান্ডের প্রাসাদোপম দুধসাদা বাড়ি গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। আশেপাশে যখন সব মাটির বাড়ি তখন সর্বহারা এই নেতার বাড়ি রাজ্য রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে।

জঙ্গলমহলের আমলাশোলে যখন না খেতে পেয়ে মানুষের মৃত্যু হয় সেই সময় অনুজ পান্ডের এই অট্টালিকা কীভাবে সম্ভব হল তা নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। নন্দীগ্রামের তৃণমূল নেতা শেখ সুফিয়ানের জাহাজ বাড়ি নিয়েও চর্চা কম হয়নি।

গ্রামেগঞ্জে আর্থিক স্ফীতি ঘটলে প্রথমে যেটা মানুষ করে তা হল নিজের বাড়ি এবং গাড়ি। ভাদুর ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল। বুধবার বগটুইয়ে ভাদুর এই বাড়ির সামনেই পৌঁছে গিয়েছিলেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।

মহম্মদ সেলিম (Photo:SNS)

সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি অভিযোগ করেন, বালি আর পাথরের টাকাতেই প্রাসাদোপম বাড়ি হচ্ছে তৃণমূল নেতাদের। শুধু কলকাতা নয়, গোটা রাজ্যে এই ট্র্যাডিশন অব্যাহত মহম্মদ সেলিম মানুষের ক্ষোভকে আরও উসকে দিতে বেছে নিয়েছিলেন ভাদু শেখের বাড়ি।

কারণ এই ভাদু শেখের খুনের ঘটনার পর আরও জনকে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যেতে হয়। বিগত বাম সরকারের আমলে লালগড়ের সিপিএম নেতা অনুজ পাণ্ডের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল মানুষ।

মাত্র ১০-১২ বছরের ব্যবধানে তৃণমূল নেতা ভাদু শেখ খুন হলেন দুষ্কৃতীদের দ্বারা। পার্থক্য শুধু একটাই, ভাদুর বাড়ি রইল, কিন্তু তা দেখভালের জন্য তিনিই রইলেন না।