কিছুক্ষণ আগেই দুঃসংবাদটি পেলাম। নবনীতাদি, নবনীতা দেবসেন আর নেই। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন, চিকিৎসা চলছিল। উনি কোনােদিনই নিজের অসুখ-বিসুখকে বিশেষ পাত্তা দিতেন না। দীর্ঘকাল ধরে শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যায় ভুগেছেন। এসব সত্ত্বেও তাঁর মতাে প্রাণবন্ত, মনখােলা মানুষ খুব কম দেখেছি। সেইসঙ্গে এমন বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখার মতাে লেখকও কি খুব একটা দেখা যায়!
নবনীতাদির লেখালেখির পরিধি ছিল খুব ব্যাপ্ত। তাঁর প্রথম প্রেম কবিতা হলেও, পরে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সাহিত্য আলােচনা, একাঙ্ক নাটক, অনুবাদ, রম্যরচনা, ভ্রমণসাহিত্য থেকে শিশুসাহিত্য পর্যন্ত অসুস্থ শরীর নিয়েও নিয়মিত লিখে যাচ্ছিলেন ‘ভালােবাসার বারান্দা’। যার আকর্ষণ এড়ানাে খুব কঠিন ছিল।
নবনীতাদির সঙ্গে আমার আলাপ ও পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল তাঁর শ্বশ্রুমাতা অমিতা সেনের মাধ্যমে। অর্মত্য সেনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও দুই পরিবারের সম্পর্কের মধ্যে কোনাে মালিন্য ঢােকেনি। অমিতা সেনের কন্যা সুপূর্ণা দত্ত (মঞ্জু) ছিলেন তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু। এই সূত্রে তাঁদের শান্তিনিকেতনের বাড়িতেও বিভিন্ন সময়ে তাঁকে দেখার এবং তাঁর কাছ থেকে স্নেহ পাওয়ার সুযােগ আমার হয়েছিল। সেই দিক থেকে নবনীতাদির মৃত্যুতে আমার ব্যক্তিগত এক আত্মীয় বিয়ােগের বেদনা অনুভব করছি।
নবনীতা দেবসেনের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি। বাবা-মা, নরেন্দ্র দেব ও রাধারানী দেবী, দুজনেই ছিলেন বিখ্যাত কবি। সাহিত্যের পরিমন্ডলে বড়াে হয়ে ওঠার সুবাদে কবিতা এবং সাহিত্য যেন তাঁর রক্তে মিশে গিয়েছিল।
কবিতাগ্রন্থ ‘প্রথম প্রত্যয়’ দিয়ে তাঁর সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ। পরে তাঁর সাহিত্যকর্ম ক্রমশ ব্যপ্ত হতে থাকে। পড়াশােনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে আমেরিকার হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতােকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি, পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিউয়েনহ্যাম কলেজ থেকে পােস্ট ডক্টোরাল গবেষণা করেন। বাংলা ও ইংরেজিতে যেমন সমান দক্ষতা ছিল তাঁর, তেমনই জানতেন ফরাসি ও জার্মান ভাষাও। পড়তে পারতেন সংস্কৃত ও হিব্রুও।
১৯৮০ সালের কথা। তখন দিল্লি থেকে প্রকাশিত প্রয়াত কবি অর্চন দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘ক্রুবাদুর’ পত্রিকার পক্ষ থেকে নবনীতাদির কাছে লেখা চেয়েছিলাম। পত্রিকার নাম ‘ক্রুবাদুর’ শুনে বললেন, আমি মহিলা ক্রুবাদুর কবিদের মূল কবিতা থেকে অনুবাদ করে দেব। চোদ্দ শতকের ফরাসি মহিলা বাদুড় কবিদের কবিতার অনুবাদ- এ তাে অভাবনীয় প্রাপ্তি। যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছিলাম হাতের মুঠোয়।
নবনীতাদির একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, ১৬ শতকের কবি চন্দ্রাবতীরচিত ‘রামায়ণ’- এর ইংরেজি অনুবাদ। এছাড়াও কত যে অনুবাদ তিনি করেছেন, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
২০০০ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত করেছিল। সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে তাঁর ‘নটী নবনীতা’র গ্রন্থের জন্যে। আর এ বছরই সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর রচিত শিশুসাহিত্যের জন্য। এছাড়াও আরও অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মতাে প্রকৃত অর্থেই নারী-পুরুষ-বালক-বালিকা নির্বিশেষে এমন জনপ্রিয়তা বেশি লেখকের ভাগ্যে জোটে না।
কিছুদিন আগে দিল্লি থেকে ফিরছি। ফ্লাইট থেকে নামার মুখে দেখা নবনীতাদির সঙ্গে। হুইল চেয়ারে বসে তিনি। তাঁর পাশাপাশি বেশ কিছুটা হেঁটে এলাম। মুখটা কিছুটা শুকনাে লাগছিল, কিন্তু মুখের হাসিটি ছিল বরাবরের মতােই অমলিন, উজ্জ্বল। দেশের এই পরিস্থিতিতে এমন বিদুষী, এমন স্পষ্টভাষী একজন মানুষের চলে যাওয়া আমাদের চিন্তা-চেতনার জগতকে অকেটাই শুন্য করে দিয়ে গেল।