• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

বেগুনকোদর ভ্রমণে  ভূতের খপ্পরে                                             

সুদর্শন নন্দী আমরা চার পর্যটক এক চার চাকায় সন্ধ্যে নামার আগে পুরুলিয়ার মুরগুমা থেকে কোটশিলা সংলগ্ন বেগুনকোদর স্টেশনে পৌঁছেছি৷ বেগুনকোদরের ভূতের কাহিনী সর্বজনবিদিত৷ ভয়ে ভয়ে গাড়ি থেকে নেমেই ফটাফট কটা ছবি তুলতে থাকি৷ হঠাৎ দূর থেকে সোঁ সোঁ আওয়াজ শুনে ভূত ভেবে বাপরে বলে চোঁচা দৌড়ই গাড়ির ভেতরে৷ ড্রাইভার কড়াত করে গিয়ার ফেলে এগুবে ওমা

সুদর্শন নন্দী
আমরা চার পর্যটক এক চার চাকায় সন্ধ্যে নামার আগে পুরুলিয়ার মুরগুমা থেকে কোটশিলা সংলগ্ন বেগুনকোদর স্টেশনে পৌঁছেছি৷ বেগুনকোদরের ভূতের কাহিনী সর্বজনবিদিত৷ ভয়ে ভয়ে গাড়ি থেকে নেমেই ফটাফট কটা ছবি তুলতে থাকি৷ হঠাৎ দূর থেকে সোঁ সোঁ আওয়াজ শুনে ভূত ভেবে বাপরে বলে চোঁচা দৌড়ই গাড়ির ভেতরে৷ ড্রাইভার কড়াত করে গিয়ার ফেলে এগুবে ওমা দেখি কোথা থেকে এক সাইকেল চালক গাড়ির সামনে৷  আমাদের দেখে ফিকফিক করে হাসছে সে৷  যেন কত যুগের চেনা! ভুতবিশ্বাসী পুরুলিয়ার আনারার  ড্রাইভার অশোক তাকে পাশ কাটিয়ে এক্সিলেটরে চাপ দিয়ে গলা কাঁপিয়ে বললে, ভূতেরাও সাইকেল চালায় স্যার৷  সোঁ সোঁ  আওয়াজটা শুনে বুঝতে পাললেন নাই৷  চলুন পালাই ইখান থেকে৷ পিছু ধাওয়া কইরলে আর বাঁচে ফিরতে হবেক নাই৷ পুরো ঘটনাটি বলি এবার৷

আমরা চারজন মিলে দেখতে গেছি মনোরম মুরগুমা ড্যাম৷ সবাই জানেন শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে নির্জন- নিভৃতে দিন দুয়েক সময় কাটাতে পুরুলিয়ার মুরগুমার জুড়ি নেই৷ এই শীতে পর্যটকদের আনাগোনা বেশ বেশিই৷ সত্যি বলতে কি, ১৯৬৫তে নির্মিত অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে এই জলাধারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল৷ এক অদ্ভূত নির্জনতার মধ্যে মাঝে শান্ত জলরাশি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুরগুমা জলাধার৷ পুরুলিয়া গিয়ে ৫০ কিলোমিটার দূরের মুরগুমা ড্যাম দেখে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেছে৷ আমরা তা দেখে ফিরছি বেগুনকোদর হয়ে পুরুলিয়া৷ রাস্তা জুড়ে দেখি  শুধু শাল, পলাশের সবুজ বনানী, আর শুকনো ডিহির হেথাহোথা মাথা তুলে দাঁড়ানো তালগাছের সারি৷ সকালের দিকে বোলেরো করে বেগুনকোদর গ্রাম হয়েই এসেছি মুরগুমা৷ ফেরারও আমাদের এই পথ৷ তবে বেগুনকোদর স্টেশন হয়ে৷ গ্রাম থেকে স্টেশন দূরে, মুরগুমা থেকে বেগুনকোদরের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার৷ স্টেশন বারো কিলোমিটার৷ এই সেই বেগুনকোদর স্টেশন যে এলাকা বিখ্যাত  নির্জনতার জন্য, বিখ্যাত এখানকার স্টেশনে ভূতেদের বিচরণের জন্য৷ তা আমাদের এই ভ্রমণ মুরগুমার সাথে ছিল ভূতেদের সেই  অদ্ভূতেড়ে স্টেশন বেগুনকোদর দর্শন৷ সড়ক পথে আসতে চাইলে পুরুলিয়া রাঁচি রোডই সহজে আসা যায়৷ আমরা মুরগুমা ড্যাম দেখেই চলেছি ভূতের ডেরা বেগুনকোদর স্টেশনে৷ পাহাড়ি চড়াই উতরাই পথ বেয়ে নামতে নামতে বেলা বয়ে গেছে৷  দিনের ডিউটি শেষে সূর্য টা টা করার অপেক্ষায়৷  আমাদের চার খ্যাপাটে পর্যটকের ভূত দেখার অদ্ভূত নেশা চাগাড় দিচ্ছে দেহ মন জুড়ে৷

ড্রাইভার অশোক পইপই করে বুঝিয়েছে কোন কারণে ওই শুনশান স্টেশন চত্বর থেকে বেরাতে না পাললে কপালে অশেষ দুইর্ভোগ আছে কিন্ত্ত৷ সে ভূতের দাপট প্রমাণ দিতে বললে, আমার ভাইপো সেবার কোনরকম বাঁচে ফিরেছে ভুতের খপ্পর থেকে৷ এই দেখুন, বইলতে গিয়ে আমার স্টিয়ারিং কেমন কাঁপে উটচে৷  পিছন থেকে খোঁচা মেরে আমি মজা করে বললাম, স্টিয়ারিং কাঁপছে গাড়িটা এই এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় যাচ্ছে বলে৷ অশোক এবার স্পিকটি নট৷  গুগল ম্যাপ বেগুনকোদর হল্ট স্টেশনের কোন হদিশই দেখাচ্ছে না৷ তাই বোলেরো গাড়ির  জানালা খুলে বেগুনকোদর বাজারে এসে এক যুবককে জিজ্ঞাসা করি ভাই বেগুনকোদর স্টেশন কতদূর এখান থেকে? সে সামনের পাঁড়ুই গ্রামে ডান দিকে ঘুরে যেতে বলল৷ আসলে ভুতুড়ে অদ্ভুতেড়ে যাই হোক, স্টেশনটি গ্রাম বা শহর থেকে বেশ বাইরে৷ ডান দিকে ঘুরে পাঁড়ুই গ্রাম থেকে এবড়ো খেবড়ো  সরু রাস্তা ধরে চলেছি৷ আমার মিসেস বলল, ঘর চল দেখি৷
সেধে আর ভূত দেখতে এই ভুষুন্ডির মাঠে যাবার দরকার নেই৷ ঘরে জ্যান্ত ভূত দেখে দেখে আমার জীবন শেষ হয়ে গেল৷ মনে আছে আমার মামা একবার রাতে পুরুলিয়া আসছিল, কোন কারণ ছাড়াই বেগুনকোদরে  দুঘন্টা ট্রেন বন্ধ করে দিয়েছিল ভূতের দল৷ সে ঘটনা শুনে ভয়ে আমি রাতে কবছর ট্রেনেই চাপি নি৷ আমি বললাম  তা হলে তো এমন স্টেশনে না গিয়ে থাকা যায়? সত্যি যাচ্ছি তো যাচ্ছি৷ ভূতের গন্ধ তো দূর অস্ত স্টেশনের নামগন্ধই নেই৷ অস্তগামী সূর্য মেটে সিঁদুরের মতো লাল৷  ক্লান্ত হয়ে সে দিগন্তরেখায় ডুব দেবার অপেক্ষায়৷ কজন গ্রামবাসী দেখি আড্ডা দিচ্ছে৷  তাদের  জিজ্ঞাসা করি দাদা, বেগুনকোদর স্টেশন আর কত দূর?আমার কথা শুনে একজন বললন, ভূত দেখতে যাবেন নাকি?আমরা ভূত দেখার মতোই চমকে উঠি কথা শুনে৷

আমাদের গন্তব্যের কারণ এরা জানল কি করে? পরে জেনেছি এই বেগুনকোদর স্টেশনের ভূতমাহাত্ম্য এতোই তেজি যে প্রতিদিন বেশ কিছু পর্যটক খাঁ খাঁ স্টেশনে ভূত খুঁজতে বা ধরতে আসেন৷ তাই গ্রামবাসীরা বুঝে গেছেন ওই ভূতের কারণই স্টেশনটিকে বিখ্যাত বা রহস্যময় করেছে৷  আসার আগে খবর নিয়েছিলাম বেগুনকোদর স্টেশনে সত্যি কিছু ঘটেছিল নাকি অন্য কিছু রটেছিল? পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাডে়র গা ঘেঁষে বেগুনকোদর স্টেশন ঘিরে  গা ছমছমে ভূতের গল্প বহু পুরোনো৷ কেউ বলেন ভূতেরা যাত্রীদের ভয় দেখায়, লাল চোখ দেখিয়ে ট্রেন থামায়, এমন কি ভূতেদের কেউ তাচ্ছিল্য করলে তাকে খেদিয়ে  নিয়ে গিয়ে নাকানি চোবানি খাওয়ায়৷ সেই ভূতের ভয়েই ১৯৬৭ সাল থেকে টানা চার দশক এই স্টেশনে নাকি কোনও ট্রেন চলেনি ৷

দক্ষিণপূর্ব রেলের রাঁচি ডিভিশনের পুরুলিয়ার ঝালদা থানা এলাকায় এই স্টেশন ৷ তবে এইসব ঘটনার সত্যতা নিয়ে  রয়েছে নানা প্রশ্নও৷ স্থানীয় মানুষজন থেকে বিজ্ঞান মঞ্চ অবশ্য এসব রটনা বলেই জানালেন৷ রেলকর্তারা কেউই বিস্তারিত কিছ বলেননি৷  সন্ধে নামলেই ওই স্টেশনের ত্রিসীমানায় দেখতে পাওয়া যায় না কাউকে৷  তবে রাত দশটায় শেষ ট্রেন থামে বলে জানা গেল৷  একসময় পুরুলিয়ার এই স্টেশনে থামত প্রচুর ট্রেন৷ সারা দিন মানুষের ভিডে় গমগম করত স্টেশন ৷ কিন্ত্ত এখন ট্রেন চলে যাওয়ার পর স্টেশনের চারদিক শুনশান৷ এখন মোট পাঁচ জোড়া ট্রেন আসা যাওয়া করে৷ সকাল পাঁচটা ছয়ে শুরু, শেষ ট্রেন রাত দশটা ছয়৷ আগে থামত সব প্যাসেঞ্জার ট্রেনই৷ জনশ্রুতি, বহু বছর আগে একদিন রাতে এখানে খুন হন স্টেশন মাস্টার ও তাঁর স্ত্রী৷ পরে স্টেশনের কাছে এক কুয়োর মধ্যে থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁদের মৃতদেহ৷ সেই থেকেই নাকি ভূতের উপদ্রব শুরু ৷ এর পর নাকি ভয়ে পালিয়ে যান রেলকর্মীরা৷ বন্ধ হয়ে যায় স্টেশনে ট্রেন থামা৷ শোনা যায়, ওই ঘটনার পর থেকেই যাত্রীহীন স্টেশনে পরিণত হয় আজকের ভূতুড়ে আখ্যা পাওয়া বেগুনকোদর ৷

১৯৬৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ছিল একই হাল৷ তবে, এই সময়সীমায় বেগুনকোদর স্টেশন চালু করার কথা যে একেবারেই ওঠেনি, তা নয় ! বামফ্রন্টের প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচার্য যিনি এই রেল স্টেশন চালু করার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর যুক্তি ছিল, ভূতের ভয় বাজে কথা৷ গ্রাম থেকে অনেক দূরে এই স্টেশন৷ সেজন্য কেউ ওখানে কাজ করতে চাইত না ৷ তাই এই ভৌতিক উপদ্রবের রটনা! তবে ২০১০ সালে আবার খোলে বেগুনকোদর স্টেশন নতুন উদ্যোগে কিন্ত্ত ভুতের তকমা জোরালো ভাবেই সেঁটে যায় বেগুনকোদর নামের আগে৷ ফলে ভুতুডে় স্টেশনের দুর্নামটা এখনো যায়নি৷ পুরুলিয়ায় ঘুরতে–আসা পর্যটকরা একবার হলেও এই স্টেশনে আসেন স্টেশনের ছবি তুলতে৷ ভূতের ভয়ে পালিয়ে যান সন্ধের আগেই৷ আমরাও কটা ছবি তুলে পালিয়ে এলাম হঠাৎ উদীয়মান এক সাইকেল চালককে পাশ কাটিয়ে৷ তার আগে যে সোঁ সোঁ আওয়াজ পেয়ে ভূত ভেবেছিলাম সেটা ছিল ট্রেনের আওয়াজ৷ সে ট্রেন আমাদের পাশ দিয়ে হুঁশ করে চলে গেল৷ ড্রাইভারকে বললাম, কোথায় ভূত, এ তো ট্রেনের আওয়াজ? ভূতবিশ্বাসী ড্রাইভার অশোক জোর দিয়ে বললে,  সাইকেল নিয়ে সামনে হঠাৎ চলে আইছিল বুঝতে পাললেন নাই  কিছু? জোর বেঁচেছি পাশ কাটিয়েই টপ গিয়ারে ফেলে৷  আমার সঙ্গী ড্রাইভার অশোককে বললেন, ইস সাহস করে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমাদের সন্ধ্যাবেলায় টি ভিতে যেমন সো হয় সেরকম ভুতেদেরও টক শো হলে লাইভ দেখা যেত!! ড্রাইভার অশোক একটু রেগে বললে, তোমাদের সবেতেই হেঁয়ালি৷ যেদিন পড়বে এই ভূতের খপ্পরে সেদিন বুঝবে ভূতেদের তাচ্ছিল্য করার হ্যাপা কিরকম! ওই টক তখন ঝাল হয়ে জিভ থেকে পেট আগুন জালিয়ে ছাড়বেক৷ বলেই সে পুরুলিয়ার পথে গাড়ি ছোটাল৷