পুজোর মুখে বাংলায় বন্যার ভ্রুকুটি

প্রতিকি ছবি (Photo: IANS)

রাজ্যের কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পুজোর দিনগুলিতে ভারী বৃষ্টির আশঙ্কায় সতর্কতা বার্তা জারি করেছে হাওয়া অফিস। এই পরিস্থিতিতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে বুধবার নবান্ন জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করলেন রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারদের কাছে রিপোর্ট নিয়েছেন মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা এবং স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়।

উত্তরবঙ্গের মতাে দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু এলাকা বন্যার জলে প্লাবিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গের একাধিক ব্লক জলের তলায় চলে যাওয়ায় উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন প্রশাসনের কর্তারা। ভিডিও কনফারেন্সে জেলা প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে আলােচনায় সমস্ত ছুটি বাতিল করে দিয়েছেন মুখ্যসচিব। জেলাশাসকদের মতাে বন্যাকবলিত এলাকায় বিডিওদের ছুটিও বাতিল করা হয়েছে। অন্য সমস্ত বিডিওকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্যসচিব জেলাশাসকদের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। মালদা এবং হাওড়ার জেলাশাসক তাঁদের রিপাের্ট ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দিয়েছেন। প্রশাসন সূত্রে খবর, কেবলমাত্র মালদা জেলাতেই বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এই জেলায় মােট আটটি ব্লক নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। মুখ্যসচিব মালদার জেলাশাসককে পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে বলেছেন এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিয়মিত রিপাের্ট পাঠানাের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 


নবান্ন সূত্রে খবর, জলমগ্ন এলাকার জন্য ত্রাণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুকনাে খাবার, কাপড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী ঠিকমতাে যাতে ত্রাণ শিবিরগুলিতে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেব্যাপারেও জেলাশাসকদের নজরদারি করতে বলা হয়েছে।

ইতিমধ্যেই দুর্গোপুজো শুরু হয়ে গেছে। উৎসবের দিনগুলিতে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনও অবনতি না ঘটে, সেব্যাপারে রাজ্যপুলিশের ডিজি বীরেন্দ্র জেলা পুলিশ সুপারদের কড়া নজরদারি রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি পুজোর অপ্রীতকর ঘটনা এড়াতে জোরদার নিরাপত্তা গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে। মুখ্যসচিব জানিয়েছেন, জেলাশাসকদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার বিডিওদেরও ছুটি বাতিল হয়েছে। পুজোর সময় রাজ্যের শান্তি সম্প্রীতি বজায় রাখতেও প্রয়ােজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনের কর্তাদের।

হাওড়া- ডিভিসি’র ছাড়া জলে ফুসছে দামােদর, হাওড়ার বিভিন্ন এলাকায় জল ঢুকে পড়ে প্লাবিত হয়েছে এলাকা। বাঁধ উপছে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে কুর্চি-শিবপুর, হরালি উদয়নারায়ণপুর, রামপুর ডিহিভুরসুট আসন্ডা, সিংটি পঞ্চায়েত এলাকা, মুণ্ডেশ্বরী নদীর জলে প্লাবিত আমতা-২ নম্বর ব্লকের ভাটোরা এবং ঘােড়াবেড়িয়া-চিন পঞ্চায়েত এলাকা। প্লাবিত হওয়ার পরই উদয়নারায়ণপুরে ১৩টি ত্রাণশিবির খুলে জলমগ্ন প্রায় ৪০০ পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।

বুধবার সকালে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে যান জেলাশাসক মুক্তা আর্য। রবিবার বিকেল থেকে দফায় দফায় জল ছাড়ে ডিভিসি। প্রথমে ৭০ হাজার কিউসেক, পরে ১ লক্ষ ৩ হাজার কিউসেক এবং মঙ্গলবার সকালে ৬৮ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে বলে জানান সেচ দফতরের অন্তর্গত নিম্ন দামােদর নির্মাণভুক্তির কর্তারা। বকপােতার কাছে বাঁধ ছাপিয়ে কুর্চি-শিবপুর পঞ্চায়েতের পূর্ব টোকাপুর গ্রামে জল ঢুকতে থাকে। জলের চাপে ডিহিভুরসুট ফ্লুইস গেটের কাছে বাঁধ ভাঙে। জেলাশাসকের কাছে এলাকার বাসিন্দারা অভিযােগ জানান যে, জল ছাড়ার আগাম খবর প্রচার করা হয়নি।

আমতা-২ নম্বর ব্লকে ও উদয়নারায়ণপুরে দামােদরের ডানদিকে ডিভিসি’র ছাড়া জল বেরনাের জন্য বড় বাঁধ নেই। পুরনাে আমলের নীচু বাঁধ সংস্কার করা হলেও তাতে খুব একটা লাভ হয় না। আমতার থালিয়া থেকে বাগনানের বাকসি পর্যন্ত একটি খাল কাটা হয়, যাতে ডিভিসির ছাড়া বাড়তি জল রূপনারায়ণে পড়ে। ওই খালের জলধারণ ক্ষমতা ছিল ৩০ হাজার কিউসেক, সংস্কারের পর ওই খালের জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এবিষয়ে সেচ দফতর সূত্রে খবর, ডিভিসি’র তরফে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত জল ছাড়লেও উদয়নারায়ণপুর ও আমতা-২ নম্বর ব্লকে বন্যা রােধ করা সম্ভব। যদিও ১ লক্ষ কিউসেক জল ছাড়লে তা সম্ভব নয়।

প্লাবিত স্থানগুলি পরিদর্শনের পর জেলাশাসক মুক্তা আর্য বলেন, ত্রাণের কোনও অভাব হবে না। শিশুখাদ্য, পানীয় জল, ওষুধপত্র পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুত রয়েছে। ফাটলধরা বাঁধগুলি মেরামতের জন্য বালির বস্তাও মজুত আছে।

আরামবাগ- দফায় দফায় ডিভিসি’র ছাড়া জলে প্লাবিত আরামবাগ মহকুমার বেশকিছু এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুরশুড়া ব্লক। এখানে প্লাবিত হয়েছে আঁকড়ি শ্রীরামপুর, শ্যামপুর হরিহর, এরকম প্রায় ৩৮টি গ্রাম। ঘরছাড়া অসংখ্য মানুষ বাঁধের উপর ত্রিপল খাটিয়ে বসবাস করছেন, জলবন্দি কয়েক হাজার মানুষ। অভিযােগ সরকারি ত্রাণ এবং সাহায্য সেখানে ঠিকমতাে পৌঁছচ্ছে না। ব্লক অফিস অবশ্য জানিয়েছে, পর্যপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পরিস্থিতির উপর তারা নজর রাখছেন।

স্থানীয় মানুষের অভিযােগ, ডিভিসি জল ছাড়লেও এলাকায় প্রশাসনের তরফে কোনাে আগাম সতর্কবার্তা ছিল না। মাঝরাতে বন্যা আসায় অত্যাবশকীয় জিনিসপত্র বের করে আনা যায়নি, এক বস্ত্রে সকলে বেরিয়ে এসেছেন। ফলে সকাল থেকেই খাদ্য, পােশাক সবকিছুরই অভাব দেখা দিয়েছে অথচ সরকারিভাবে কোনাে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্বভাবতই ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকার বানভাসি মানুষ।

দামােদরের জলে ইতিমধ্যেই ভেসে গেছে বেশ কিছু এলাকা। হরিহর, শ্যামপুর প্রভৃতি এলাকায় দামােদরের বাঁধে ফাটল ধরেছে কিন্তু অভিযােগ প্রশাসনের তরফে সেভাবে দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। মঙ্গলবার বেলার দিকে পুরশুড়ার বিডিও অচিন্ত্য ঘােষ এবং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মােমিন মিদ্দে এলাকায় গেলে তাদের গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসীরা।

হুগলি জেলার সভাধিপতি মেহবুব রহমান জানিয়েছে, ‘দামােদরের জলে প্লাবিত হয়েছে এলাকার বেশ কিছু গ্রাম। ডিভিসি জল ছাড়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে ৪৪ হাজার কিউসেক জল ছাড়ছে। এখন জল নামছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে। যে যে জায়গায় ওয়াটার লগ হয়ে আছে সেখানে সমস্যা আছে। আমি পুরশুড়ার বিডিও, ওসি এবং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির সঙ্গে যােগাযােগ রাখছি, ওখানে গিয়ে পরিস্থিতি দেখেছি এবং প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ত্রিপল এবং খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এলাকার ত্রাণ শিবির খােলা হয়েছিল কিন্তু সেখানে কেউ যায়নি। মানুষজন বাড়ি ছেড়ে ত্রাণশিবিরে আসতে চাইছেন না। আমরা দুর্গত এলাকায় খাবার ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। কোথাও সমস্যা সেভাবে নেই কিন্তু কোথাও কোথাও এটা নিয়ে নিম্নরুচির রাজনীত হচ্ছে’।

বহরমপুর- একদিকে টানা বৃষ্টির এবং অন্যদিকে ফরাক্কা ব্যারেজের লক গেটগুলি খুলে দেওয়ার ফলে মুর্শিদাবাদে তৈরি হয় বন্যা পরিস্থিতি। জেলার ফরাক্কা, কান্দি, সুতি-১ ও ২, সামশেরগঞ্জ, নবগ্রাম, খড়গ্রাম, ভরতপুর, জলঙ্গি, ভগবানগােলা-১ ও ২ ব্লকের বহু গ্রাম প্লাবিত। জলের তলায় ধানের জমি রাস্তা, বাজার, দোকান। ইতিমধ্যে ভেঙেছে বহু কাঁচা বাড়ি। মানুষজন ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বন্যার বলি হয়েছিল সুতি থানার লকাইপুর গ্রামের শুভজিৎ মণ্ডল (৯)। এবার মারা গেল সামশেরগঞ্জ থানার পুটিমারি গ্রামের এলকেজি’র ছাত্র আজমল হােসেন। বন্যার জল দেখতে গিয়ে সে পড়ে যায়। এক ঘণ্টা পরে তার দেহ উদ্ধার হয়। জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত বলে ঘােষণা করে চিকিৎসকরার।

এদিকে পদ্মার জল বেড়ে প্লাবিত হয়েছে জলঙ্গি ব্লকের ফরাজীপাড়া, সীতানগর, সাহেবনগর, কাকমারি ইত্যাদি গ্রাম। প্লাবিত গ্রামের মানুষজন আশ্রয় নিয়েছেন উদয়নগর খণ্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বুধবার বন্যায় সব হারানাে মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে যান বিডিও। ফরাক্কা ব্লকের হােসেনপুর গ্রামে শুরু হয়েছে একদিকে ভাঙন এবং অন্যদিকে প্লাবন। ভাঙনে আগেই তলিয়ে গিয়েছিল ধানের জমি, বাড়িঘর। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা ভেসে গিয়েছে বন্যার জলের তােড়ে। সব হারানাে মানুষগুলাে পাকা রাস্তায় উঠে আসে। কিন্তু আজ সেই রাস্তা দিয়েও জল বইতে থাকলে তাদের উদ্ধার করতে প্রায় ১২টি নৌকা নিয়ে সেখানে যান জঙ্গিপুর মহকুমাশাসক গান্ধর্ভ রাঠোর, ফরাক্কা থানার আইসি উদয়শঙ্কর ঘােষ ফরাক্কা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আঞ্জমারা খাতুন প্রমুখ। খােলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া মানুষজনকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় নিউ ফরাক্কা উচ্চ বিদ্যালয়ে। হােসেনপুর গ্রামের প্রায় তিনশাে বাড়ি ভাঙন এবং প্লাবনে তলিয়ে গিয়েছে বলে জানা যায়। একই অবস্থা খড়গ্রাম ব্লকের ঝিল্লি গ্রামের। বাঁধ ভেঙে প্লাবিত গােটা গ্রাম, বাজার, রাস্তাঘাট।