নিশীথ সিংহ রায়
একসময় বাংলা সিনেমায় সুরকার হিসেবে সবচাইতে আলোড়িত নাম ছিলেন অশোক ভদ্র সে সময় বছরে যতগুলি বাংলা সিনেমা মুক্তি পেতো তার মধ্যে অধিকাংশ সিনেমার গানের সুরকার হিসেবে অশোক ভদ্র ছিলেন একবারে প্রথম সারিতে তার সুরারোপিত গানগুলি যে সব ছবিতে চিত্রায়িত হয়েছে তার তালিকা এতটাই দীর্ঘ যে এই এক প্রতিবেদনে তা লিখে ফেলা সম্ভব নয় প্রায় তিনশোর উপর এপার বাংলার সিনেমার গানে তিনি সুরারোপ করেছেন আবার ওপার বাংলার সিনেমাতেও তার সুরের মায়ায় আচ্ছন্ন করেছেন সেখানকার দর্শক ও শ্রোতাবৃন্দকে পাশাপাশি হিন্দি সিনেমার গানেও তিনি সুর করেছেন অথচ তার শুরুর দিকটা কিন্তু একটু অন্যরকম ছিল বাড়িতে বড়দের দেখে ও তাদের কাছ থেকে শুনে শুনে গানের প্রতি অশোকবাবুর আগ্রহ জন্মায় সেভাবে প্রথাগতভাবে কোনো গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে কোনোদিনই তার গান শেখা হয়ে ওঠেনি বাড়িতেই কাকা, দিদি এদের গান শুনতে শুনতে কখন যেনো নিজের অজান্তেই সঙ্গীতের জগতে ঢুকে পড়েন অশোকবাবু বাবা, মা ছিলেন জন্মসূত্রে ওপার বাংলার ফরিদপুরের অশোকের জন্ম কিন্ত কলকাতায় স্কুল, কলেজের লেখাপড়া শেষ করে তিনি ভর্তি হন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগের ছাত্র হিসেবে প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা বলতে গেলে এখানেই কিছুদিন লোকসঙ্গীতের পাঠ নেন বুদ্ধদেব রায়ের কাছে এর মাঝেই কল্যাণ মুখার্জীর গ্রুপে কিছুদিন গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন পরবর্তীকালে নিজেও একটি গানের দল গড়ে তোলেন — ‘সমস্বর’ ঘরোয়া বলে একটা পত্রিকার পক্ষ থেকে স্টুডিও কভারেজের সুযোগ পাওয়ায় গানের প্রতি আগ্রহ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে সুরকার হিসেবে কাজের সুযোগ মেলে এইচ এম ভি থেকে আশা ভোঁসলে, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত শিল্পীদের হওয়া গানে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে অশোকের এরপর বাংলা সিনেমার নেপথ্য শিল্পীদের গাওয়া গানে সুরকার হিসেবে অশোক ভদ্র তার সাফল্যের রথ এগিয়ে নিয়ে চলেন তার সুরারোপিত প্রচুর ফিল্মের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো — রাখাল রাজা, সবার উপরে মা, তোমাকে চাই, নিষ্পাপ আসামি, শিমুল পারুল, ন্যাগ নাগিনী, কমলার বনবাস, নয়নের আলো, মধু মালতী, গরীবের রাজা রবিনহুড, সৎ ভাই , এই ঘর এই সংসার, জবাব চাই, শত্রুর মোকাবিলা, কুরুক্ষেত্র, সবুজ সাথী, মায়ের আঁচল, পরিবার, কুলি বা মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত চোরে চোরে মাসতুতো ভাই বা মহাগুরুর মতো আরো অজস্র ফিল্ম
সুরকার হিসেবে কাজ করেছেন ব্লাডি ইশকের মত জনপ্রিয় ছবিতেও পাশাপাশি সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও কাজ করেছেন ‘কখনো বিদায় বোলো না’ ছবিতে তাঁর সুরে গান গেয়েছেন কুমার শানু, সোনু নিগম, কে কে, শ্রেয়া ঘোষাল, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, সুনিধি চৌহান, অলকা ইয়াগ্নিক, অমিত কুমার, নির্মলা মিশ্র, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, ইন্দ্রানী সেন, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় বা এই প্রজন্মের রুপঙ্কর, রাঘব, মনোময় বা ইমন চক্রবর্তী মতো বিখ্যাত শিল্পীরা সুরকার হিসেবে পেয়েছেন বহু পুরস্কার যেগুলি তার প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘প্রমথেশ বড়ুয়া টেলিসিন এ্ওয়ার্ড, ‘উত্তমকুমার এওয়ার্ড’ বা ওনার সুরারোপিত গানে এবছরই শ্রেষ্ঠ মহিলা কণ্ঠের জন্য মির্চি পুরস্কার পেয়েছেন অন্বেষা দত্ত গুপ্ত
সংগীত শিল্পীদের নিয়ে দেশে-বিদেশে বহু জায়গায় শো করে চলেছেন অনেকদিন ধরেই এখনো মফস্বলে শুধুমাত্র তার নামেই অশোক ভদ্র নাইট অনুষ্ঠিত হয় থাকে সঙ্গীতের একনিষ্ঠ সাধক হিসেবে ছাত্র ছাত্রীদের গান শেখাতে ভালোবাসেন সম্ভাবনাময় কাওকে দেখলে প্রায় ডেকে এনে তাদেরকে নিখরচায় গান সেখান অশোকবাবু বাংলা এবং বাংলার বাইরেও তার প্রচুর ছাত্র ছাত্রী হিসেবে রয়েছে গ্রুমার হিসেবেও কাজ করতে ভালোবাসেন অশোক বাবু
আলাপচারিতায় অশোকবাবু জানালেন যে এই মুহূর্তে বছরে হাতে পাঁচ ছয়টা কাজ করছেন ছবির ব্যস্ততা কমেছে, কিন্তু অন্যান্য কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে বাড়ছে ইউটিউবের কাজ, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কাজ আগামীতে একটা অ্যাকাডেমি গড়ে তোলার ইচ্ছে রয়েছে মনে সময় এবং সুযোগ ঘটলে এই কাজটা তাকে করতেই হবে কারণ নতুন নতুন প্রতিভাবান শিল্পীদের আলোর সামনে নিয়ে আসার স্বপ্ন তার বহুদিনের বর্তমান প্রজন্মের সুরকারদের প্রসঙ্গ ওঠায় অশোকবাবু তার মতামত জানালেন বেশ খোলাখুলি ভাবেই তার মতে এ প্রজন্মের সুরকাররা যথেষ্ট প্রতিভাবান ভালো কথা পেলে এ যুগের সুরকাররাও আলোড়ন সৃষ্টিকারী কাজ করতে পারেন প্রতিভার অভাব নেই এ যুগেও কিন্তু বরাবরের মতোই নেপোটিসম আর লবি, অনেক প্রতিভাকেই অকালে হারিয়ে যেতে বাধ্য করছে তবে এটাও সত্যি যে সঠিক প্রতিভাকে রোখা মুস্কিল কারণ দর্শক স্টার বানায় আর একবার যদি কেউ নিজের প্রতিভার কারণে সঠিক সুযোগ পায়, তবে কোনো রাজনীতি, লবি তাকে থামাতে পারে না তিনি নিজেই তার বড় প্রমাণ
অশোক ভদ্র সুরকার হিসেবে কাজ করছেন তিরিশ বছরের উপর তার সুরারোপিত অনেক গানই এখনো শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে তবুও আফসোস কিন্তু রয়েই গেছে আক্ষেপের সুরেই বললেন, আরো কাজ করার ইচ্ছে ছিল, আরো অনেক কিছুই দেওয়ার ছিল বাংলা সঙ্গীতের জগৎকে কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির কারণেই এখন কাজের পরিমাণ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন আরও একটি বিষয়ে আক্ষেপের সুরে শোনা গেলো অশোকবাবুর কন্ঠে আজকাল বিভিন্ন চ্যানেলে গানের রিয়ালিটি শো হচ্ছে কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণেই কোথাও থেকে তাকে বিচারক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয় না মনে তার প্রশ্ন একটাই যে তাহলে কি তিনশোর বেশি ফিল্মের গানে সুরারোপ করার পরেও তার আরও কিছু প্রমাণ করার আছে? বাংলা গানের শ্রোতারা নিশ্চয় বলবেন যে, অশোক ভদ্রর আর কিছু প্রমাণ করার তো নেইই, বরং তিনি বাংলা সঙ্গীতের জগতে যে মাইল স্টোন স্থাপন করেছেন তার সুরের মায়াজালে, সেটা আগামী বহু প্রজন্মের কাছে উদাহরণ হয়ে থেকে যাবে