ঐতিহ্যবাহী শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব নিয়ে এবার যে বিভ্রান্তি এবং রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি শুরু হযেছে, অতীতে কখনওই হয়নি বলেই মানছেন সকলেই। আর এ নিয়ে সকলেই বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর দিকেই অভিযােগের আঙুল তুলেছেন। এবং ভবিষ্যতে এর রেশ যে আরও অনেক দূর গড়াবে তা মনে করছেন বিশ্বভারতীর ওয়াকিবহল মহলের অনেকেই।
বিশ্বভারতীর আর্থিক সংকটের কথা বলে উপাচার্য এবার বসন্তোৎসব কোনও একটা সময় ঘরােয়াভাবে পালন করার কথা বলার পরই বিষয়টি নিয়ে শােরগােল শুরু হয়ে যায়। পরে রাজ্য সরকার এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে বসন্তোৎসব বন্ধ না করার অনুরােধ জানিয়ে সমগ্র বিষয়ে সহযােগিতার আশ্বাস দেয়।
সেই আহ্বানে বিশ্বভারতী সাড়া দেওয়ার পরে রাজ্য সরকারের নির্দেশে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বােলপুর সার্কিট হাউসে একটি বৈঠক ডাকা হয়। সেই বৈঠকে হাজির হন রাজ্যের দুই মন্ত্রী ড. আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ সিংহ, জেলাশাসক মৌমিতা গােদারা বসু, জেলা পুলিশ সুপার শ্যাম সিংহ সহ অন্যান্যরা। আমন্ত্রণ জানানাে সত্ত্বেও সেই বৈঠকে অনুপস্থিত থাকে বিশ্বভারতী।
পরে বিশ্বভারতী বৈঠকে ডাকলে সেখানে রাজ্য সরকারের পক্ষে হাজির থাকেন বীরভূমের জেলাশাসক, জেলা পুলিশ সুপার। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, এবার ৯ মার্চ বসন্তোৎসব শান্তিনিকেতন আশ্রম মাঠের পরিবর্তে তা হবে পূর্ব পল্লির পৌষমেলার মাঠে। অনুষ্ঠান করার জন্য রাজ্য সরকার বিশ্বভারতীকে দেবে ৮২ লক্ষ টাকা। বাকি সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে রাজ্য সরকার।
সেই মতাে প্রস্তুতি নিয়ে রাজ্য সরকার বসন্তোৎসব করার কাজে নেমে পড়ে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়েও দেওয়া হয় যে, এবার বসন্তোৎসবের আয়ােজনে অর্থ কোনও সমস্যা হবে না। রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী ও প্রশাসনিক আধিকারিকদের তত্ত্বাবধানে পূর্ব পল্লির মাঠে। বসন্তোৎসবের জন্য মঞ্চ বাধা থেকে শুরু করে এলাহি আয়ােজন শুরু হয়ে যায়।
এমনকি, শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন রাস্তায় দু’পাশ টিনের বেড়া দিয়েও ঘেরা হতে শুরু করে। শান্তিনিকেতন সহ বােলপুরের বিভিন্ন জায়গায় বসন্তোৎসবের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের জন্য ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। অস্থায়ী শৌচালয় তৈরির কাজও হয়।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই মারণরােগ করােনাভাইরাস আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তেই বিশ্বভারতীর আচার্য তথা প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন যে, তিনি এবার হোলিতে অংশ নেবেন না। কেন্দ্রীয় সরকারও বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয়। করােনাভাইরাসের আশঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি’র তরফে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে একটি নির্দেশিকা পাঠিয়ে জমায়েত এড়ানাের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশ হাতে আসার পরই শুক্রবার বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ।
বিকেল তিনটে থেকে টানা চার ঘণ্টার বেশি শান্তিনিকেতনের রথীন্দ্র অতিথি নিবাসে আলােচনায় বসে বসন্তোৎসব স্থগিত রাখার কথা ঘােষণা করে। তারপরই পূর্ব পল্লির মাঠে সেই খবর এসে পৌঁছতেই প্রস্তুতির সমস্ত কাজই বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে ৭ মার্চ দুপুরের দিকে বিশ্বভারতী কর্মিপরিষদের নামে একটি প্রচারপত্র। ছড়িয়ে পড়তেই নতুন করে বসন্তোৎসব নিয়ে আশার সঞ্চার হয়। ওই প্রচারপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, বিশেষ কারণে আসন্ন বসন্তোৎসবে নিম্নোক্ত অনুষ্ঠানগুলি বাতিল ঘােষণা করল এবং শুধুমাত্র বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, শিক্ষাকর্মী এবং আশ্রমিকদের বৈতালিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে অনুরােধ জানাই।
সেই সঙ্গে ৯ মার্চের একটি অনুষ্ঠানসুচি দিয়ে গৌরপ্রাঙ্গণে ভােরের বৈতালিক ও সকালের অনুষ্ঠানসূচি দেওয়া হয়। সােশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রচারপত্র ছড়িয়ে পড়তেই ছাত্রছাত্রী থেকে সকলের মধ্যে বসন্তোৎসব নিয়ে নতুন করে উন্মাদনা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু তা থেমে যেতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। কেননা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় যে, ওই প্রচারপত্র ভুয়াে। উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়াতেই এই ধরনের প্রচার করা হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে দোষীদের চিহ্নিত করতে পুলিশে অভিযােগ জানানাে হবে বলে জানায়।
এদিকে রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ জানান, বিশ্বভারতী বসন্তোৎসব পরিচালনার জন্য রাজ্য সরকারের সহযােগিতা চাওয়ায় রাজ্য সরকার সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বসন্তোৎসব বাতিল ঘােষিত হওয়ায় তাদের আর এ ব্যাপারে কোনও ভূমিকা নেই।
যদিও এ ব্যাপারে জানা যাচ্ছে যে, রাজ্য সরকারের আর্থিক সাহায্যে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এভাবে বসন্তোৎসব করতে চাওয়ায় প্রবীণ আশ্রমিকদের অনেকেই অসন্তুষ্ট হন। কেননা, রবীন্দ্রনাথের সময়কাল থেকে কখনও এ ধরনের ঘটনা বিশ্বভারতীতে ঘটেনি। রাজনীতিকদের একটি অংশও এতে চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়। তারা এ ব্যাপারে বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের গােচরেও আনেন। উপাচার্যের ভূমিকাতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে কেন্দ্রকে জানায় যে, কেবলমাত্র অর্থের জন্য এভাবে বিশ্বভারতীর অনুষ্ঠানে রাজ্যের কাছে হাত পাতাতে কেন্দ্রের ভাবমুর্তি কালিমালিপ্ত হচ্ছে।
এতে প্রধানমন্ত্রী তথা বিশ্বভারতীর আচার্যেরও অমর্যাদা হচ্ছে। এমনকি, রাজ্যের রাজ্যপাল তথা বিশ্বভারতীর রেক্টর জগদীপ ধনকড় দিল্লি গেলে ৫ মার্চ তাঁর সঙ্গে সদ্য পশ্চিমবঙ্গ সফর সেরে যাওয়া কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনার সময় দিল্লির একটি মহলের প্রচেষ্টায় বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বসন্তোৎসবের অনুষ্ঠানে রাজ্য সরকারের সরাসরি অংশগ্রহণের বিষয়টি উঠে আসে বলে মনে করা হচ্ছে।
সেখানেই বিশ্বভারতীর অনুষ্ঠানে রাজ্য সরকারের সরাসরি অংশগ্রহণ যে কেন্দ্রীয় সরকার ভালােভাবে নিচ্ছে না তা হয়তাে স্পষ্ট হয়ে যায়। আর তারপরই শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবে রাজ্য সরকারের সরাসরি অংশগ্রহণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যথেষ্টভাবে ওয়াকিবহাল হওয়ার পরেই হয়তাে করােনাভাইরাসের প্রসঙ্গকে সামনে এনে সমগ্র অনুষ্ঠান বাতিলের মতাে নির্দেশিকা দিয়ে দেয়। যেখান থেকে আর পিছিয়ে আসার পথ খােলা ছিল না বিশ্বভারতীর কাছে।