পার্থময় চট্টোপাধ্যায়
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই কবিতাটা মনে আছে নিশ্চই সকল ইলিশ প্রিয় বাঙালির মনে! ছেলেবেলায় পড়েছিলাম আর এখনো মনে আছে এই কবিতার প্রতিটা শব্দ প্রতিটা লাইন৷ কারণ , এটা ইলিশের প্রতি প্রেমের সম্পর্ক আমার মতো মেছো বাঙালির কাছে৷ কবিতাটা হচ্ছে …
ইলশে গুঁডি়! ইলশে গুঁডি়
ইলিশ মাছের ডিম|
ইলশে গুঁডি় ইলশে গুঁডি়
দিনের বেলায় হিম
বর্ষাকালে আমাদের কলকাতা শহরের চারপাশটায় ইলিশ মাছের জমজমাট সমাবেশ হয়৷ বাজারে গিয়ে ইলিশ মাছ দেখা বা কেনা আর গঙ্গার ধারে হিমেল বাতাসে ইলিশমাছের ডেরায় গিয়ে ইলিশ মাছ কেনার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে৷ খোদ কলকাতার গঙ্গাঘাটেও ইলিশের আমদানি হয় তবে সেই মাছ গুলোর দাম আকাশ ছোঁয়া৷ কলকাতার বিখ্যাত ঘাটগুলোতেও ইলিশ কখনো সখনো ধরা পরে বাগবাজার ঘাট যেখানে এই ঘোর বর্ষায় ইলিশ মাছের প্রবেশ ঘটে আর এখানকার ইলিশের চাহিদা ও দামের কোনো শেষ বলে কিছু নেই, এই তো গতবছর হাওড়ার উলুবেড়িয়া ঘাটে একটা আড়াই কেজি ইলিশ ধরা পরে, যার দাম উঠেছিল আট হাজার টাকা৷
আমি এতো কেন ইলিশের গল্প করছি বলুনতো? কারণ আজ আমি শনিবারের সকালে চলেছি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন মাছের ডেরায় রুপালি শস্যের সন্ধানে৷ স্বায়ত, আহান আর আমি আলোচনায় বসলাম কোন ডেরায় যাবো! দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় বেশ কিছু রুপালি শস্য ভান্ডার আছে… নামখান, কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার, রায়দিঘি অথবা বজবজের নোদাখালি এই গুলো বর্ষা কালে ইলিশের ডেরা৷
যাদবপুরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাটুলি বাইপাস ধরে কামালগাজি ব্রিজ দিয়ে এসে বারুইপুর বাইপাস দিয়ে আমতলা হয়ে ৪৭ কি মি পথ পেরিয়ে ডায়মন্ড হারবার পুণ্যলক্ষ্মী রিসর্ট এ সোজা পৌঁছালাম ১১.৩০ মিনিট নাগাদ৷
লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে চললাম সাগরিকার সামনের মাছের ডেরায়, সাগরিকা হোটেল পেরিয়ে এক জায়গায় পরপর পাঁচটা মাছের অস্থায়ী আড়ৎ বসেছে৷ এখানে গাড়ি থেকে নামলে এক রেট আর রিক্সা বা পায়ে হেটে গেলে একটু কম রেট৷ মাছের দর দাম করলাম অনেক দামাদামি করে ৭০০ আর ১০০০ টাকা কেজিতে দাম স্থির করলাম ও বললাম দুপুর ৩ কি ৪ টের সময় এসে নেবো৷ ডায়মন্ডহার্বারে মাছের আসল বাজার হলো নগেন্দ্রবাজার, এটা মূলত পাইকারি আড়ৎ , এখান থেকে পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের নানা জায়গায় মাছ পাঠানো হয় এমনকি বিদেশেও মাছ রপ্তানি করা হয়৷
এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহতম বাজার এটি৷ প্রতিদিন প্রায় ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার কেনাবেচা হয় এই বাজারে৷ বিকেল থেকে মাঝ রাত্রি পর্যন্ত এই বাজার গমগম করে মাছ ব্যবসায়ীদের আনাগোনায়৷
এখানে বেশিরভাগ মাছই সামুদ্রিক মাছ যেমন – ইলিশ, পমফ্রেট, চিংডি়র, লোটে, ম্যাকরেল, ভোলা এই সব মাছ আর থাকে নদীর মাছও বিক্রি হয়৷ তবে এই বাজারে এক দু পিস মাছ নিলে পাত্তা পাবেন না বা দামের সুবিধা পাবেন না৷
আবার ফিরেছিলাম পুণ্যলক্ষীর দিকে৷
আহাহা কি সুন্দর গঙ্গাকে লাগছে… ওপারে পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া শহর৷ নদীর বুকে একটা জাহাজ ভাসছে আর তার ঢেউয়ের দাপটে ডিঙি নৌকাগুলো উপর উঠছে আর নিচে নামছে৷ হাজীপুর থেকে নাম হয়েছে ডায়মন্ডহারবার৷
হজযাত্রীদের জাহাজ নোঙর করা হত এখানে ৷ এই জায়গার উন্নতি হয় ব্রিটিশদের সময়৷ এখানে একটা কেল্লা ছিল , তার অস্তিত্ব সামান্য এখনো টিকে আছে বাকি সবটাই গঙ্গার পেটে চলে গেছে৷ ব্রিটিশদের আগে পর্তুগিজরা এখানে ঘাঁটি গেড়ে ছিল৷ পরে ব্রিটিশরা এই জায়গার দখল নেয়৷ বৃষ্টির মরসুমে ডায়মন্ড হারবার এক অপরূপ চেহারা নেয় ৷ সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মোহময় দৃশ্য মুগ্ধ করে৷ পুণ্যলক্ষ্মীতে ফিরে দেখলাম খাবার রেডি হচ্ছে৷
ওদের সুবিশাল ও সাজানো লন এর গঙ্গার ধারের চেয়ার গুলো দখল করলাম . এক মনে দেখছি , কেমন গঙ্গা গুটি গুটি পায়ে সমুদ্রের কাছে ধরা দিতে চলেছে… গঙ্গার ওপারটাতে হলদিয়া শহর, বাষ্পীয় চশমা থেকে দেখার মতো ঝাপসা লাগছে, দুএকটা ছোট জাহাজ, জেলেদের নৌকো আর মাল বহনকারী বার্জ চলেছে তাদের গন্তব্যতে৷ ভারী সুন্দর পুণ্যলক্ষী রিসর্ট, এর এইটাই সব থেকে ভালো জায়গা৷
এদের রান্না বান্না অসাধারণ, ভাত ডাল, বেগুন ভাজা, আর ইলিশ মাছ ,চিংড়ি মাছ এসব খেলাম ৫৫০ টাকা করে এক একজন ৷ এখানে থাকার খরচ DAB ২০০০ টাকা থেকে শুরু৷ এখান থেকে বিকেলে ৪ টা নাগাদ সাগরিকা হোটেলের কাছে সেই মাছের ডেরায় গেলাম৷ একটা ১২০০ গ্রাম ওজনের মাছ ১২০০ টাকা আর একটা ৮০০ গ্রাম ওজনের মাছ ৭৫০ টাকায় নিয়ে কলকাতার দিকে রওনা হলাম৷
ডায়মন্ডহারবার রোড কলকাতার বুকে একমাত্র জাতীয় সড়ক৷ খিদিরপুর থেকে শুরু করে এই ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক ডায়মন্ডহারবার এ শেষ হয়েছে৷ আমতলার বিখ্যাত জ্যামে প্রায় আধা ঘন্টা আটকে থেকে বারুইপুর আমতলা রাস্তা ধরে ডেরায় পোঁছালাম রাত্রি আটায়৷ মেঘ মাথায় নিয়ে বেরিয়েছিলাম আর বৃষ্টি ঝরা সন্ধ্যা নিয়ে বাড়ি ঢুকলাম৷
শিয়ালদাহ থেকে ডায়মন্ডহারবার লোকাল প্রতিদিন মুহুর্মুহু যাতায়াত করে মৎস্য নগরীতে৷ থাকার অজশ্র হোটেল , তবে কলকতার মানুষ বেশিরভাগই একদিনে ঘুরে আসে ডায়মন্ডহারবার থেকে৷