• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

বিধ্বস্ত সুন্দরবনকে স্বাভাবিক করে তুলতে হবে : মমতা

৬ হাজার কোটি টাকা মাসিক আয় বন্ধ। করোনা মোকাবিলার টাকা এখনও আসেনি। ভয়ানক ক্ষতি সামলাতে ১ লক্ষ কোটি টাকা প্রয়োজন। ৬ মাস আগে বুলবুল এসেছিল সুন্দরবনে। তার আগে আয়লা।

আম্ফানে উপড়ে পড়া গাছ পরিষ্কার করছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। (Photo by Dibyangshu SARKAR / AFP)

একসঙ্গে চারটি বিপর্যয়ের মোকাবিলা। চার রকমের চ্যালেঞ্জ। করোনা, লকডাউন, পরিযায়ী শ্রমিক, বিধ্বংসী আম্ফান। জেরবার সরকার। ৬ হাজার কোটি টাকা মাসিক আয় বন্ধ। করোনা মোকাবিলার টাকা এখনও আসেনি। ভয়ানক ক্ষতি সামলাতে ১ লক্ষ কোটি টাকা প্রয়োজন। ৬ মাস আগে বুলবুল এসেছিল সুন্দরবনে। তার আগে আয়লা।

সব ক্ষত এখনও শুকোয়নি। সামলাতে যে অর্থের প্রয়োজন, যা পাওয়ার কথা, তা সবটা এসে পৌঁছয়নি। এরই মধ্যে ভয়াবহ আম্ফানের তাণ্ডবে সুন্দরবন সহ রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

৬ কোটি মানুষ আম্ফানের কবলে। মাথা ঠান্ডা রেখে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। আম্ফানের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় কোন বিভাগের কত ক্ষতি হয়েছে তা প্রতিটি বিভাগ একসঙ্গে সমীক্ষা করবে। সবার সঙ্গে সবার সমন্বয় থাকবে। সাতদিনের মধ্যে রিপোর্ট চাই।

শনিবার সকালে ঝড়ের দাপটে তছনছ সুন্দরবন পরিদর্শন করে, দুপুরে কাকদ্বীপে প্রশাসনিক বৈঠকে একথা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলার সাংসদ চৌধুরিমা জাটুয়া, প্রতিমা মণ্ডল, শুভাশিস চক্রবর্তী, সভাধিপতি শামিমা শেখ সহ সুন্দরবনাঞ্চলের বিধায়ক প্রতিটি দফতরের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক আধিকারিকমন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা, জেলাশাসক, জেলার পুলিশ সুপার ও রাজ্য পুলিশের ডিজি’কে নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী প্রত্যেককে ধরে ধরে বুঝিয়ে দিলেন, কোন কাজটা কীভাবে দ্রুত করতে হবে।

এদিন মুখ্যমন্ত্রী ঝড়ের সময় জেলা প্রশাসন যে ভালো কাজ করেছে, তা বলার সঙ্গে বুঝিয়ে দেন, ভেঙে পড়া কাঁচা বাড়িকে আংশিক ভাঙা বলা যায় না। পাকা বাড়ির ক্ষেত্রে আংশিক বলা চলে। মাটির কঁচা বাড়ি ভাঙা মানে পুরোটাই ভাঙা। এগুলো নতুন করে করতে হবে। পান বোরজের একাংশ হয় না, পুরোটা ভেঙেছে, এভাবে ভাবতে হবে।

মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, সবচেয়ে আগে বাড়িগুলি ঠিক করতে হবে। তারপর রাস্তা। পানীয় জল বিদ্যুতের সমস্যা মেটাতে জরুরি ভিত্তিতে জেনারেটর ভাড়া করে কাজ করতে হবে। মেশিনে পানীয় জল তৈরি করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বাড়িতে সবকিছু স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত কিছুদিন রান্না খাবার দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য বেশকিছু কমিউনিটি কিচেন করা দরকার।

আর এ কাজে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাহায্য নেওয়া হবে। চাল, ডাল, আলু, তেল, খাবার সরকার দেবে। ভারত সেবাশ্রম সংঘ রান্না করে তা বিতরণের ভার নেবে তাদের স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে ভারত সেবাশ্রম সংঘ এই কাজ করছে উত্তর ২৪ পরগনায়।

এদিন প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক আধিকারিকদের বলেন, কোনও অভিযোগ যেন ত্রাণ নিয়ে না হয়। ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবনকে দ্রুত ঠিক করতে, পরিচ্ছন্ন রাখতে ১০০ দিনের কাজ যারা করে, তারা ছাড়াও স্থানীয় ছেলেদের নিয়ে কাজ করতে হবে। পুকুর পরিষ্কার, গাছ কাটা, বিদ্যুৎ দফতরের পোল সরানো, বসানোর জন্য গর্ত করা ইত্যাদি।

এগ্রিকালচার, হর্টিকালচার, ফিশারি, পশু পালন দফতর, পঞ্চায়েত, স্বাস্থ্য, পশু চিকিৎসা, ফুড সাপ্লাই সব বিভাগ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখতে একসাথে সমীক্ষা করবে। এই সময়ে নানা ধরনের অসুখ, জ্বর, পেটখারাপ, সাপে কামড়ানোর ব্যাপার হয়ে থাকে। এসবের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিটি রোগের ওষুধ যেন মজুত থাকে। এদিন ঝড়ে মৃত পাঁচজনের পরিবারের হাতে মুখ্যমন্ত্রী আড়াই লক্ষ টাকার চেক তুলে দেন।

আম্ফান ঝড়ের ধাক্কায় বিধ্বস্ত সুন্দরবনের গাছপালা, ম্যানগ্রোভ বাদাবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গাছ লাগানোর দায়িত্বে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, বম দফতর ও পরিবেশ দফতরের ওপর। জানা গেল, ৩১০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা বিপর্যস্ত। ৪১ হাজার ৬৬৭ টি বিদ্যুতের পোল ভেঙেছে। বিদ্যুৎহীন সুন্দরবন।

এদিন মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, বাম আমলেই বিদ্যুৎ বণ্টন প্রাইভেট সংস্থার হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওরাই সবটা দেখে। বিদ্যুৎ না থাকায় সুন্দরবনের মানুষের মতো শহরের মানুষও বিপাকে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও টিভি দেখতে পারছেন না। তবে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ দফতর ও রাস্তাঘাট তৈরির ব্যাপারে কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলেছে।

রেশন ব্যবস্থা চালু রাখতে বিপর্যস্ত মানুষের কাছে রেশন পৌঁছে দিতে প্রয়োজনে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা কাজ করবে। পশুরাও যাতে খাদ্য ও চিকিৎসা পায়, তা দেখতে বললেন জেলাশাসককে। আইসিডিএস-এর মেয়েরাও যেন বাচ্চাদের খাবার প্রতিষেধক টীকা দেওয়ার ওপরে নজর রাখে।

স্কুলের ছাত্রদেরও ইউনিফর্ম, ব্যাগ, বই দিতে হবে এডুকেশন ডিপার্টমেন্টকে। স্কুল বাড়িও মেরামত করে দেবে। সার্ভে করেই এ কাজ করবে বিভাগীয় দফতর। সংখ্যালঘু ও তপশিলি উপজাতি দফতরগুলিও তাদের বিভাগের বরাদ্দ অর্থ এই সময়ে খরচ করবে প্রাপকদের সমস্যা দূর করতে।

এদিন মুখ্যমন্ত্রী কাকদ্বীপের প্রশাসনিক বৈঠকে জানিয়েছেন, সরকারি সব বাস চলবে। একটাও বসে থাকবে না। স্যানিটাইজ করে পথে বেরোবে। এই সময়ে বাসের ভাড়া বাড়ানো হবে বলা যায় না। আর কোনও বড় প্রজেক্ট নয়, ছোট ছোট করে সব কাজ হবে। প্রয়োজনে ভাঙা ছোট রাস্তা ইট দিয়ে হবে।

সবদিক দিয়ে বিধ্বস্ত সুন্দরবনকে স্বাভাবিক করে তুলতে হলে সব বিভাগকে কাজ করতে হবে। কে কীভাবে কাজ করছে সমস্যা কোথায় কী করা প্রয়োজন, তা ফিল্ড অফিসার, বিধায়ক, পঞ্চায়েত প্রতিনিধি, ভিলেজ কমিটির প্রতিনিধিদের থেকে জেনে নেবেন জেলাশাসক তিনদিন অন্তর ভিডিও কনফারেন্স করে। প্রয়োজনে প্রতিদিন সন্ধ্যায় খোঁজ নেবেন। জানা গেল, ঝড়ে দশ লক্ষ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। ডায়মন্ড হারবারে দেড় লক্ষ বাড়ি ভেঙেছে।

এদিন মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্যের এক হাজার কোটি ও কেন্দ্রের এক হাজার কোটি দিয়ে কাজ শুরু হলেও ১ লক্ষ কোটি টাকার দরকার সব ঠিক করতে। কেন্দ্রীয় দল এলে যেন সবরকম সহযোগিতা করে জেলা প্রশাসন, জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বোঝালেন এই মুহূর্তে কারও কোনও সমালোচনা নয়, দুর্যোগে পড়ে দুর্ভোগে থাকা মানুষদের পাশে থাকতে হবে। এমন ভয়ঙ্কর ঝড় তিনি তাঁর জীবনে দেখেননি।

জানালেন, ১১ লক্ষ কিষাণ কার্ড সরাসরি রাজ্য প্রশাসন থেকে হবে নোডাল অফিসারদের মাধ্যমে। পুলিশের উদ্দেশেও মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, চুরি, ছিনতাই যাতে না হয় দেখতে হবে। সুন্দরবনকে গড়ে তোলার জন্য যেমন জেলাশাসকের পাশে থাকতে হবে, তেমনই দেখতে হবে এই সময়ে যেন নারী পাচার না হয়।

এদিন মুখ্যমন্ত্রী জেলার বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা, সমীর জানা, যোগরঞ্জন হালদার, সওকত মোল্লা, মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা, গিয়াসুদ্দিন মোল্লা, সভাধিপতি শামিমা শেখের কাছ থেকে এলাকাভিত্তিক খোঁজখবর নেন। বিদ্যুৎ, পানীয় জল, নদীবাঁধ সংরক্ষণ আপাতত ঘরের জন্য ত্রিপলের দাবি ওঠে। মুখ্যমন্ত্রীর দক্ষ প্রশাসনিক মুখ জানিয়ে দেয়, সব হবে। কাজে নেমে পড়ো।