বর্ষাকালিন নিষেধাজ্ঞা জারি স্বত্ত্বেও
আমিনুর রহমান , বর্ধমান, ১১ জুলাই: এখন আর নদী থেকে বালি তোলা যাবে না, সরকারীভাবে বর্ষাকালীন এই নিষেধাজ্ঞাই জারি করা হয়েছে পূর্ব বর্ধমানে। তারই মাঝে কিন্তু নদী থেকে বালি চুরি করে মজুদ করার অভিযোগ ঘিরে চাঞ্চল্য ছড়ালো দক্ষিণ দামোদর লাগোয় এলাকায়। অভিযোগ বেআইনি বালি মজুত করে সেই বালি রাতারাতি ভিন জেলার চালান ব্যবহার করে পাচার করে দিচ্ছে এক শ্রেনীর বালি মাফিয়ারা। দিনের পর দিন দামোদর নদ থেকে এই বালি চুরি চললেও জেলা প্রশাসন সম্পূর্ন নির্বিকার বলে দাবি স্থানীয়দের।
পূর্ব বর্ধমান জেলার দামোদর নদের পার্শ্ববর্তী বর্ধমান, গলসি, খন্ডঘোষ, জামালপুর, বড়শুল, পাল্লা এলাকায় এই বালি মজুত এর ঘটনা ঘটেছে। ওই সব এলাকায় এখন বিভিন্ন জায়গায় বালির পাহাড়।অভিযোগ, প্রায় সব জায়গাতেই শাসক দলের কিছু প্রভাশালী নেতার মদত রয়েছে এই বালি চুরি করে মজুত করার পিছনে। কোথাও পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য , কোথাও শাসক দলের অঞ্চল সভাপতি, পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপ প্রধান আবার কোথাও বিধায়ক ঘনিষ্ট পঞ্চায়েত উপ প্রধানের মদতে চলছে এই বেআইনি বালির কারবার বলে স্থানীয় সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
মাসের পর মাস ধরে খন্ডঘোষ এলাকায় দামোদর নদের বিভিন্ন জায়গা থেকে বেআইনি ভাবে বালি তুলে পাচার ও মজুত চললেও ব্লক ভূমি রাজস্ব দপ্তর বা পুলিশ কেউই তা আটকতে পারেনি বলে অভিযোগ। সূত্রের খবর, খন্ডঘোষের কামালপুর থেকে কুমিরখোলা পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বেআইনি ভাবে প্রায় ২৫ – ৩০ টি জায়গায় বালি মজুত করেছে এক শ্রেনীর বালি মাফিয়ারা। যেখানে সরকারি ভাবে ১৪ টি বালি মজুত করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। প্রশাসন নাকি এইসব অনিয়মের কিছুই টের পায়নি এতদিন! মাঝে মধ্যে বেআইনি বালি খাদে রুটিন অভিযান চালালেও বালি চুরিতে যুক্ত কাউকেই নাকি ধরা যায়নি কোনোদিন। তবে বিনা চালানে বালি নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে পুলিশ রাস্তায় কিছু গাড়ি আটক করে মামলা দায়ের করেছে।
এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চলতি মাসের ৪ তারিখ থেকে বর্ষাকালীন নদ নদী থেকে বালি উত্তোলন বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও খন্ডঘোষের সালুন, নারিচা এলাকায় বেআইনি ভাবে নদী থেকে বালি তোলার কাজ চলছে। এই নিয়ে বৈধ বালি খাদ মালিকরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর দু একটা অঞ্চলে পুলিশ বালি তোলার কাজ বন্ধ করে দেয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এইসবই এক ধরনের ‘ আই ওয়াশ ‘ মাত্র।
কারণ সারাবছর নদ নদী থেকে যখন বেআইনি ভাবে বালি তুলে মজুত করার কাজ করছিল বালি মাফিয়ারা, তখন প্রশাসনের কোন হেলদোল ছিল না। যে যার ইচ্ছা মতো নদী থেকে বালি চুরি করে মজুত করে নিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, মাসের পর মাস নাগারে নদী থেকে বালি চুরির পিছনে অন্য রহস্য থাকতে পারে। কারণ যারা চুরি করছে তাদের সঙ্গে প্রশাসনের একাংশের বোঝাপড়া না থাকলে এই কাজ টানা করে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে মেমারি থানার পাল্লা এলাকায় কোন বৈধ বালি খাদ না থাকলেও নুদিপুর থেকে দেবীপুর জিটি রোড মোড়ে কাছে, পালশিট প্ল্যান্টের কাছে, পাল্লা স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়, কাজিপাড়া বেলুট, মেমারি কদমপুকুর রোড এলাকায় বিশাল বিশাল বালির পাহাড় তৈরি করেছে কিছু অবৈধ বালি কারবারিরা। এর আগেও পাল্লা এলাকায় অবৈধ বালি খাদান চালানোর অভিযোগে একাধিকবার প্রশাসন ও পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবার অজ্ঞাত কারণে বালি মাফিয়ারা বেপরোয়া হয়ে বালি চুরি করে পাচার করেছে।
তবে ভূমি দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যেই বালি মজুতের সঠিক পরিমাপ করার জন্য প্রশাসনিক অভিযান শুরু করা হয়েছে। যদি কোথাও বেআইনি ভাবে বালি মজুদের অস্তিত্ব পাওয়া যায় সেই মজুতের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রশাসন অভিযান চালিয়ে সেই সমস্ত বেআইনি মজুত বালি পরিমাপ করে সেগুলোর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করবে। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে সেই সব মজুত বালির ই-অকসন করবে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তর। আর যে কেউ সেই বালি তখন দেড় থেকে আড়াই গুণ পর্যন্ত জরিমানা মিটিয়ে সরকারি অনুমোদন নিয়ে বিক্রি করার অনুমতি পাবে। এই পদ্ধতিতে বিগত ২১ – ২২ অর্থবর্ষে জেলা ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তর ই-অকশন করে প্রায় ৩২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছিল। সরকারি অনুমোদিত বালি খাদ মালিকদের একাংশ রীতিমত ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এই ব্যবস্থায় তাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সরকারকে কোটি কোটি টাকা দিয়ে বালি তোলার অনুমতি পেতে হয় তাদের। এদিকে এক শ্রেনীর লোক বেআইনি ভাবে নদী থেকে বালি চুরি করে মজুত করে রেখে দিয়ে পড়ে সেই বালিই তিনগুণ, চারগুণ বেশি দামে বাজারে বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। প্রশাসন কে জানিয়েও সবসময় কাজ হচ্ছে না। এইসব বন্ধ হওয়া দরকার।