• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

রাতেই আছড়ে পড়তে পারে ‘দানা’

প্রস্তুত প্রশাসন, বাতিল বহু ট্রেন, বিমান

বুধবার ভোরেই বঙ্গোপসাগরে জন্ম নিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’। মঙ্গলবার পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরের উপরে যে গভীর নিম্নচাপ অবস্থান করছিল, তা ঘণ্টায় ১৮ কিলোমিটার বেগে এগিয়ে একই অঞ্চলের উপরে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। ২৪ তারিখ ভোরে এটি উত্তর ও উত্তর–পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। আবহাওয়াবিদরা আরও জানাচ্ছেন, ওড়িশা উপকূলে ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে আছড়ে পড়বে ‘দানা’। পুরী ও সাগরদ্বীপের মাঝামাঝি ওড়িশার ভিতরকণিকা ও ধামারা দিয়ে স্থলভাগে ঢুকবে এই ঘূর্ণিঝড়। ‘দানা’ মোকাবিলায় আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রস্তুতি মতো কাজ শুরু করেছে কলকাতা পুলিশ থেকে শুরু করে পুরসভা। এই ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে বাতিল করা হয়েছে একাধিক ট্রেন। রেলের তরফেও বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তুত দমকলও। জানা গিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের জেরে জল জমতে পারে শহরের নিচু এলাকায়। ব্যাহত হতে পারে বিদ্যুৎ পরিষেবা। এমনকী যান চলাচলও বিঘ্নিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র কারণে কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ১৫ ঘণ্টা বিমান চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত বিমান পরিষেবা বন্ধ থাকবে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ৯ জেলার জেলাশাসককে নিয়ে বুধবার বিকেলে জরুরি বৈঠক করলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। এই ৯টি জেলা হল, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া, এবং ঝাড়গ্রাম। এদিনের এই বৈঠকে সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে শিবিরে রাখা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি কালীপুজোর মণ্ডপগুলির বাঁধন যাতে কোনওভাবে আলগা না হয় সেই দিকেও বিশেষ নজর দেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে। ঝাড়গ্রামে ঝড়ের প্রভাব বেশি পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই এই এলাকায় গাছ পড়ে গেলে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা নিয়েও নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যসচিব।

পূর্ব রেলের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। দানার কারণে শিয়ালদহ দক্ষিণ বিভাগ এবং বারাসত-হাসনাবাদ বিভাগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত বন্ধ থাকছে ট্রেন পরিষেবা। প্রবল দুর্যোগের আশঙ্কায় এবং যাত্রী সাধারণের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে ইতিমধ্যেই দূরপাল্লার একাধিক ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ৮ টা থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত শিয়ালদহে কোনও লোকাল ট্রেনই চলবে না বলে জানা গিয়েছে।
রেলের তরফে কৌশিক মিত্র জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকছে ট্রেন চলাচল। পাশাপাশি, বৃহস্পতিবার সন্ধে ৭টা থেকে পরের দিন সকাল ৯টা পর্যন্ত দক্ষিণ শাখার কোনও স্টেশন থেকে শিয়ালদহের উদ্দেশে কোনও ট্রেন ছাড়বে না। মোট ১৯০টি লোকাল ট্রেন বাতিল করা হয়েছে।

বাতিল ট্রেনের তালিকায় রয়েছে, কলকাতা-পুরী (২৪ অক্টোবর) এবং পুরী, কলকাতা (২৫ অক্টোবর), ডিব্রুগড়-কম্যাকুমারী (২৩ অক্টোবর), কন্যাকুমারী-ডিব্রুগড় (২৩ অক্টোবর) সেকান্দ্রাবাদ-মালদহ (২৪ অক্টোবর), মালদহ-সেকেন্দ্রাবাদ (২৯ অক্টোবর), পুরী-জয়নগর (২৪ অক্টোবর) এবং শিয়ালদহ-পুরী দুরন্ত এক্সপ্রেস (২৩ অক্টোবর), পাটনা-পুরী এক্সপ্রেস (২৪ অক্টোবর), শিলচর-সেকেন্দ্রবাদ (২৩ অক্টোবর), বেঙ্গালুরু-মজফফরপুর (২৪ অক্টোবর), মালদহ-দিঘা (২৪ অক্টোবর), দিঘা-মালদহ (২৪ অক্টোবর), আসানসোল-হলদিয়া এবং হলদিয়া-আসানসোল (২৪ ও ২৫ অক্টোবর)।

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র প্রভাবে কলকাতা সহ উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে টানা চারদিন ধরে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বুধবার ও শনিবার হালকা বৃষ্টি হলেও মাঝখানের দুইদিন বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চাইছে লালবাজার। সেই জন্য গাছের নিচে যেন কোনও গাড়ি পার্ক করা না হয়, সেই বিষয়ে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ট্রাফিক গার্ডগুলিকে। একই সঙ্গে বুধবার দুপুর থেকেই কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লালবাজারে খোলা হয়েছে ‘ইন্টিগ্রেটেড’ কন্ট্রোলরুম। সেখানে কলকাতা পুলিশের পাশাপাশি যেমন রয়েছেন কলকাতা পুরসভার কর্মীরা, ঠিক একই ভাবে রয়েছে দমকল, পূর্ত দপ্তর, কেএমডিএ, বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর, সিইএসসি, এনডিআরএফের প্রতিনিধিরা।

ইতিমধ্যেই ঝড়ের আশঙ্কায় তৈরি করা হয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর বিশেষ দল। লালবাজার সূত্রে খবর, কলকাতা পুলিশের দশটি ডিভিশনে এই দল পাঠানো হবে। যেখানে থাকবে ৮–১০ কর্মী। অন্যদিকে ঝড়ের সময় বিপদে পড়লে সাধারণ মানুষ যাতে চটজলদি সুরাহা পান, সে জন্য চালু করা হয়েছে হেল্পলাইন নম্বর। সেগুলি হল- ৯৪৩২৬১০৪৪৪, ৯৪৩২৬১০৪৩০। উল্লেখ্য, ঝড়ের কারণে কলকাতায় সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গঙ্গাতীরবর্তী এলাকা। যার বেশিরভাগটাই কলকাতা পুলিশের পোর্ট ডিভিশনের অন্তর্গত। সেক্ষেত্রে মানুষকে সাবধান করতে সকাল থেকেই ঘাটে ঘাটে মাইকিং এবং নজরদারি চালিয়েছে কলকাতা পুলিশ। তবে শুধু ট্রাফিক কিংবা কলকাতা পুলিশের অন্তর্গত সমস্ত থানা নয়, দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত রিভার ট্রাফিক পুলিশও। বুধবার সকাল থেকেই গঙ্গার ঘাটে ঘাটে টহল শুরু করেছে রিভার ট্রাফিক পুলিশ। একই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে গঙ্গায় স্নান এবং মাছ ধরতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও। লালবাজার সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, শহরে মোট কত বিপজ্জনক বাড়ি রয়েছে তার তালিকা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। সেই সব বাড়িতে কত পরিবার বাস করে তার তালিকাও প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রয়োজনে তাঁদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। পাশাপাশি, কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে প্রতিমুহূর্তে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে। ঝড়ের দাপটে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে, যাতে সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার কাজ চালানো যায়, সেই কারণেই এই ব্যবস্থা বলে জানাচ্ছেন কলকাতা পুলিশের এক কর্তা।

অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় দানা নিয়ে আরও তৎপর হল কলকাতা পুরসভা। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। সেখান থেকে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি চলছে। পুরসভার জরুরি বিভাগের কর্মীদের সমস্ত ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বুধবার দুপুর দু’টো থেকে শনিবার পর্যন্ত চরম সতর্কতা অবলম্বন করছে পুরসভা। জরুরি ভিত্তিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

পুরসচিবকে নোডাল অফিসার করে ব্যুরো ও ওয়ার্ড ভিত্তিক বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় নিকাশি, বিদ্যুৎ, আলো, উদ্যান, স্বাস্থ্য এবং জঞ্জাল অপসারণ বিভাগকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছে পুরসভা। কোনও বিপত্তি ঘটলে পুরসভার কন্ট্রোল রুমের যোগাযোগের নম্বর— ২২৮৬১২১২, ২২৮৬১৩১৩ এবং ২২৮৬১৪১৪-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন সাধারণ মানুষ।

এছাড়াও রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার হেল্পলাইন নম্বর ৮৯০০৭৯৩৫০৩, ৮৯০০৭৯৩৫০৪ এবং সিইএসসি-র হেল্পলাইন নম্বর ০৩৩-৩৫০১১৯১২/৪৪০৩১৯১২, স্পেশাল হেল্পলাইন ৯৮৩১০৭৯৬৬৬।

দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে শহরের বিভিন্ন স্থানে লাগানো অস্থায়ী বাঁশের কাঠামো, হোর্ডিং ও ব্যানার খুলে ফেলা হয়েছে। ৬০০-এর বেশি অস্থায়ী বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং খুলে নিয়েছে কলকাতা পুরসভা। বিজ্ঞাপন ফি-র তিনগুণ জরিমানা করেছে পুরসভা। ইতিমধ্যেই জরিমানার চিঠি পাঠানো হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দুর্ঘটনা এড়াতে তড়িঘড়ি এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি পুরসভা আধিকারিকদের। শহরের রাস্তাঘাট, ফুটপাথ এবং নিকাশি ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের আধিকারিকদের। রাস্তার দু’পাশে বিপজ্জনক অবস্থায় থাকা গাছের দুর্বল ডালপালা কেটে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কলকাতা সংলগ্ন নিচু অঞ্চলে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুর্যোগ কবলিত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য এবং জল মজুত রাখা হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়কে কেন্দ্র করে পাওয়ার ব্যাকআপ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উপরে জোর দিতে নির্দেশ দিয়েছে পুরসভা। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়কে ঘিরে মাইকিং করে জনসচেতনতামূলক প্রচার করা হচ্ছে। বিভ্রান্ত না হয়ে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত মাধ্যমে দুর্যোগ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত থাকতে আবেদন করেছে কলকাতা পুরসভা। জরুরি ব্যবস্থাপনা পরিচালন করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব মোকাবিলায় ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়াও স্টেট ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম গঠন করে রাখা হয়েছে। কলকাতা পুরসভার কন্ট্রোল রুম ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকছে। তৈরি রাখা হয়েছে ২৮১টি নিকাশি যন্ত্র। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ৪৫২টি পাম্প সক্রিয় রাখা হয়েছে। হাইড্রোলিক ল্যাডার-সহ একাধিক যন্ত্রপাতিও প্রস্তুত রয়েছে। আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, ল্যান্ডফলের সময় এই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটারের কাছাকাছি পৌঁছনোর সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে, আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, ল্যান্ডফলের সময়ের পরিস্থিতির ওপর অনেকখানি নির্ভর করে ঝড়ের মাপকাঠি। তাই আগে থেকে সবটা হয়তো নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবু আমফানের চেয়ে ‘দানা’র প্রভাব অনেক কম হবে।