• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

নানা নামে ঘূর্ণিঝড় আসে, বার বার সর্বস্ব কেড়ে নেয়

এই অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত এক নতুন প্রশ্ন তুলে ধরে—কতটা আঘাত সহ্য করা যায়? আর কতবার ভেঙে পড়ে নতুন করে শুরু করা যায়?

আমফান, ফণী, ইয়াস এবং বর্তমানে দানা–ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড়গুলির ভয়ংকর স্মৃতি সাধারণ মানুষের মনে এখনও দগদগে। বছরের পর বছর নতুন নতুন ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কায় বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষের জীবন। বছরের পর বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য ঘূর্ণিঝড় শুধুই একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি এক অমোঘ অভিশাপ, যা তাঁদের জীবন, স্বপ্ন, এবং সংগ্রামকে বারবার ভেঙে চুরমার করে দেয়। তাঁরা জানে, এটা তাঁদের কাছে জীবন–মৃত্যুর লড়াই। ঘরের চাল, মাটির দেয়াল, কিংবা কৃষি জমি—সবকিছু হারানোর ভয় তাঁদের বুকের গভীরে জমা হয়, তবে প্রকৃতির নির্মমতার সামনে তাঁরা অসহায়। প্রতিটি ঝড়ের পর বিধ্বস্ত গ্রামগুলো যেন এক গভীর শোকের ছায়ায় ঢেকে যায়, যেখানে মানুষের চোখে থাকে কেবল অনেক কিছু হারানোর কষ্ট আর অজানা কালকের ভয়।

তবুও, এই মানুষগুলো হাল ছাড়েন না। বারবার নিজেদেরকে নতুন করে গড়ে তোলেন। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গের উপকূল অঞ্চল বারবার ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রতিবারি উপকূলবর্তী এলাকার মানুষ প্রকৃতির নির্মমতার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করে যাচ্ছেন। ঘূর্ণিঝড় শুধু তাঁদের ভিটেমাটি, ফসল, জীবিকা কেড়ে নেয় না, কেড়ে নেয় তাঁদের আত্মবিশ্বাস, স্বপ্ন, আশা—সবকিছু। ঘূর্ণিঝড়ের আগে রাতের পর রাত জেগে ঝড়ের আতঙ্কে দিনযাপন করে ক্লান্ত তাঁরা।

২০২০ সালের ‘আমফান’ ঘূর্ণিঝড় যেন সেই বেদনাবিধুর চিত্রকে আরও তীব্র করে তুলেছিল। মানুষ জানত, কিছু একটার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, কিন্তু ঠিক কতটা প্রস্তুত হতে হবে, তা কল্পনাতীত ছিল। রাতের অন্ধকারে যখন ঝড় আছড়ে পড়ল, তখন বিদ্যুতের আলো নিভে গেল, তখন যেন গাছগুলো যেন মাটির সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। বহু মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ল, মাটির ঘরের দেয়ালগুলো বৃষ্টির জলে গলে গেল। কেউ জানত না, পরের সকালে তাঁদের জীবনে কী অপেক্ষা করছে।

২০২০ সালে আমফানের সময় পাঁচ বার ভিটে হারিয়েছেন মৌসুনী দ্বীপের পিন্টু মণ্ডল। বছর কয়েক আগে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ভিটে হারানোর পরে বাঁধের কাছে রাস্তার ধারে বাঁশ-ত্রিপল দিয়ে কুঁড়ে বানিয়ে কোনও রকমে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করেছিলেন পিন্টু। ‘দানা’র ধাক্কা সেই ঘর সামলাতে পারবে কি না, তা নিয়েই এখন চিন্তায় তিনি। বলছিলেন, ‘বার পাঁচেক ভিটে হারিয়েছি। এখন এই কুঁড়েঘরটাই সম্বল। তার মধ্যেই আবার ঝড় আসছে। তেমন ঝড় হলে তো কিছুতেই সামলানো যাবে না।’

পিন্টুর মতো এরকম বহু মানুষ অতীতে আয়লা, আমফান, ফণী, ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ে নিজেদের সর্বস্ব হারিয়েছেন। ফের কয়েক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দানা’র হানা তাঁদের স্মৃতিকে কোথাও না কোথাও উস্কে দিচ্ছে। তাঁদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, ‘আবার একটা ঘূর্ণিঝড়ে মাথার উপরে ঠাঁই হারিয়ে যাবে না তো?’

তবুও, এই ঘূর্ণিঝড়ের পর মানুষের মনে অদম্য় এক শক্তির জন্ম হয়। ঝড়ে বিপর্যস্ত হওয়ার পরেও বারবার তাঁরা ঘুরে দাঁড়ায়। নিজেদের ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া বাড়িঘর নতুন করে তৈরি করে আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখে তাঁরা। কারণ তাঁরা জানে জীবনচক্র কখনো থেমে থাকে না।

এই জীবনসংগ্রাম শুধু তাঁদের প্রতিদিনের বাস্তবতা নয়, এটি তাঁদের আত্মার সঙ্গে লেগে থাকা এক অদৃশ্য দাগ। তাঁদের এই অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত এক নতুন প্রশ্ন তুলে ধরে—কতটা আঘাত সহ্য করা যায়? আর কতবার ভেঙে পড়ে নতুন করে শুরু করা যায়?