পেরিয়ে গিয়েছে পাঁচদিন। এখনও অধরা মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ থানার লেবুবাগানে শিক্ষক পরিবার হত্যাকাণ্ডের আততায়ীরা। দশমীর সকালে নিজের বাড়িতে নৃশংসভাবে খুন হন পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক বন্ধু প্রকাশ পাল, তাঁর স্ত্রী বিউটি মণ্ডল পাল এবং একমাত্র ছেলে ছ’বছরের বন্ধু অঙ্গন পাল ওরফে আর্য।
ঘটনার চারদিন পর শুক্রবার রাতে এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সঞ্জয় সিং ঘটনার তদন্তে আসেন। সঙ্গে ছিলেন জেলা পুলিশ সুপার। ঘটনাস্থলে দীর্ঘক্ষণ ছিলেন এডিজি। ঘটনার দিন ওই শিক্ষক পরিবারের বাড়ি থেকে একজনকে পালিয়ে যেতে দেখেন স্থানীয় দুই বাসিন্দা পঙ্কজ সরকার এবং বিব্রত সরকার।
এডিজি ঘটনাস্থলে গেলে, সেই সময় সেখানে এই দুই প্রত্যক্ষদর্শীকেও ডেকে নেওয়া হয়। ডাকা হয়েছিল, শিক্ষক পরিবারে যিনি কাজ করতেন, সেই মহিলাটিকেও। কোথা দিয়ে কীভাবে সেই ব্যক্তিটি ওই শিক্ষকের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, তা দুই প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্তাকে জানান। শুক্রবার রাতেই জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার জানান, এই ঘটনায় চারজনকে আটক করা হলেও, দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম পুলিশ আধিকারিকরা বলতে চাননি।
এদিনই পুলিশ সুপার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ঘটনার তদন্তে সাহায্য করতে সিআইডি আসছে। একটি বিশেষ সুত্রে জানা যায়, যে দু’জনকে আটক করে তদন্তকারীরা এ মুহুর্তে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছেন, তাদের একজন মৃত শিক্ষকের ব্যবসায়িক বন্ধু এবং আরেকজন একেবারে কাছের আত্মীয়। মৃতের পরিবারের প্রায় সমস্ত আত্মীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করে বার বার এ দু’জনের নাম উঠে এসেছিল।
এদিকে ঘটনার পাঁচদিন পরে শনিবার সকালেই ঘটনার তদন্তে কলকাতা থেকে আসে সিআইডি’র একটি বিশেষ দল। সঙ্গে ছিল ফরেন্সিক দলের সদস্যও। নেতৃত্বে রয়েছেন সিআইডি’র স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট ইন্দ্র চক্রবর্তী। এই দলের সদস্যরা প্রথমেই খুন হওয়া ওই শিক্ষকের বাড়িতে যায়। বাড়ির ছাদে এবং চারপাশে চিরুনি তল্লাশি চালায়। খুনের সময় ব্যবহৃত অস্ত্রের খোঁজে এবং বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করতে ওই শিক্ষকের বাড়ির পিছনের জঙ্গলে ঢােকে সিআইডি দলের প্রতিনিধিরা। বাড়ির ছাদে রাখা কয়েকটি বস্তার জিনিসপত্র বের করে তারা দেখে। ঘরের মধ্যে ঢুকে বােঝার চেষ্টা করেন মৃতদেহগুলি কোথায় এবং কীভাবে পড়েছিল। কার দেহে কীরকম আঘাত ছিল, তা পুলিশকর্তারা সিআইডি’র প্রতিনিধিদের জানান।
বাড়ির ছাদ থেকে নীচের জঙ্গল এবং প্রতিবেশীদের কার কোথায় বাড়ি তা দেখার চেষ্টা করেন তারা। তদন্ত শেষ করে বাড়ি থেকে বেরনাের সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ইন্দ্র চত্রবর্তী বলেন, ‘একটা বড় ঘটনা ঘটেছে। সিআইডি তদন্তে এসেছে’। তাকে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে কি আজ থেকে সিআইডি তদন্তের দায়িত্ব নিল? উত্তরে তিনি বলেন, ‘না, তা নয়। এখানকার পুলিশ তাে তদন্ত করছে’। নমুনা পাওয়া গেল কিনা, প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সেটা বলা যাবে না। পুলিশ তাে এর আগে নমুনা সংগ্রহ করেছে। আর কিছু নমুনা আছে কিনা, তা দেখা হচ্ছে। তা ছাড়া ইতিমধ্যে যেগুলি তদন্ত হয়েছে, সেগুলিও দেখা হচ্ছে’। বিশেষ সুত্রে জানা যায়, ফরেন্সিক দলের সদস্যরা বাড়ির ভিতর থেকে বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছে। পুলিশি সুত্রে জানা যায়, সিআইডি আসার পর তদন্তে গতি এসেছে।
এদিকে সিআইডি তদন্তে আসায়, কিছুটা হলেও খুশি মৃতের পরিবারের সদস্যরা। তবে সিআইডি দলের আরও আগেই আসা উচিত ছিল বলে এদিন মন্তব্য করেন তারা। মৃতের মাসির ছেলে রাজেশ ঘােষ বলেন, ঘটনার পাঁচদিন পরে পুলিশ মাত্র দু’জনকে ধরেছে। তাও তাদের আটক করা হয়েছে বলা হয়েছে। অর্থাৎ এখনও একজনও গ্রেফতার হয়নি। একজনও কেন গ্রেফতার হল না, এটাই আশ্চর্যের। সে কারণেই আমরা প্রথম থেকেই সিআইডি তদন্তের দাবি করছিলাম। পাঁচদিন পরে হলেও সিআইডি দল এসেছে। আরও আগে এলে ভালাে হত।
মৃতের আরেক আত্মীয় সুজয় ঘােষ বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই বলেছিলাম কলকাতা থেকে স্নিফার ডগ নিয়ে এসে তদন্ত চালানাে হােক। সিআইডিকে দায়িত্ব দেওএয়া হােক। কিন্তু তাও হয়নি। আমাদের দাবি মানা হল ঘটনার পাঁচদিনের মাথায়। আমরা আশাবাদী, এবার হয়তাে প্রকৃত আততায়ীরা গ্রেফতার হবে। ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
ইতিমধ্যে খুনিদের গ্রেফতার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জিয়াগঞ্জ শহরে প্রতিবাদ মিছিল করেছে নাগরিক সমাজ। মিছিল করেছে বিজেপি এবং কংগ্রেস। বিজেপি’র মিছিলে কোনও ব্যানার ছিল না। কিন্তু সামনের সারিতে ছিলেন স্থানীয় সমস্ত নেতৃত্ব। অন্যদিকে কংগ্রেস সামনে দলের ব্যানার নিয়েই মােমবাতি মিছিল করে। শনিবার সন্ধ্যায় মােমবাতি হাতে মিছিল করল তৃণমুল কংগ্রেস। দলের কোনও ব্যানার ছিল না। যে ব্যানার ছিল, তাতে লেখা ছিল, ‘মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি নয়, দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি চাই’। মিছিলের প্রথম সারিতে ছিলেন স্থানীয় বিধায়িকা সাঁওনি সিংহ রায়, জিয়াগঞ্জ – আজিমগঞ্জ পুরসভার চেয়ারম্যান প্রসেনজিৎ ঘােষ, মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সভাধিপতি মােশারফ হােসেন মধু, প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান, জিয়াগঞ্জ টাউন তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি দেবাশিস সরকার প্রমুখ।
মিছিলটি শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করে মৃত শিক্ষকের বাড়ির সামনে যায়। সেখানে সবাই হাতের জ্বলন্ত মােমবাতি শক্ষকের বাড়ির দরজার সামনে লাগিয়ে শ্রদ্ধা জানান। বিজেপি নেতৃত্ব দাবি করেছেন, মৃত শিক্ষক আরএসএসের সদস্য ছিলেন, যা মানতে নারাজ মৃত পরিবারের সদস্যরা। বিজেপি নেতাদের এই দাবি নিয়ে এদিন সরব হন তৃণমূল কংগ্রেসের জেলার সহসভাপতি তথা মুখপাত্র অশােক দাস। তিনি বলেন, ‘বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘােষ সহ কয়েকজন নেতা জলটাকে ঘােলা করে দিয়ে ঘােলা জলে মাছ ধরতে চাইছে। তারা ভাবছে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জিয়াগঞ্জ এবং জেলার মানুষ সব বিজেপি হয়ে যাবে। জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ এবং অন্যান্য পুলিশ আধিকারিকরা যখন ঘটনার কিনারা করতে ব্যস্ত, তখন বিজেপি এ জাতীয় নােংরা খেলা খেলছে। আমরা বিজেপি এবং তাদের ওই নেতাদের ধিক্কার জানাচ্ছি’।