নিজস্ব প্রতিনিধি–– মালদহের প্রশাসনিক সভায় উপস্থিত হয়ে মাফিয়াদের উদ্দেশে কড়া বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন নিহত তৃণমূল কাউন্সিলর দুলাল সরকারের স্ত্রী চৈতালি সরকার। মমতা জানান, এই সমাজে মাফিয়াদের কোনও জায়গা নেই। যাঁরা সন্ত্রাস, দাঙ্গা করে তাঁদের কোনও জায়গা নেই। পাশাপাশি যাঁরা সেবা করেন, গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ান তাঁদের তিনি ভালোবাসেন। জেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে যাতে কোনও দুষ্কৃতী রাজ্যে প্রবেশ করতে না পারে সেই বিষয়ে প্রশাসনকে সতর্ক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কোনও জঙ্গি বা সমাজবিরোধী যেন রাজ্যে এসে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে না পারে তা দেখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও সরকারি প্রকল্পের পরিষেবার বিনিময়ে কেউ টাকা চাইলে পুলিশকে জানাতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মমতা ফের আরজি কর ইস্যুতে কথা বলেছেন। ধর্ষণ–খুনের ঘটনায় সোমবার সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছে শিয়ালদহ আদালত। মঙ্গলবারই সঞ্জয়ের ফাঁসির দাবিতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে রাজ্য। মমতা প্রথম থেকেই দোষীর ফাঁসির দাবিতে সরব হয়েছিলেন। সঞ্জয়ের সাজা শুনে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ঘটনাটি ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ প্রমাণ করতে না পারায় সিবিআইকে দুষেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবারের মঞ্চ থেকে তাঁর আশঙ্কা, সঞ্জয় প্যারোলে ছাড়া পেয়ে ফের অপরাধ করতে পারে। আরজি করের ঘটনাকে বিরলতম, জঘন্য ও স্পর্শকাতর বলে বর্ণনা করেছেন মমতা। পাশাপাশি কেন্দ্র অপরাজিতা বিল আটকে রেখেছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মমতা। তাঁর দাবি, ‘আমাদের হাতে তদন্তভার থাকলে এতদিনে ফাঁসির সাজা হয়ে যেত।’
এদিনের মঞ্চ থেকে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন মমতা। তাঁর অভিযোগ, আবাস যোজনা সহ বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আটকে রেখেছে কেন্দ্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজ্য সাধারণ মানুষকে পরিষেবা প্রদান করে চলেছে। খাদ্যসাথী, কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র, শিক্ষাশ্রী, যুবশ্রী, মেধাশ্রী ইত্যাদি একাধিক প্রকল্পে রাজ্য সরকার পরিষেবা প্রদান করে চলেছে। মমতার অভিযোগ, তিন বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাস্তা তৈরির কাজ থেকে শুরু করে আবাস যোজনা, ১০০ দিনের কাজ কিছুই থেমে নেই। রাজ্য নিজেদের উদ্যোগে এই সব পরিষেবা প্রদান করে চলেছে।
এই সভা থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রশাসনিক আধিকারিকদের নির্দেশ দেন মমতা। তিনি জানান, সাধারণ মানুষের কারও কোনও অসুবিধা আছে কি না তা জানার চেষ্টা করতে হবে। সপ্তাহে একদিন করে এক ঘণ্টার জন্য চা, চিনি, দুধ নিয়ে গরিব মানুষের বাড়ি যাওয়ার জন্য বিডিও, ডিএমদের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দাবি, এটুকু করতে বেশি টাকার প্রয়োজন হয় না। বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে বসে একটু চা খেয়ে তাঁদের সমস্যার কথা জেনে নিতে হবে। মানুষকে জানাতে হবে দুয়ারে সরকারের বিষয়ে।
মালদহের জন্য একাধিক উন্নয়নমূলক কাজকর্মের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এদিন মমতার বক্তৃতায় উঠে আসে মালদহের বিখ্যাত আমের কথা। তিনি জানান, জল স্বপ্ন প্রকল্পের আওতায় ৮ লক্ষ ৬৯ হাজার বাড়িতে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে। ইতিমধ্যেই ৩ লক্ষ ১৫ হাজার বাড়িতে জল পৌঁছে গিয়েছে। মালদহে তৈরি হয়েছে শিল্পনগরী। আরও বেশি করে মালদহে ব্যবসা করার জন্য ব্যবসায়ীদের আবেদন জানিয়েছেন মমতা। যে সকল গরিব মানুষের নাম বাংলার বাড়ি প্রকল্পের তালিকায় নেই তাঁদের সাহায্য করার জন্য ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ১৫ লক্ষ টাকা খরচ করলেই ১০টি বাড়ি তৈরি করা যায়। যদি গরিব মানুষদের নামের তালিকা প্রয়োজন হয় তাহলে ডিএম ব্যবসায়ীদের সাহায্য করতে পারে।
এদিনের মঞ্চ থেকে দাঙ্গাবাজদের কড়া হুঁশিয়ারি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, মানুষ মানুষকে ভালোবাসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে নজরুল, নেতাজি থেকে শুরু করে আম্বেদকর কেউ ভাগাভাগির কথা বলেননি। সবাই বলেছেন, সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা। এবারের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন তিনি ডুয়ার্সে পালন করবেন বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। এছাড়াও এদিন মঞ্চ থেকে বাংলার জয়গান গেয়েছেন তিনি। মমতার দাবি, বাংলা আজ গোটা ভারতবর্ষকে পথ দেখায়। বাংলাই মডেল।
মালদহের এই প্রশাসনিক সভায় উপস্থিত হয়ে একগুচ্ছ প্রকল্পের শিলান্যাস ও উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১২১১ কোটি ৫৪ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ১২৩টি জনমুখী প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ৭৬টি জনমুখী প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ৩৫ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে চাঁচলের বিশেষ সংশোধনাগার, ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে মালদা ভবন, ৯০ কোটি ৭২ লক্ষ ৮ হাজার টাকা ব্যয়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন গ্যাস ইনসুলেটেড বৈদ্যুতিক সাব স্টেশন নির্মিত হয়েছে। এরপর মঞ্চ থেকে সরকারি প্রকল্পের পরিষেবাগুলির সংশাপত্র উপভোক্তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি তিনি জানিয়ে দেন, সরকারি পরিষেবাগুলির জন্য সরকার সরাসরি টাকা দেয়। এই সব প্রকল্পের পরিষেবা পেতে কাউকে এক পয়সাও দেবেন না। কেউ টাকা চাইলে থানায় ডায়েরি করবেন। তা না হলে সরাসরি তাঁকে ফোন করে অভিযোগ জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন মমতা।
ফের প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ জন বার্লার তৃণমূলে যোগদান নিয়ে জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছে। আগামী ২৩ জানুয়ারি আলিপুরদুয়ারে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাঁকে। ওই দিনই আনুষ্ঠানিকভাবে জন বার্লা তৃণমূলে যোগদান করতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাননি প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ।