বিপন্ন বউবাজার

কলকাতা মেট্রো (Photo: Kuntal Chakrabarty/IANS)

বৌবাজার বিপর্যয় কাণ্ড অব্যাহত। ঘটনার সূত্রপাত শনিবার গভীর রাতে। এদিকে তিনদিন কেটে গেলেও বাড়ি ধসে পড়ায় রাশ টানা সম্ভব হয়নি। দিশেহারা বউবাজারের বাসিন্দারা। মেট্রো কর্তৃপক্ষের অপরিণামদর্শিতা, নাকি নিছকই আকস্মিক বিপর্যয়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে।

আরও একটি বাড়ি চোখের সামনে ভেঙে পড়ে। আতঙ্কের পরিবেশ বউবাজারের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাসবাণীতেই একমাত্র ভরসা করে রয়েছেন মধ্য কলকাতার অন্যতম জমজমাট এলাকার বাসিন্দারা। কর্মব্যস্ত বউবাজারের সােনাপট্টির একাংশ শ্মশানে পরিণত হয়েছে। দুর্গাপুজো ও দিওয়ালির মরশুমে কবে আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, সেদিকে তাকিয়ে বহু সংখ্যক স্বর্ণশিল্পীরা।

এদিন বউবাজার বিপর্যয় কাণ্ড নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছে, ২০টি বাড়ি বিপজ্জনক। বিশেষজ্ঞ দল সামগ্রিক বিষয় খতিয়ে দেখছে। বিপর্যস্তদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজও একই সঙ্গে চলছে। তবে কতদিন হােটেল-লজের মতাে পরবাসে থাকতে হবে, জানেন না বিধ্বস্ত বাসিন্দারা।


অন্যদিকে মেট্রোর সুড়ঙ্গ পরীক্ষায় শহরে এসেছে বিদেশি বিশেষজ্ঞ দল। মঙ্গলবার রাতেই বিদেশ থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছন তাঁরা। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মাটি থেকে মেট্রোর টানেল বিশেষজ্ঞরা। হংকং থেকে মাটি বিশেষজ্ঞ জন এনরিকর্দ। রয়েছে ডা. পিছমণি। তিনি আইআইটি’র আমন্ত্রিত লেকচারার। এছাড়া এ্যাপার্ট টিমে রয়েছেন সুড়ঙ্গ বিশারদ জে. ব্রিজ ক্রিস্টোফার। বুধবার বউবাজার এলাকায় মেট্রোর সুড়ঙ্গ পরিদর্শন করেন এই বিশেষজ্ঞ দল। সঙ্গে ছিলেন কেএমআরসিএল-এর আধিকারিকরা।

সূত্রের খবর, বউবাজার এলাকায় মেট্রোর কাজ শুরু হওয়ার আগে মাটি পরীক্ষার সমস্ত রিপোের্ট খুঁটিয়ে দেখবেন এই বিশেষ বিশেষজ্ঞ দল। মাটি পরীক্ষার পরেও কেন এমন বিপর্যয় ঘটল, তা সকলের কাছেই অপ্রত্যাশিত। এর পাশাপাশি বর্তমানে ওই এলাকায় মাটির মান নির্ধারণের রিপাের্টও দেখবেন তাঁরা। কেএমআরসিএল-এর তরফ থেকে সেই রিপাের্ট তাদের দ্রুত দেখানাে হবে। এই এলাকায় ফের কাজ করা যাবে কিনা, তাও পরীক্ষা করে দেখবেন এই এক্সপার্ট টিম।

অন্যদিকে মাটির ভারসাম্য রক্ষায় চলছে যুদ্ধকাBouলীন তৎপরতায় টানেল ভরাটের কাজ। দ’দিকে তৈরি হয়েছে পাঁচিল। রাখা হয়েছে বালির বস্তা, যাতে বাকি অংশের বাড়িগুলিকে কোনওমতে রক্ষা করা সম্ভব হয়। তবে আরও বেশ কিছু বাড়িতেও দেখা দিয়েছে ফাটল। আতঙ্কে প্রহর গুনছেন বউবাজারের বাসিন্দারা।

এর পাশাপাশি কাজ করছে কলকাতা পুলিশের টিম। ডিসি সেন্ট্রাল ও ডিসি ডিডি স্পেশালের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে গােটা বাহিনী। এদিন ড্রোন উড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা, ধ্বংসস্তুপ থেকে শুরু করে চিড় ধরা বাড়িগুলির ছবি তােলা হয়েছে। সেই ছবিগুলি দেখবেন প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা। বিপর্যস্ত বাসিন্দাদের সমস্ত রকম সহযােগিতার জন্য গােয়েঙ্কা কলেজে রয়েছে স্পেশাল কন্ট্রোল রুম। বিপর্যয় মােকাবিলা বাহিনী থেকে দমকল বিভাগের হাইড্রোলিক ল্যাডারও প্রয়ােজনে ব্যবহারের জন্য মােতায়েন রয়েছে।

প্রাণ নেই পাড়াটাতে। শনিবার সকাল পর্যন্ত আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতােই জীবন কাটিয়েছিল বউবাজারের বাসিন্দারা। বিকেল পার হতেই দেখা দিয়েছিল বিপত্তি। প্রথমে তিনটে বাড়িতে ফাটল দেখা গিয়েছিল। এরপর একের পর এক বাড়িতে চিড় ধরতে থাকে। বুধবার ভেঙে পড়ে আরও একটি বাড়ি। শুধু স্যাকরা পাড়া লেন ও দুর্গা পিতুরি লেন নয়, আতঙ্ক ছড়িয়েছে সমস্ত বউবাজারেই।

হাতে সময় পেয়েছিলেন মাত্র দশ মিনিট। তাঁর মধ্যেই বাড়িতে ঢুকে সমস্ত জিনিসপত্র বার করে নিতে হত নমিতা সেনকে। তিনি জানান, বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছি। কয়েক মিনিটে জীবনটা বদলে গেছে আমূল, জানান তিনি। কিন্তু দশ মিনিটে কি সংসার গােছানাে সম্ভব? নমিতাদেবী জানান, বাড়িতে হাজারাে জিনিস। তার অ্যাকোরিয়ামে ছয়টি মাছ রয়েছে। তাদের কথায় বলতে গিয়ে কার্যত অশ্রুসিক্ত হলেন এই মহিলা।

কিন্তু শেষ কোথায়? এই প্রশ্নই এখন বউবাজারের বাসিন্দাদের মনে। বউবাজারে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ফটো বাইন্ডিং এর ব্যবসা করেন শম্ভ দে তিনি জানান, ব্যবসাপাতিতে মন্দা এসেছে। কিন্তু এভাবে খা খা কখনও করেনি পাড়াটা। কোনও আওয়াজ শুনলেই মনে হচ্ছে দোকানটা ছেড়ে প্রাণ হাতে দৌড়াতে হবে বলে মনে হচ্ছে, জানান এই ব্যবসায়ী। তার কথায়, ১৩এ দুর্গা পিতুরি লেনের বাড়ির নীচে তার ব্যবসার জিনিসপত্র ছিল। প্রায় ২ লক্ষ টাকার জিনিস বাড়িটি ভেঙে পড়ায় ভগ্নস্তুপে। বন্দী, জানান তিনি। শম্ভুবাবুর কথায় , মেট্রো রেলের তরফে তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়নি।

বুধবার নতুন করে বউবাজারের ২০ টি বাড়িকে বিপজ্জনক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সেখান থেকে স্থানান্তরিত করা হয় বাসিন্দাদের। কিন্তু নতুন করে ফাটল দেখা গেছে আরও কয়েকটি বাড়িতে স্বাভাবিকভাবেই ঘুম উড়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদেরও কার্যত আতঙ্কেই দিন কাটছে সমগ্র বউবাজারবাসীর। এখনও বসছে বউবাজারের জমি। বিজ্ঞানীরা ছাড়পত্র না দিলে নতুন করে বাড়ি তৈরির জন্য অনুমতি দেবে না কলকাতা পুরসভা, বুধবার এমনটাই স্পষ্ট করলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম।

আতঙ্কের শেষ কোথায়? এখন এটাই প্রশ্ন বউবাজারের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের। বুধবার নতুন করে আরও ২০টি বাড়িতে ফাটল ধরেছে। খালি করা হয়েছে বেশ কিছু বাড়ি। এদিন বউবাজারে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন কলকাতা পুরসভার বাম কাউন্সিলররা। এই পরিদর্শন প্রসঙ্গে বাম কাউন্সিলর দেবাশিস চক্রবর্তী জানান, মেট্রো রেল ওই বাসিন্দাদের কেবলমাত্র মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁদের লিখিত প্রতিশ্রুতির দাবি এবং স্বর্ণব্যবসায়ীদের বিষয়টি অবিলম্বে মানবিকভাবে ভেবে দেখতে হবে প্রশাসনকে, এদিন এমনটাই দাবি তােলেন সমস্ত বাম কাউন্সিলর। কলকাতা পুরসভার বিরােধী বাম দলনেত্রী রত্না রায় মজুমদারের নেতৃত্বে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের কাছেও যান তারা।

এদিকে মেয়র জানান, বউবাজারের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে পুরসভা। এলাকার বাড়িগুলিতে গিয়ে একটি সার্ভে করবে কলকাতা পুরসভার। বিল্ডিং বিভাগ বিষয়টি নিয়ে কেএমআরসিএল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও নিয়মিত যােগাযােগ রাখা হচ্ছে বলে জানান তিনি। বউবাজার এলাকায় নতুন করে বাড়ি তৈরির অনুমােদন দেওয়া প্রসঙ্গে মেয়র জানান, এখনও বসছে ওইখানকার জমি। যতদিন না পর্যন্ত ইকো-জিওলজিস্টরা ওই জমি সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত হিসাবে ছাড়পত্র দেবেন, ততদিন পর্যন্ত নতুন করে বাড়ি তৈরির ছাড়পত্র দেওয়া হবে না, সাফ জানিয়ে দেন ফিরহাদ হাকিম।

এদিকে দুর্গা পিথুরি লেন ও স্যাকরাপাড়া লেনে জলের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। পুর কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, ওই জায়গায় জলের গাড়ি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এলাকাবাসীর ক্ষোভ, জলের লাইন কেটে দেওয়ায় সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। পর্যাপ্ত পানীয় জল পাচ্ছেন না তারা, ক্ষোভ ওই এলাকার বেশ কিছু বাসিন্দার। এই বিষয়ে এক পুর আধিকারিক জানান, জলের গাড়ি নিয়মিত উপস্থিত থাকছে বউবাজার এলাকায়। তা সত্ত্বেও কেন জল না পাওয়ার অভিযােগ উঠছে, তা খতিয়ে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।