গ্রীষ্মের দাবদাহকে টেক্কা দিয়ে বোলপুর ও বীরভূমে ভোট প্রচারে তারকা সমাবেশ

মিঠুন থেকে যোগী আদিত্যনাথ ও মোদির সঙ্গে টক্করে অভিষেক

খায়রুল আনাম: একদিকে যখন গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে অন্য জায়গার সাথে জ্বলছে বীরভূম জেলা তখন, লোকসভা ভোট-উত্তাপে রাজনৈতিক তারকা সমাবেশে বীরভূমের আবহাওয়া যেন আরও উষ্ণ হয়ে উঠেছে৷ জেলার বোলপুর ও বীরভূম-এই দু’টি লোকসভা-ই শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে রয়েছে৷ শাসক শিবির এই দু’টি লোকসভা আসন যে শুধুমাত্র ধরে রাখতে চাইছে তাই-ই নয়, দু’টি আসনেই তারা তাদের জয়ের ভোট-ব্যবধান বাড়িয়ে নিতে তৎপর হয়ে উঠেছে৷ এবারই প্রথম তৃণমূল কংগ্রেস তাদের ভোট বৈতরণি পার করার কাণ্ডারী অনুব্রত মণ্ডলের অনুপস্থিতিতে লোকসভা ভোটে নেমেছে৷ গোরু পাচার মামলায় সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে দিল্লির তিহাড় জেলে বন্দি রয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর মাতৃহীন একমাত্র সন্তান সুকন্যা মণ্ডল৷ তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জেলায় এসে বার বার জানিয়ে গিয়েছেন যে, অনুব্রত মণ্ডলকে বিনা দোষে সিবিআই গ্রেফতার করে তিহাড়ে জেলবন্দি করে রেখে রেখেছে৷ তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৩ এপ্রিল বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের তারকা প্রার্থী শতাব্দী রায়ের সমর্থনে হাঁসনের কড়কড়িয়ায় জনসভা করে যান৷ তার আগে দলীয় নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ৩ এপ্রিল তারাপীঠে একটি কর্মী সম্মেলন করে লোকসভা ভোটে দলীয় কর্মীদের কী করনীয় তা জানিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে বার্তা দিয়েছিলেন যে, তিনি আবারও জেলায় আসবেন৷ তারপরই ২৭ এপ্রিল পুনরায় বীরভূম লোকসভার দলীয় প্রার্থী শতাব্দী রায়কে চতুর্থবারের জন্য জয়ী করার আহ্বান জানিয়ে যান বীরভূম লোকসভার খয়রাশোলের গোষ্ঠডাঙাল মাঠের সভা থেকে৷

অপর দিকে বিরোধী শিবির বিজেপির ঘোষিত প্রার্থী প্রাক্তন আইপিএস অফিসার দেবাশিস ধর ভোট-প্রচারে দলীয় কর্মীদের মধ্যে একটা উন্মাদনা আনতে পারলেও নির্বাচন দফতর আইনী প্রশ্নে তাঁর মনোনয়নপত্রটিই বাতিল করে দেওয়ায় তিনি ভোট ময়দান থেকে কক্ষচু্যত হয়ে যান৷ আর তিনি যে কক্ষচু্যত হচ্ছেন সেটা আঁচ করতে পেরে বিজেপি বিকল্প প্রার্থী হিসেবে দেবতনু ভট্টাচার্যকে দিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় সেটি বৈধতা পায়৷ প্রার্থী বদলের ফলে বিজেপি প্রথম দিকে একটু মুষড়ে পড়লেও, ইতিমধ্যেই তারা দেবতনু ভট্টাচার্যের উপরে ভরসা রেখে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেও মাঝে একটা শূন্যতা তৈরী হয়ে গিয়েছে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল৷ ইতিমধ্যেই ২৮ এপ্রিল অসুস্থ হয়ে দলের বীরভূম সাংগঠনিক জেলা সভাপতি ধ্রুব সাহা দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে বিজেপি নেতৃত্ব৷ অথচ বিজেপি ২০১৯ সালের চেয়ে বেশি আসন তুলতে চাইছে এরাজ্য থেকে৷ ইতিপূর্বে জেলার সিউড়িতে এসে দলের সর্বভারতীয় নেতা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভায় ৩৫ টি আসন জয়ের স্বপ্ন ফেরি করে গিয়েছিলেন৷ সেই সিউড়িতেই এবার ভোট প্রচারে আসছেন দলীয় নেতা তথা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ৷ দলের বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী দেবতনু ভট্টাচার্যের সমর্থনে ৩০ এপ্রিল সিউড়ির বেণীমাধব স্কুল মাঠে দুপুর ১২ টায় জনসভা করবেন যোগী আদিত্যনাথ৷ এজন্য দলীয় স্তরে ও জেলা প্রশাসনের দিক থেকে সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে৷ আর এর প্রস্তুতি হিসেবে দলের তারকা প্রচারক মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে ২৯ এপ্রিল নলহাটিতে একটি রোড-শো করে বিজেপি৷ তিনি হাঁসনে গিয়ে একটি সভাও করেন৷ এদিনই বিজেপি দলীয়ভাবে জানিয়ে দেয় যে, প্রধানমন্ত্রী তথা দলীয় নেতা নরেন্দ্র মোদি ৩ মে কৃষ্ণনগর ও পূর্ব কেন্দ্রের সাথে বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী পিয়া সাহার সমর্থনে আমোদপুরের নেতাজি ময়দানে দিপুর ১২ টায় একটি জনসভা করবেন৷ আর এনিয়ে একেবারে নিশ্চুপ থাকেনি শাসক তৃণমূল কংগ্রেসও৷


তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, ৩ মে দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিটে বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থী অসিত কুমার মালের সমর্থনে নানুরের পাপুড়ীতে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি জনসভা করবেন৷ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে এই জনসভাটি হবে বলেও প্রচার করা হয়েছে৷

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই জনসভাটি মূলতই হবে জেলা পরিষদের সভাধিপতি সভাধিপতি পাপুড়ী গ্রামেরই ফায়েজুল হক ওরফে শেখ কাজলের উদ্যোগে৷ অনুব্রত মণ্ডল রাজনৈতিক ময়দানে থাকাকালীন শেখ কাজলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব এবং রাজনৈতিক সংঘাত ছিলো বহু চর্চিত বিষয়৷ এমন কী, জেলা তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন সময়ে অনুব্রত মণ্ডল শেখ কাজলকে ‘সমাজবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কারও করেন৷ আর সেই প্রেক্ষিতেই নানুর বিধানসভা আসনটি তৃণমূল কংগ্রেসের গদাধর হাজরাকে হারিয়ে যখন সিপিএমের শ্যামলী প্রধান দখল করেন তখন, রাজনৈতিক মহল এর পিছনের ‘কাজলের হাত’ দেখেছিলেন৷ আবার অনুব্রত মণ্ডল গ্রেফতার হয়ে তিহাড় জেলে যাওয়ার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাটকীয়ভাবে শেখ কাজলকে আমার কুটিরে এসে দলে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং পঞ্চায়েত ভোটে তাঁকে জেলা পরিষদে প্রার্থী করেন এবং তিনি জেলা পরিষদের সভাধিপতিও হন৷

নানুরের প্রাক্তন বিধায়ক গদাধর হাজরা তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে কিছুদিন বিজেপির সঙ্গে গেলেও পরবর্তীতে অনুব্রত মণ্ডলের হাত ধরে তৃণমূল কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন ঘটলেও অনুব্রত মণ্ডল গ্রেফতার হওয়ার পরে এবং শেখ কাজলের প্রবলভাবে প্রত্যাবর্তনের পরে আর সামনে আসতে পারেননি গদাধর হাজরা৷ শেখ কাজলকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে কোর কমিটির সদস্য করলেও পরে তাঁকে কোর কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং এবার জেলায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুনরায় শেখ কাজলকে কোর কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে যান৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও আসছেন জেলার সাঁইথিয়া ও লাভপুরে৷ অনুব্রত মণ্ডলের সময়কালে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পাপুড়ীর পাশে বাহিরীর স্কুল মাঠে জনসভায় এলেও সে সময় মাঠ ভরেনি৷ এবার শেখ কাজল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে তাঁর নিজের গ্রাম পাপুড়ীতে জনসভা করার মধ্যে দিয়ে যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা ভিন্ন সমীকরণ তৈরী করতে চাইছেন, তা স্পষ্টতই অনুমান করতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বা বিশ্লেষক হওয়ারও হয়তো প্রয়োজন নেই৷