অন্যকে এতদিন ‘কৃষ্ণ সাজিয়েছি’ এবার নিজের কৃষ্ণ সাজতে ইচ্ছে করছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে পাকাপাকি বিচ্ছেদের প্রাক-মুহূর্তে এই প্রতিবেদকের মুখােমুখি হয়ে এমনটাই জানিয়েছিলেন মুকুল রায়।
তৃণমূলের নম্বর-টু এখন রাজ্য বিজেপি’র অন্যতম সারথি। তৃণমূলের মস্তিষ্ক এখন কাজ করছে বিজেপি’র হয়ে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা আড়ালে-আবডালে নয়, এবার প্রকাশ্যে বলা শুরু করেছেন, মুকুলদা থাকলে হয়তাে এত খারাপ অবস্থা হত না তৃণমূলের।
২০১৯-এ লােকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর যে ছবিটা দেখা গিয়েছিল তৃণমূল সুপ্রিমাে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি সংলগ্ন দলীয় কার্যালয়ে, সেই ছবিটা এদিন উধাও। বাংলার প্রতিটি বুথে সংগঠন না থাকা একটা দলের এই আশ্চর্য উড়ান নিঃসন্দেহে অপ্রত্যাশিত।
বুথ ফেরত সমীক্ষা দেখার আগে পর্যন্ত তৃণমূলের কোনও শীর্ষ নেতা আঁচ করতে পারেননি, এতবড় বিপর্যয় ঘটতে চলেছে শাসকদলের ভােটব্যাঙ্কে। ফলে বুথ ফেরত সমীক্ষা মনগড়া এয়নটাই দাবি করছিলেন তাঁরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবুজদুর্গে গেরুয়া – ঝড়ে ঘাসফুলের শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা। গেরুয়া ঝড়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে পাহাড় এবং জঙ্গলমহলে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই জায়গা দুটি খুব প্রিয়। বারে বারে ছুটে গিয়েছেন সেখানে। মমতার কথায় পাহাড় হাসছে, জঙ্গলমহল হাসছে। কিন্তু এই দুই জায়গাতে তৃণমূলের ভরাডুবি হয়েছে। রীতিমতাে অঙ্ক কষে সহজ জয় তুলে নিয়েছে বিজেপি। পাহাড়প্রমাণ বাধাকে অতিক্রম করেছে বিজেপি। কোন অঙ্কে এগােলে তৃণমূলকে হারানাে সম্ভব এই অঙ্কটাই এতদিন কষে গিয়েছেন মুকুল রায়, দিলীপ ঘােষরা। তাঁদের সঙ্গে যােগ্য সঙ্গত দিয়েছে মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা কৈলাস বিজয়বর্গীয়, সুনীল দেওধররা। কোনও আবেগের জায়গা থেকে নয়, তৃণমূল স্তরে গিয়ে তৃণমুলের ঘর শূন্য করে দিয়েছে বিজেপি।
এক্ষেত্রে অবশ্য বিজেপির কাছে কেউ অচ্ছুত নয়। বামেদের সংখ্যাগরিষ্ঠের অংশের ভােট নিজেদের দিকে এনে মমতা-ম্যাজিককে ভোতা করে দিয়ে এগিয়েছে বিজেপি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা এখনও অটুট থাকলেও তা ভােটব্যাঙ্কে তৃণমূলকে আগের মতাে এগিয়ে দিতে পারেনি। সেই সঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণ করে ভােট ভাগাভাগি এবং তরুণ প্রজন্মের ভােটারদের বড়সড় অংশের ভােট বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ। সবচেয়ে চমকপ্রদ ফল বিষ্ণুপুরে। বিজেপি প্রার্থী সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এলাকায় ঢুকতে পারেননি। তিনিও জয়ী হয়েছে।
বনগাঁতেও মতুয়া ভােটব্যাঙ্কে বড়সড় থাবা বসিয়ে জয়ী হয়েছেন শান্তনু ঠাকুর। মর্যাদার লড়াইয়ে অল্পদিনে রীতিমতাে টক্কর দিয়ে অর্জুন সিং জয়ী হয়েছে। পরিকল্পনা মাফিক এই জয় এসেছে। আসলে ভেতরে ভেতরে শাসকদলের সংগঠনের খুঁত বের করে নিজেদের সংগঠন সাজিয়েছে বিজেপি। সেকারণে যাদবপুরের মতাে লােকসভা কেন্দ্রে লড়াইটা তৃণমূল বনাম বামেরা না হয়ে হয়েছে বিজেপি’র সঙ্গে। এরকম অনেক অঙ্ককে সামনে রেখে নিখুঁত পরিকল্পনাই বিজেপি’কে আশ্চর্য জয় এনে দিয়েছে। যদিও বিজেপির শীর্ষ নেতা অমিত শাহ জোর দিয়ে বলেছিলেন, বাংলায় এবার বিজেপি ২৩টি আসনে জয়ী হবে। বাংলায় এই বিপুল জয়ের পর সংবাদমাধ্যমের কাছে মুকুলের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘আরও অনেক লড়াই বাকি রয়েছে। তৃণমূলকে হারানাে না পর্যন্ত থামব না।’
মুকুল অনুগামীদের কথায়, তৃণমূলের সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার সময় মুকুলদার চোখে জল দেখা গিয়েছিল। অনেক রক্ত-ঘামের বিনিময়ে তৃণমূলকে রাজ্যের শাসকদলে পরিণত করার জন্য মুকুলদার অবদান কোনও অংশে কম ছিল না। আজ মুকুলদা বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘােষ, রাহুল সিনহাদের সঙ্গে নিয়ে নিজের জাত চিনিয়ে দিলেন। প্রমাণ করে দিলেন, শুধু আবেগ দিয়ে নয়, রাজনীতিতে মস্তিষ্কটা অনেক বেশি জরুরি। হাতের তালুর মতাে গােটা রাজ্যটাকে চেনেন।
বিগত নির্বাচনগুলিতে মুকুলের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল বিজেপি’তে। কিন্তু অনেক সময় এগােতে গেলে দু’পা পিছােতে হয়। সেই অঙ্কেই বাজিমাত করলেন মুকুল। এগিয়ে দিলেন বিজেপি’কে। ত্রিপুরাতে বামদুর্গ চুরমার করে যিনি বিজেপি’কে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিলেন, আরএসএসের সেই শীর্ষ নেতা সুনীল দেওধর ঘাঁটি গেড়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতায়।
বাংলার প্রতিটি বিধানসভার খুঁটিনাটি তিনি জেনে এসেছিলেন। এতটাই ছিল হােমওয়ার্ক যে তিনি সহজেই বলে দিচ্ছিলেন, কি করলে রাজনৈতিক মানচিত্র নিঃশব্দে বদল করা সম্ভব। ইভিএমে সেই নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে ঘাসফুলের দুর্গে আধিপত্য বাড়িয়েছেন বিজেপি’র । বাংলায় বিজেপি’র সাফল্যের কারিগর সাধারণ মানুষ হলেও নেপথ্যে থেকে মুকুল রায়, দিলীপ ঘােষ, কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং সুনীল দেওধররা নরেন্দ্র মােদি এবং অমিত শাহদের স্বপ্নপূরণ সম্ভব করেছে।
ওডিশায় বিজেপি’র জাতীয় কমার্সমিতির বৈঠকে মােদি-অমিত শাহরা বলেছিলেন, ‘বাংলায় বিজেপি আধিপত্য না বাড়লে বিজেপি’র সুবর্ণযুগ আসবে।’ সেদিনের সেই কথার মধ্যে লুকিয়েছিল বিজেপি’র লুক-ইট বাতি। আর একটি ভালাে করে বললে, উত্তর-পূর্ব ভারতই ছিল বিজেপি’র অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এদিকে তােড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে বঙ্গ বিজেপি তে। নতুন মন্ত্রিসভাতে বাংলা থেকে কারা কারা স্থান পান তা নিয়ে জোরদার জল্পনা বিজেপি শিবিরে।
এক্ষেত্রে মুকুল রায়, বাবুল সুপ্রিয়, অর্জুন সিংদের নামও উঠে আসছে। সম্ভাবনাময় হিসেবে লকেট চ্যাটার্জি, সুরেন্দ্রর সিং আলুওয়ালিয়ার নামও শােনা যাচ্ছে। কতটা কলজের জোর থাকলে বাংলার মানুষের কাছ থেকে ‘পদ্মপ্রেমের ঝড়’ আশা করা যায়? কতটা শক্ত হাতে রাশ ধরলে শুন্য থেকে শুরু করে লক্ষ্যের খুব কাছে পৌছানাে যায়?
‘রহস্য ঘনাচ্ছে, তােপসে রহস্য ঘনাচ্ছে।’ বঙ্গে গেরুয়া ঝড়ের আগাম আভাস ছিল। কিন্তু তার তীব্রতা দেখার পর এই রহস্য সমাধানে ফেসবুক জুড়ে কার্যত ফেলুদাকেই স্মরণ করেছে রসিক বাঙালি। নিঃশব্দে তৃণমূলের ঘরে কিভাবে সিধ কাটল বিজেপি! তা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে।
‘বেবাক’ দিলীপ, ‘চাণক্য’ মুকুল আর মােদি-অমিতের ‘ইক্কা’ কৈলাশ- শক্ত হাতে বাংলায় ভােটের রথ সামলেছে এই তিন সারথি, দাবি রাজনৈতিক মহলের। আচ্ছা ফেলুদা থাকলে কি এই উত্তর তাঁর কাছে পাওয়া যেত? ‘হাইলি সাসপিসাস’. . .
২০১৭, নভেম্বর মাস। শীতের সময়ও বঙ্গ রাজনীতির সৌজন্যে পারা চড়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর পরেই তৃণমূলের সর্বেসর্বা এবং তৃণমূলের সংগঠনের ধারক মুকুল রায় গুঞ্জন সত্যি করে যােগ দিয়েছিলেন বিজেপিতে। সঠিক দল এবং সহযােগী না পেলে ভাল খেলােয়াড়ের ব্যাটিংয়েও ম্যাচ জেতা যায় না বলে কটাক্ষ করেছিলেন তৃণমূলের বহু নেতা। কিন্তু বিজেপিতে গিয়ে তাঁর সংগঠন মজবুত করার কৌশলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন অমিত শাহ থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মােদি।
রাজ্যের পরিস্থিতি মেপে তাই তাঁর হাতেই লােকসভা নির্বাচনের ভার তুলে দেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এরপর বিজেপির সদর দফতরের থেকে জেলা সফরে বেশি দেখা গেছে মুকুল রায়কে। ক্যামেরার সামনে খুব একটা বেশি তাঁকে দেখা না গেলেও নির্বাচন শুরুর ঠিক আগে তৃণমূল সুপ্রিমাের বিরুদ্ধে সারদা ইস্যুতে সরব হয়েছিলেন তিনি। সংগঠন সাজানাের পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, সারদা সহ একাধিক অস্ত্র তিনি তুলে দেন বিজেপির হাতে।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা। মুরলীধর লেনে রাজ্য বিজেপির কার্যালয়ে প্রবেশ করেন মুকুল রায়। তাঁর ঘরের বাইরে তখন জনস্রোত। জয়ের আনন্দ ভাগ করে নিতে কনভেনর-এর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকেই। প্রশ্ন উঠছে, তবে কি ‘ভালাে খেলােয়াড়’ নিজেই অন্যান্যদের প্রশিক্ষিত করে ভালাে দল তৈরি করলেন?
প্রত্যেক বলে ছক্কা হাঁকাক বা না হাঁকাক, দলের অভিজ্ঞ খেলােয়াড়ের মাঠে থাকা মানেই অন্যদের বুকের পাটা একলাফে বেড়ে ৫৬ ইঞ্চি’র হয়ে যায়। নির্বাচনের আগে বিরােধীদের সমালােচনার পরােয়া না করে প্রকাশ্যেই দিলীপ ঘােষ জানিয়েছিলেন, ‘দলে জিতে আসার মতাে প্রার্থী নেই।’ পাশাপাশি এই বক্তব্যের সঙ্গে সংযােজন । ছিল , অন্যান্য দল থেকে যারা বিজেপিতে আসতে চান তাঁদের স্বাগত। রাজ্যজুড়ে বিজেপির চোরাস্রোত গেরুয়া শিবিরে ভােটবাক্সে বসন্ত আনবে, এমনটাও জানান দিলীপ ঘােষ।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের কথায, কিছু কিছু সময় বিজেপির রাজ্য সভাপতির কথায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্পষ্টবক্তা দিলীপের দরুন বিজেপির একটি সাহসী ছবি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছে বলেও দাবি বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে দলের সমস্ত খেলােয়াড়ের দিকে নজর রাখেন একজন দক্ষ কোচ। আর বাংলার গেরুয়া দলকে আরও মজবুত করতে অমিত শাহ ভরসা রেখেছিলেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়র ওপর। নিরাশ করেননি তিনি। পথসভা, মিছিলের পাশাপাশি মনােবল বাড়াতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গিয়েছেন তিনি।
এছাড়াও কখনও মাইক হাতে রাজনীতির বুলি ছেড়ে গলা মিলিয়েছিলেন কীর্তনিয়াদের কণ্ঠে। আবার কখনাে হাওড়ায় গিয়ে অকপটে শাসক দলের সমালােচনা করেছেন। সবমিলিয়ে বঙ্গে বিজেপির জোরালাে সংগঠন তৈরির কাছে ক্রমাগত নজরদারি চালিয়েছেন এই কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক। সাফল্যের ‘মন্ত্র’ জনসমক্ষে উচ্চারণ করেন না কেউই। তবে বঙ্গে বিজেপির উত্থানের পিছনে এই তিন সেনাপতির নিঃশব্দ অবদান মানছেন রাজনীতিবিদরাও।