বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বরের সন্ধ্যাটা কিন্তু কলকাতাবাসীর জন্য আর-পাঁচটা সাধারণ হিমেল সন্ধ্যার মতো ছিল না। শহুরে হাওয়া যেমন শীতের আগমনের বার্তা বয়ে আনল, একই সঙ্গে বয়ে নিয়ে এল কিছু খুশির খবর। স্টেটসম্যান ও দৈনিক স্টেটসম্যান নিবেদিত ‘বেস্ট ফেস বেস্ট ড্রেস’ প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল সেদিন। সেখানেই ঘোষিত হল বিজয়ীদের নাম। স্বভাবতই প্রতিযোগীরা জয়ের খবর পেয়ে খুশি।
সাড়ে ছ’টা নাগাদ উৎসাহীরা সকলে জওহরলাল নেহরু রোডের রোটারি সদন প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমাতে শুরু করেন। আসলে কলকাতার মানুষজন যেমন রসনাবিলাসী বলে খ্যাত, তেমনই তাদের ঝোঁক সাজগোজ এবং পোষাক পরিচ্ছদের উপর। স্বাভাবিকভাবেই ঘোষণা হওয়ামাত্র, এই অনুষ্ঠান আগ্রহ তৈরি করেছিল মানুষের মনে।
কিন্তু ঠিক কী ঘটল সেদিন রোটারি সদনে? এই প্রতিবেদন তাঁদের জন্য যাঁরা এক অসাধারণ অনুষ্ঠান সেদিন চাক্ষুষ করাটা মিস করেছেন। বেশ কিছুদিন আগেই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘বেস্ট ফেস বেস্ট ড্রেস’-এর জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করা হয়। তারই ভিত্তিতে হয় প্রতিযোগী নির্বাচন। সেদিন সন্ধ্যায় ছিল প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব, যেখানে প্রকাশ করা হয় সেরা মুখশ্রী এবং সেরা সাজের শিরোপা জয়ীদের নাম।
স্টেটসম্যান পত্রিকার যে-কোনও ইভেন্ট মানেই একটু বাড়তি আকর্ষণ। যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন যে, ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রথম ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র দ্য স্টেটসম্যান, একটি ঐতিহ্যপূর্ণ ভিনটেজ কার র্যালিরও আয়োজন করে। প্রতি বছর, রোলস রয়েস-সহ বিশ্বের কয়েকটি সেরা ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্বকারী গাড়ি, সেই র্যালিতে অংশ নেয়। এটি ছাড়াও স্টেটসম্যান ও দৈনিক স্টেটসম্যান, বেশ কিছু প্রতিযোগিতামূলক ও পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যেমন গ্রামাঞ্চলের সাংবাদিকদের সাহসকে স্মরণ করে, সেরা সাংবাদিকতার সম্মাননা জ্ঞাপন করতে আয়োজিত হয় ‘রুরাল রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড’। এমনই সব চিত্তাকর্ষক অনুষ্ঠানের তালিকায়, ‘বেস্ট ফেস বেস্ট ড্রেস’ প্রতিযোগিতাটি, দ্য স্টেটসম্যান ব্র্যান্ডের বার্ষিক অনুষ্ঠানের এখনও পর্যন্ত সর্বশেষ সংযোজন। এবছর তৃতীয় বর্ষে পা দিল এই অনুষ্ঠান।
যদিও দ্য স্টেটসম্যানের ঐতিহ্য বরাবর বুদ্ধিজীবী এবং অভিজাতদের সঙ্গে সংযুক্ত কিন্তু এটি সর্বস্তরের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করাতে বিশ্বাসী। বিশেষ করে সৌন্দর্যের মতো বিষয়টি তো কোনও নির্দিষ্ট শ্রেণীর একচেটিয়া হতে পারে না- এই বিশ্বাস থেকেই ‘বেস্ট ফেস বেস্ট ড্রেস’ সবার প্রাণের অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে। এই অনুষ্ঠানের রূপকার, স্টেটসম্যানের বিপণন বিভাগের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান, গোবিন্দ মুখার্জী।
দুর্গাপূজার ঠিক আগে স্টেটসম্যান সংবাদপত্রে, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এতে অংশ নেওয়ার জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল। সেটি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিভিন্ন বয়সের নারীদের, প্যান্ডেলের সামনে তোলা ছবি পাঠাতে বলা হয়েছিল। এক্ষেত্রে বয়সের একমাত্র মাপকাঠি ছিল যে, ১৮ বছরের বেশি হতে হবে। বিপুল পরিমাণ এন্ট্রির মধ্যে থেকে বাছাইয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে, চারজন নারীকে নির্বাচিত করা হয় ‘সেরা মুখ’ বিভাগের জন্য। চারজন অংশ নেন ‘সেরা পোশাক’ প্রতিযোগিতায়।
‘সেরা মুখ’ বিভাগের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ছিলেন অনুক্তা ঘোষাল, সঞ্চারী চৌধুরী দাস, দেবস্মিতা মল্লিক এবং অঙ্কিতা কর। ‘সেরা পোশাক’ বিভাগে অংশগ্রহণ করেন কৌশিকী ঘোষ, মৌমিতা মুখার্জি, নম্রতা চক্রবর্তী এবং সুদীপ্তা দাস। বিচারকের আসনে ছিলেন অভিনেতা শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, ড্রেস ডিজাইনার সাবর্ণী দাস এবং দৈনিক স্টেটসম্যান সংবাদপত্রের সম্পাদক শেখর সেনগুপ্ত। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সংগীতশিল্পী পৌষালী বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রেষ্ঠা দাস।
স্টেটসম্যানের বিপণন বিভাগের কর্মী গৌতমী বোস জানালেন, ‘নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নাবলীর ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়েছিল প্রতিযোগীদের। সৌন্দর্যবোধ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনা, আগ্রহ ইত্যাদি ব্যক্ত করার দক্ষতাই, জয়ী নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করেছিল।’
শেষ পর্যন্ত বিচারকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘বেস্ট ফেস অ্যাওয়ার্ড’-টি জয় করলেন অনুক্তা ঘোষাল। প্রথম রানার আপ অঙ্কিতা কর এবং দ্বিতীয় রানার আপ হলেন দেবস্মিতা মল্লিক। সান্ত্বনা পুরষ্কার পেলেন সঞ্চারী চৌধুরী দাস। একইভাবে ‘বেস্ট ড্রেস অ্যাওয়ার্ড’-এ সেরার শিরোপা উঠে এল নম্রতা চক্রবর্তীর মাথায়। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন সুদীপ্তা দাস। কৌশিকী ঘোষ ও মৌমিতা মুখার্জির হাতে তুলে দেওয়া হয় সান্ত্বনা পুরস্কার।
সন্ধ্যাটিকে শুধু প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, বিনোদনমূলক করে তোলা হয়েছিল সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। লোকসংগীতের জন্য জনপ্রিয় শিল্পী পৌষালী বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাম্প্রতিক সময়ে ‘বহুরূপী’ ছবি খ্যাত শিল্পী শ্রেষ্ঠা দাস, শোনান তাঁদের জনপ্রিয় গানগুলি।
প্রকৃতপক্ষে, বিজয়ীদের নাম ঘোষণা হওয়ার পরই প্রেক্ষাগৃহ করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে। অনুক্তা ঘোষাল, যিনি ‘সেরা মুখ’ বিভাগে প্রথম পুরস্কার জিতেছিলেন, তিনি বলেন, ‘জীবন মানে তো নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করা। স্টেটসম্যান আজকে যে-অসাধারণ একটি মঞ্চ দিয়েছে, সেখানে এসে আরও একবার নিজেকে যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ হল। নিজেকে চিনলাম, জানলাম এবং আমার সঙ্গে আরও যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিলেন, তাঁদের সবার কাছ থেকেই কিছু না কিছু শিখলাম।’
‘বেস্ট ফেস’ বিভাগে দ্বিতীয় রানার আপ, অঙ্কিতা কর, স্টেটসম্যান সংস্থাকে ধন্যবাদ দিয়ে তাঁর জয়ের আনন্দ ব্যক্ত করেন। ‘বেস্ট ড্রেস’ সেরা পুরস্কারে ভূষিতা নম্রতা চক্রবর্তী বলেন যে, ‘আমি আশা করিনি যে জয়ী হব। এই সাফল্যে আমি নিজেই বাকরুদ্ধ।’
‘বেস্ট ড্রেস’–এর ফার্স্ট রানার আপ সুদীপ্তা দাস বলেন, ‘আমি ভীষন খুশি এবং সকলের কাছে কৃতজ্ঞ আমায় এই সম্মান প্রদানের জন্য।’
বিচারক শুভাশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, স্টেটসম্যান তাঁর শৈশবের একটা নস্ট্যালজিয়া। এটা তাঁদের কাছে ছিল ইংরেজি শিক্ষার পাঠশালা। আজ বহু বছর পর এই সংস্থার অনুষ্ঠানে বিচারক হিসাবে উপস্থিত থাকতে পেরে তিনি ধন্য।
বিচারক হিসেবে থাকতে পেরে তাঁর আনন্দের কথাও প্রকাশ করেন সাবর্ণী দাস। তিনি শুভেচ্ছা জানান প্রতিটি প্রতিযোগীকে।
সম্মানিত অতিথিদের এবং স্পনসরদের, তাঁদের অমূল্য সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানানো হয় স্টেটসম্যান সংস্থার তরফে। এই অনন্য সুন্দর অনুষ্ঠানটি আয়োজনে সহায়তা করেছিল যে-বিপণিগুলি, তার মধ্যে ছিল মৃগনয়নী, সূর্য কুমার মোদক, মর্টন ব্র্যান্ড ঘি, ফাইভ অ্যান্ড ডাইম, ব্লসম কোচর- অ্যরোমা ম্যাজিক, দ্য ইয়েলো টার্টল, হেড টার্নার্স, বিশ্বাস ফার্নিচার এবং ইস্টার্ন ক্যাটারার।
অনুক্তা ঘোষাল
বিজয়ী (বেস্ট ফেস)
বিভিন্ন বিখ্যাত ব্র্যান্ডের হয়ে মডেলিং করেছেন তিনি। বেশ কিছু সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন, একটি বিখ্যাত ব্র্যান্ডের ক্যালেন্ডারের মুখ হিসেবেও দেখা গেছে তাঁকে। কখনও টিভি অ্যাঙ্কর কখনও রেডিও জকি এই সমস্ত ভূমিকা সামলেও, তাঁর প্রিয় শখ কবিতা লেখা। একটা সময়ে হুইলচেয়ার-নির্ভর হয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবন। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মনের জোর সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।
অঙ্কিতা কর
প্রথম রানার আপ
(বেস্ট ফেস)
পেশায় একজন গ্রন্থাগারিক। এক সহকর্মীর থেকে জানতে পেরে যোগদান করেছিলেন এই প্রতিযোগিতায়। ভাবেননি প্রথম রানার আপ হয়ে সত্যিই মঞ্চে সম্মানিত হবেন। পড়তে ভালোবাসেন। দুই মলাটের মধ্য ধরা আছে গোটা বিশ্ব। কিন্তু শুধু জ্ঞান আহরণই নয়, বিশ্লেষণের ক্ষমতাও বাড়ে পড়লে, এমনটাই মনে করেন তিনি।
দেবস্মিতা মল্লিক
দ্বিতীয় রানার আপ
(বেস্ট ফেস)
রসায়নের শিক্ষিকা হলেও, জীবনের রূপ রসকে পুরোদমে উপভোগ করতে চান দেবস্মিতা। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা তাঁর জীবনে সম্পূর্ণ একটা নতুন অভিজ্ঞতা। অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁকে প্রচুর অণুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, জানান তিনি। সহযোগিতা পেয়েছেন আয়োজকদেরও। কিন্তু এই অনুভব থেকে অনেক কিছু শিখলেন। আগামীতে নিজের বাচিক দক্ষতার প্রতি আরও যত্নশীল হতে চান তিনি।
নম্রতা চক্রবর্তী
বিজয়ী
(বেস্ট ড্রেস)
অন্তরের সৌন্দর্যকেই গুরুত্ব দেন নম্রতা, মানুষের মুখের হাসিই তাঁর সেরা পাওনা। তবু অকপটে জানান, এই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার অনুভব তাঁর কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পেশায় সাইকোলজিস্ট ও সহকারী অধ্যাপক। নম্রতা নিজের অনুভূতি প্রকাশের একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই দেখছেন এই প্রতিযোগিতাকে। অংশগ্রহণ করে তিনি খুশি।
সুদীপ্তা দাস
প্রথম রানার আপ
(বেস্ট ড্রেস)
এর আগে ফোটোশুটের অভিজ্ঞতা
থাকলেও, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় এই
প্রথমবার তাঁর অংশগ্রহণ। একটা আনন্দের অনুভূতি যেমন হচ্ছে, তেমনই প্রচুর মোটিভেশন দিয়েছে তাঁকে এই
প্রতিযোগিতা। নিজেকে প্রকাশ করতে
পারার যে-আনন্দ, তা এখানে না এলে
জানাই হতো না তাঁর— এমনটাই মনে করেন সুদীপ্তা।