আগামী ২০২০ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকেই সরকারি কর্মচারীদের বর্ধিত নয়া বেতনক্রম চালু হবে। নয়া বেতনক্রমে কারাে মূল বেতন ১০০ টাকা থাকলে তা বেড়ে দাঁড়াবে ২৮০.৯০ টাকা। সােমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জানান, ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ ছাড়াও গ্র্যাচুইটি, হাউজ রেন্ট, মেডিকেল ইত্যাদি কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী আরও বেশি হারে বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ষষ্ঠ বেতন কমিশন কার্যকর করার ক্ষেত্রে তিন বছর বিলম্ব হওয়ায় যে বর্ধিত হারে বেতন সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ছিল, সেই বেতন তারা পাবেন কিনা সেই বিষয়টি সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্ট করেননি অর্থমন্ত্রী। বলেছেন ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ মেনেই এই বেতনক্রম চালু করা হচ্ছে। এই সপ্তাহের মধ্যেই রােপা (রিভিশন অফ পে অ্যালাওয়েন্স) নয়া বেতনক্রমকে বিধিবদ্ধ করবে। বেতন এং অন্যান্য প্রাপ্তি বৃদ্ধি করতে সরকারি কোষাগারের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে।
এর আগে বেতনবৃদ্ধি বা মহার্ঘভাতার ঘােষণা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীই করেছেন। এদিন অবশ্য ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশমতাে বেতনবৃদ্ধির বিষয়টি নবান্নে জানান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। সােমবার নবান্নে পরিসংখ্যান দিয়ে অমিতবাবু বলেন, কারাে বেসিক এবং গ্রেড পে মিলিয়ে বেতন ১০০ টাকা হলে, তার সঙ্গে ১২৫ শতাংশ মহার্ঘভাতা যােগ করলে তার বেতন দাঁড়াবে ২২৫ টাকা। ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এই বেতন ১৪.২২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। যখন ১০০ টাকা বেতন দাঁড়াচ্ছে ২৫৭ টাকার মতাে। সেই সঙ্গে ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ এই তিন বছরের জন্য ‘নােশনাল এফেক্ট’ কার্যকর করে প্রতিবছর ৩ শতংশ পুঞ্জীভূত হারে বেতন বৃদ্ধি করলে ১০০ টাকা মূল বেতন সব মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে ২৮০.৯০ টাকা। তবে এক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের প্রথম নয় মাসের বেতনবৃদ্ধি হিসেবের মধ্যে থাকছে না। তবে মূল বেতনের বৃদ্ধি যা-ই হােক না কেন, অন্যান্য ভাতা প্রায় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দরাজহস্ত রাজ্য সরকার।
শুধু বেতনই নয়, সেই সঙ্গে গ্রাচুইটির ক্ষেত্রেও উর্ধ্বসীমা যা এখন ৬ লক্ষ টাকা রয়েছে। ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ ছিল, এটা বাড়িয়ে ১০ লক্ষ করার। মুখ্যমন্ত্রী এই গ্র্যাচুইটির উর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ১২ লক্ষ টাকা করতে বলেছেন।
হাউজ রেন্ট অ্যালাওয়েন্সের ক্ষেত্রেও বেতন কমিশনের সুপারিশের ওপরেও টাকা বাড়ানাের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। হাউজ রেন্ট অ্যালাওয়েন্স এখন যা আছে, বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছেন। অর্থাৎ হাউজ রেট অ্যালায়েন্স ৬০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২,০০০ টাকা করা হয়েছে। বেতন কমিশন যা ১০,০০০ করতে বলেছিল।
যেসব ডাক্তার সরকারি হাসপাতালে কাজ করলেও ব্যক্তিগত চেম্বারে প্রাকটিস করেন না, তারা নন প্রাকটিসিং অ্যালাওয়েন্স পেয়ে থাকেন। বেতন কমিশনের সুপারিশ ছিল, এই ভাতা যেন কোনােভাবেই বছরে ১ লক্ষ ৯০ হাজার বেশি না হয়। মুখ্যমন্ত্রী এই নন প্র্যাকটিসিং অ্যালাওয়েন্সের উর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ২ লক্ষ ১১ হাজার টাকা করতে বলেছেন।
রাজ্য সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভােগীরা মাসে ৩০০ টাকা করে পেয়ে থাকেন চিকিৎসাভাতা হিসেবে। সেই টাকা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে। কোনও অসুস্থতার ইন্ডাের চিকিৎসার জন্য (অস্ত্রোপচার ছাড়া) এককালীন ২০০০ টাকা সর্বোচ্চ চিকিৎসা ভাতা দেওয়া হত কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্তদের। এখন বেড়ে দাঁড়াবে ৩৫০০ টাকাতে। ৫ শতাংশ বিশেষভাবে সক্ষমদেরও আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়ে মাসিক ৮০০ টাকা করা হয়েছে।
বাড়তি সময়ের জন্য ডিউটি করলে এক্সট্রা ডিউটি অ্যালাওয়েন্স দিনপ্রতি ২৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়েছে। টিফিন অ্যালাওয়েন্স হিসেবে সরকারি কর্মচারীরা ঘন্টায় ১০ টাকা এবং দিনে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা পর্যন্ত পেতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সেই ভাতা বাড়িয়ে ঘন্টা প্রতি ৩০ টাকা এবং দিন প্রতি সর্বোচ্চ ১৮০ টাকা করা হল।
মেকানিক্যাল শাখায় কাজ করা এবং পুলকারের ড্রাইভার, সচিব সহকারী, সরকারি প্রােটোকল শাখায় কাজ করা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও টিফিন অ্যালাওয়েন্স বাড়িয়ে ঘন্টা প্রতি ৭ টাকা করা হয়েছে।
সরকারি কর্মচারীদের এই বেতনবৃদ্ধি চিত্রটি সবাইকে খুশি করতে পারেনি। সরকারি কর্মচারীদের আশা ছিল তারা ২০১৬ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে এই নয়া বেতনক্রমে বকেয়া পাবেন। কিন্তু এই বর্ধিত বেতন ২০২০ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ায় অনেকেই হতাশ। রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের পক্ষে মনােজ চক্রবর্তী বলেন, এর ফলে যাঁরা এই ১৬ থেকে ২০ সালের মধ্যে অবসর নিলেন তারা এই বর্ধিত বেতনের সুযােগ পেলেন না। এছাড়া পেনশনভােগীদের জন্যও এই বর্ধিত বেতনক্রম চালু করার কোনও সিদ্ধান্ত ঘােষিত হয়নি। এঁদের পেনশনের হার বাড়ানাের জন্যও আবেদন জানান মনােজবাবু।
সরকারি কর্মচারীদের বিজেপি সংগঠনের পক্ষ থেকে দেবাশিস শীল বলেন, ১৬ থেকে ২০ সালের পয়লা জানুয়ারি পর্যন্ত চার বছরের বকেয়া প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হল সরকারি কর্মচারীদের। এই সময়ের প্রভিডেন্টও বর্ধিত হারে দেওয়া হল না, যা নজিরবিহীন। বাম আমলেও ‘রােপা’র মেয়াদ এতদিন (চার বছর) ফেলে রাখা হয়নি। দেবাশিসবাবুর আরও বক্তব্য, মহার্ঘভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রেও বকেয়া রেখে দিয়ে রাজ্য সরকার আদালতকে পর্যন্ত অবমাননা করল। স্যাট’এর রায়ে বলা হয়েছিল ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হওয়ার আগেই বকেয়া মহার্ঘভাতা মিটিয়ে দিতে হবে। কিন্তু রাজ্য সরকার এই চার বছরে বকেয়া সম্বন্ধে কোনও কথাই বলেনি। নয়া বেতনক্রম কার্যকর করার ক্ষেত্রে কৌশলে যে প্রবঞ্চনা করা হয়, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের, তার বিরুদ্ধে পুজোর পর আন্দোলন সংগঠিত করা হবে বলে জানান রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বিজেপি সংগঠনের আহ্বায়ক দেবাশিস শীল।