বনেদি বাড়ির পুজো ছাড়া কলকাতায় অসম্পূর্ণ থেকে যায় বাঙালির দুর্গোৎসব। ঘড়ির কাঁটা ধরে পুরনো আচার-অনুষ্ঠান মেনে পুজোর প্রতিটি নিয়ম নিখুঁতভাবে পালন করা হয়ে থাকে ঐতিহ্যবাহী বনেদি বাড়ির পুজোগুলিতে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বনেদি বাড়ির দ্বার উন্মুক্ত হয় উৎসবপ্রিয় আপামর মানুষের জন্য। কালক্রমে আপন আপন ধারায় বয়ে চলা নদীর মতো প্রতিটি বনেদি বাড়ির পুজোতেই আছড়ে এসে পড়ে উৎসবের সুনামি।
কিন্তু এবছর ছবিটা অন্যরকম। আরজি করের ঘটনার পর বিষাদের সুর সর্বত্র। মহালয়ার পর থেকে ভোরের আকাশের সোনালি রোদের পরশ গায়ে মেখে যে-উৎসবে সামিল হতে হাতে খড়ি শুরু হয়ে যায়, এবার তা ম্লান হয়ে গেছে আরজি করের তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস হত্যার ঘটনায়। নিষ্ঠার সঙ্গে নির্ঘন্টসূচী মাফিক দেবীর আরাধনা হলেও, ঐতিহ্য মেনে জাঁকজমকের ব্যবস্থা বা শোভাযাত্রার আয়োজন থেকে নিজেদের বিরত রাখছে কিছু বনেদি বাড়ির পুজো।
শোভাবাজার রাজবাড়ির জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপুজোর কথা কারও অজানা নয়। এই পুজো শুরু করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব ১৭৯০ সালে। বর্তমানে এই পুজো তাঁর ছোটছেলে রাজা রাজকৃষ্ণ দেবের বংশধরেরা আয়োজন করেন। এই পুজোর সঙ্গে মিশে রয়েছে ইতিহাসের গন্ধ। তবে এবছর পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, নিয়মরক্ষায় ভাটা না পড়লেও, সাবেকিয়ানার এই পুজোয় জাঁকজমক, আড়ম্বর একেবারেই থাকছে না।
পরিবারের তরফে তীর্থঙ্কর দেব জানিয়েছেন, আগে পুজোর সময় ঢাকের সঙ্গে স্কটিশ ব্যান্ডের যুগলবন্দি এক অন্যতম আকর্ষণ ছিল। পঞ্চাশের দশক থেকেই পুজোর শোভাযাত্রায় বাজানো হয়ে আসছে এই ব্রিটিশ ঘরানার ব্যান্ড। রাজবাড়ি থেকে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত রাস্তা দিয়ে শোভাযাত্রার সময় ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটি বাজানো তাঁদের রীতির মধ্যে পড়ে। কিন্তু এবার পুজোয় সেই ব্যান্ড বাজানো বন্ধ রাখা হয়েছে।
জানবাজারে রানি রাসমণির বাড়ির ২৩৪ বছরের পুরনো পুজোটি অত্যন্ত ঐতিহ্যশালী। একসময়ে এই পুজোয় হাজির হতেন স্বয়ং শ্রী রামকৃষ্ণদেব। তাঁর সেই মাহাত্ম্য আজও এবাড়ির দালানে জড়িয়ে রয়েছে।
এই পুজোতেও এবার আরজি করের প্রভাব। পরিবারের সদস্য প্রসূন হাজরা জানিয়েছেন, নির্যাতিতার স্মরণে পুজোর দিনগুলিতে এক মিনিট করে নীরবতা পালন করা হবে। পুজোর ভোগ এই বাড়ির এক অন্যতম আকর্ষণ। সেই আয়োজনেও রাশ টানার কথা ভাবা হয়েছে। আর জি কর-আবহে এই প্রথম জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয় রাসমণির পুজো।
উত্তর কলকাতার লাহাবাড়ির পুজো ২০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করছে। এবছর লাহাবাড়ির শ্রীকৃষ্ণ লাহার উত্তরসূরি বিশ্বনাথ লাহার পালা। তিনি ছোটবাড়ির কর্তা। প্রতি বছরের মতো বহু আত্মীয়সমাগম যেমন হবে, তেমনই আসবেন বন্ধু-প্রতিবেশীরাও। কোনও ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
এই বাড়িরই নবকৃষ্ণ লাহার উত্তরসূরি মেজবাড়ির সুস্মেলী দত্ত জানালেন, ‘আড়ম্বর কোনও বছরই থাকে না। পুজোর ক্ষেত্রে কঠোরভাবে নিয়ম রক্ষা করাই পুজোর মূল লক্ষ্য। অন্যান্যবারের মতো লাহাবাড়ির দরজা এবারও সবার জন্য উন্মুক্ত।’
উত্তর কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত বনেদি বাড়ির পুজো জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ির পুজো। মা দুর্গা এখানে সোনার অলঙ্কারে আবৃত থাকেন। দাঁ বাড়ির প্রতিমার খ্যাতি ছিল সাগর পার থেকে আনা গয়নার জন্য। কথিত আছে, উমা এসে দাঁ বাড়িতেই তাঁর গয়না পরেন, সাজসজ্জা করেন। সেই প্রথা আজও ধরে রাখা হয়েছে।
পরিবারের তরফে প্রিয়ব্রত দাঁ বলেছেন, ‘আর জি করের ঘটনায় সকলেই শোকাহত। তাই এবার পুজোর আমন্ত্রণপত্র পাঠানো বন্ধ রাখা হয়েছে। পুজোর দিনগুলিতে জনসাধারণের প্রতিমা দর্শনে বাধা নেই। তবে পুজোর দালানে দাঁড়িয়ে ভিডিও করা বা রিল বানানোর অনুমতি দেওয়া হবে না।’
জোড়াসাঁকোর নরসিংহ দাঁ বাড়ির পুজোয় অবশ্য তেমন কোনও কাটছাঁট করা হয়নি। ধর্ষণ-খুনের ঘটনার প্রতিবাদ তাঁরাও করছেন । কিন্তু পুজোর সঙ্গে তাকে মেলাতে চান না এই পরিবার। পুজোর দিনগুলিতেও সর্বসাধারণের জন্য খোলা থাকবে এবাড়ির দরজা।
প্রকৃতির নিয়মে শরৎ এসেছে। ছাতিম আর শিউলির গন্ধে ম’ ম’ করছে পাড়া। তবু যেন কোথাও একটা ছন্দপতন, কোথাও দারুণ অসঙ্গতি।
প্রতিবাদ আর আন্দোলনের ঢেউ এখন শহর জুড়ে। সেই আন্দোলনের আঁচ এসে লেগেছে বনেদি বাড়ির পুজোগুলিতেও। এ যেন বাড়ির মেয়ের জন্য সবার মনেই বিষাদের সুর। সেই বেদনার আবহে, উৎসবে এবার ভাঁটার টান। আনন্দ, আড্ডা, হৈহুল্লোড় বাদ দিয়ে তাই এবার শুধু নিষ্ঠাভরে পুজোতেই হোক শারদোৎসব।