অসিত কর্মকার
জয়া বলল, চলো এই শীতে সুন্দরবন ঘুরে আসি৷ শীতকাল, ঝড়-বন্যার ভয় নেই, নদীও শান্ত৷ তনয় বলল, হ্যাঁ, চলো যাই৷ বাঘ ইদানীং ঘন ঘন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে৷ বাঘের সঙ্গে হরিণেরও দেখা পাওয়া যেতে পারে৷ ভাগ্যে থাকলে বাঘের শিকার ধরে খাওয়ার দৃশ্যও৷ দাঁড়াও, সবুকে ফোন করি৷ ও সব ব্যবস্থা করে দেবে৷ বিয়ের আগে বার তিনেক ওর সঙ্গে গেছি৷ একবারও বাঘ বা হরিণের দেখা পাইনি৷ লাস্ট বারে বাঘের পায়ের কাঁচা ছাপ দেখেছিলাম৷ সবু বলল, আর কিছুক্ষণ আগে এলে বাঘের দেখা পেতাম৷ ওটুকুই তিনবারের বড় পাওয়া৷ এবার আর ব্যর্থ হয়ে ফিরছি না৷ না দেখতে পাওয়া পর্যন্ত বনের ধারে বোট নোঙর করে রাখব! যেন জেদ চেপে গেল তনয়ের৷
জয়া খিলখিল করে হেসে বলল, অদ্ভুত তোমার শখ৷ বনে গেলে বাঘ হরিণ দেখতেই হবে! ওখানকার মানুষজন, ইতিহাস, ভূপ্রকৃতিকে জানা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করাই তো আসল৷
তনয় বলল, কেন চাইব না! বন্যেরা বনে কতটা সুন্দর তা উপভোগ করতে চাই আমি৷ বার বার পয়সাগুলোই জলে যাচ্ছে!
ফের হেসে উঠল জয়া৷ বলল, তোমার বন্ধুকে বলো, বাঘকে ডেকে এনে বনের ধারে দাঁড় করিয়ে দিক৷ বলেছিল না, খাওয়ার পাতের সামনে বসে থাকে! মনের আশ যতক্ষণ না মেটে দেখবে৷ হা হা হা!
হাসলে জয়াকে আরও দারুণ দেখতে লাগে তনয়ের৷ হাসির সঙ্গে দেহের লীলায়িত ভঙ্গিমা মনে আগুন ধরায়৷ জয়া সুন্দরী যাকে বলে তা নয়৷ অদ্ভুত এক চার্মিং ফেস৷ তেমনি সুঠাম সুন্দর স্লিম ফিগার৷ বিয়ের চার বছর পরেও মন থেকে জয়ার ঘোর কাটেনি তনয়ের৷ ব্যাচেলর লাইফের উচ্ছন্ন মন বিয়ের পরে এখন শুধু জয়াতে সমর্পিত৷ মা হতে চায় জয়া৷ তনয় এখনই চায় না৷ বারবার চাকরিতে আরও একটু উন্নতির অজুহাত দেয়৷ আসলে মা হলেই তো জয়ার এত সুন্দর শরীরস্বাস্থ্যে শিথিলতা আসবে৷ মা মা আবেদন শরীরে বাসা বাঁধবে৷ সন্তানের প্রতি মায়ের টান, স্নেহভালবাসা যত বাড়বে ততই তনয় তাদের দাম্পত্য জীবনের বৃত্তের পরিধির দিকে সরে যাবে৷ বলে, মাত্র তো আটাশ, আরও ক’টা বছর যাক! জয়া সবই বোঝে, ওই যে, মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এক আছে না! তার আত্মীয়া, বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে সবাই একে একে মা হয়ে গেল৷ ফলে জয়া নিজেকে ফেল করাদের দলে পডে় যাওয়া ভাবে৷ সেজেগুজে গিফট হাতে নিয়ে শুধু অন্নপ্রাশন আর জন্মদিন খেয়ে যাওয়া! ওরাই বা ছাড়বে কেন? প্রবল কৌতূহল নিয়ে পেছনে পডে় থাকে৷ কবে সুখবর পাচ্ছি! আর কত দেরি করবে শুনি! সমস্যা কিছু আছে কিনা তা নিয়েও কানাঘুষো হয়৷ মায়ের সঙ্গে দেখা হলে ঘুরেফিরে তাঁর একটাই কথা, এবার নিয়ে নে৷ শাশুড়িমা বলেন, আর দেরি কোরো না বউমা, তোমার শ্বশুরমশাইও তাই বলেন৷ আমরা থাকতে থাকতে…
জয়া চিডি়য়াখানায় হরিণ, বাঘ দেখেছে৷ হরিণের পেছনে ছুটন্ত বাঘ শুধু টিভিতে দেখেছে৷ এবার হয়ত বাস্তবে দেখবে৷ মনে মনে এক কাল্পনিক দৃশ্যে বিভোর হয়ে উঠতে থাকে জয়া৷ ত্রস্ত হরিণের পেছনে ছুটন্ত ক্ষুধার্ত বাঘ৷ টু্যরিস্টদের বিস্ফারিত দু’চোখ৷ মনে আশঙ্কা, রোমাঞ্চ৷ কে জেতে, বাঘ না হরিণ৷ জয়া শুনেছে, জেতার কথা নাকি হরিণেরই৷ কিন্ত্ত ওর ওই শিংই অভিশাপ৷ লতাপাতায় জডি়য়ে গেলে আর কিছু করার থাকে না৷ পরে অবশ্য জয়ার এই ধারণা ভেঙে যায়৷ সে জানতে পারে, হরিণের চেয়েও বাঘ বেশি গতিসম্পন্ন৷ লতাপাতায় শিং জডি়য়ে যাওয়াটা ওর বাড়তি অভিশাপ৷ টু্যরিস্টরা মনে মনে দু’দলে ভাগ হয়ে যায়৷ একদল মনে করে, এমন বিরল দৃশ্য দেখা যতই সৌভাগ্যবশত ঘটুক দুর্বল অসহায় হরিণেরই যেন জয় হয়৷ আরেক দল, যাদের কাছে হরিণ মায়াধরা প্রিয় প্রাণী হলেও তারা শিকার করার দৃশ্য উপভোগ করতে ভালবাসে৷ শুধু শিকার করা নয় শিকারকে ছিঁডে়কুটে তারিয়ে তারিয়ে ভক্ষণ করা দেখতেও পছন্দ করে৷ তনয় হাঁ হয়ে টিভিতে ওসব দেখতেই থাকে৷ অনেক বলেও তনয়কে বিরত করতে পারে না জয়া৷ শেষে নিজেই টিভির সামনে থেকে উঠে চলে যায়৷ তার শরীর জুডে় তখন কেমন এক ঘিনঘিনে ভাব, ভয়ের আবেশ৷ শিকার হওয়া পশুটার জন্য বড় কষ্ট হয়৷
বাঘ বন ছেডে় লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে৷ লোক, গবাদি পশু মারছে৷ ওদিকে করোনার পর ওমিক্রন থাবা বসাচ্ছে৷ ঘটনা দুটোকে সোশ্যাল মিডিয়া খুব প্রচার দিচ্ছে৷ সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক৷ আরও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠার আগেই টুক করে টু্যরটা সেরে ফেলতে চায় তনয়৷ আজ ছুটির দিন৷ বাডি়তেই আছে৷ কবে যাবে, কারা কারা যাবে, কীভাবে যাবে, কোথায় থাকা হবে ইত্যাদি নিয়ে মেতে উঠল তনয়৷ যা কিছু বুক করার এখনই করে ফেলতে চায়৷ ফোনের পর ফোনে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, অফিস কলিগ কাউকে জানাতে বাদ রাখছে না৷ পরে কেউ যেন তাকে দোষারোপ না করে৷ ওই ঘরে জয়াও ব্যস্ত, একে ওকে ফোন করে ঘুরতে যাওয়ার খবরটা জানাচ্ছে৷ জয়া আর তনয় দু’জনেই ভ্রমণপ্রিয়৷ ছুটিছাটা পেলেই দলবেঁধে হৈ হৈ করে বেরিয়ে পডে়৷ দলের পাণ্ডা হয় অবভিয়াসলি তনয়৷ জয়া তার সহকারী৷
ফোনে সবুকে ধরার চেষ্টা করছে তনয়৷ সবু তনয়ের কলেজ জীবনের বন্ধু৷ সেই বন্ধুত্ব এখনও অটুট৷ পুরো নাম সবুজাভ হালদার৷ সবুজাভ থেকে সবুজ৷ বন্ধুত্ব গাঢ় হতে এখন শুধু সবু৷ সুন্দরবনের কাছে বাসন্তী গ্রামে বাডি়৷ বাবা স্কুল শিক্ষক৷ শিক্ষিত এবং মোটামুটি খেয়েপরে থাকা সাধারণ পরিবার৷ উচ্চ শিক্ষার জন্য এই শহরে এসেছিল সবুজাভ হালদার৷ ফিনফিনে চেহারা৷ চাকচিক্যহীন সাধারণ পোশাক-আশাক৷ সহজসরল মনের দেখতে৷ কথা কম বলে৷ শোনা আর দেখায় মন বেশি৷ এই শহরকে মাপে সবুজাভ৷ এতদিনের জীবনকে এখন থেকে কী কী দিয়ে ঘিরে রাখবে সে, নাকি এমনই আটপৌরে থেকে যাবে, এসবই হয়ত ভাবে৷ প্রকাশ পায়, সবুজাভ পড়াশোনায় ভাল৷ স্কুলজীবনের মতোই প্রতিদিনের পড়া করে কলেজে আসে৷ অবাক করা ব্যাপার! সহপাঠীদের প্রশংসার সঙ্গে খানিক ঠাট্টা বিদ্রুপ জোটে৷ তবে সময়ের সঙ্গে সমীহের চোখে দেখাটাই বড় হয়ে ওঠে৷ প্রফেসররা অন্যদের উদ্দেশে বলেন, ফলো সবুজাভ হালদার! সবুজাভকে আরও বেশি করে জানার কৌতূহল জাগে আদ্যোপান্ত শহুরে তনয়দের মনে৷ অফ পিরিয়ডগুলোয় ওকে ঘিরে যত কৌতূহল নিরসনে সবাই ঝাঁপিয়ে পডে়৷
সুন্দরবন! সে তো বাঘের দেশ রে, দেখেছিস্ কখনও?
সবুজাভ চুপ৷ সবাই ধরে নেয় বাঘের দেশে থেকেও বাঘই যখন দেখেনি, তখন ওর সঙ্গে ঠিক জমবে না৷ আসলে সবুজাভ তখন এক যুৎসই উত্তর খুঁজছিল৷ সুন্দরবন শুনলেই কেন যে মানুষের মনে শুধু বাঘ আর বাঘ জেগে ওঠে! কেন, আর কিছু নেই! আরও কতরকমের পশু,পাখি, জলজ প্রাণী৷ গাছগাছালি, নদী, খাঁডি়, সোঁতা৷ উপকূল আর মরা নদীর বুকে জেগে ওঠা অসংখ্য দ্বীপভূমির সৌন্দর্য৷ বাসিন্দাদের অপরিসীম দুঃখ কষ্ট বঞ্চনা৷ এসব বাদ দিয়ে শুধু বাঘ কীকরে মাথা উঁচিয়ে থাকে৷ সে তো এদেশে বহিরাগত পশু৷ দীর্ঘদিন এদেশের মাটি জল হাওয়ায় লালিতপালিত হয়ে এ মাটির হয়ে গেছে৷ হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা আর বুদ্ধিমত্তার জোরে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া যুৎসই খেতাবও জুটেছে এক, দ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার! শিক্ষক বাবার মুখে শোনা এ বাঘের হাজার হাজার মাইল পাডি় দিয়ে শেষে এ দেশে থিতু হওয়ার কাহিনি বলে সবুজাভ৷ রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলের তীব্র শীত তার উপর খাদ্যের অভাব৷ বেঁচে থাকা আর বংশ রক্ষার জন্য উষ্ণ অঞ্চলের দিকে পাডি় জমায় ওরা৷ দলে দলে বিভিন্ন দিকে ছডি়য়ে পড়তে থাকে৷ একটি দল মঙ্গোলিয়া, চীন, মায়ানমার হয়ে উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে ভারতে ঢুকে পডে় ফের দলে দলে ভাগ হয়ে এদেশের বিভিন্ন দিকে ছডি়য়ে পডে়৷ একটি দল বঙ্গদেশে ঢুকে পডে় ধীরে ধীরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পাডি় দিয়ে সুন্দরবন অঞ্চলে ছডি়য়ে পডে়৷ এখানে জোয়ার ভাটার সঙ্গে খেলা করে লবণাক্ত ভূমি৷ বুনোশূকর, মোষ, হরিণ, বনমোরগ ওদের খাদ্য হয়৷ বনের উপর নির্ভরশীল গরীবগুর্বো মানুষগুলোরও রেহাই হয় না৷ আরও দক্ষিণে সাগর মোহনায় অনেক নদীর জড়ামুডি়, দ্বীপপুঞ্জ, খাডি় আর সোঁতা৷ সবুজের সমারোহ৷ তারপর দলদলে কাদামাটির অবনমন শেষে সমুদ্রের বুকে হারিয়ে যাওয়া৷ মাটি আর নেই৷ জল আর জল৷ বাঘ বন্দি হয় এদেশের সীমান্ত ঘেরে৷
সবুজাভ বলল, খেতে বসলে যেমন ঘরের বেড়াল পাতের পাশে এসে বসে তেমনি আমাদের পাতের পাশে বাঘ এসে বসে৷ পাত থেকে তুলে মাছ মাংস খেতে দিই৷ গবগব করে খায়৷ স্বাভাবিক কন্ঠ সবুজাভের৷ চোখেমুখে আলাদা কোনও অভিব্যক্তি ফুটল না৷ শুনে হতভম্ব সবাই৷ তবে তা তাৎক্ষণিকই৷
পরমুহূর্তেই সবুজাভের পিঠ চাপডি়য়ে দিয়ে একে একে বলে উঠল, হেব্বি দিলি তো! তুই মাইরি ছুপা রুস্তম আছিস! হেভি উইটি মাল তুমি একটা! হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ওয়েল সেইড, ওয়েল সেইড, কনগ্রাচুলেশন ইয়ার! এভাবেই সুন্দরবন সম্পর্কে ওদের আরও কতকিছু জানা হল৷ একটু একটু করে সবুজাভ সবার সঙ্গে সড়গড় হয়ে ওঠে পুরো সুন্দরবনের মাটি, মানুষ, জল, গাছপালা, প্রকৃতি আর তার ইতিহাস নিয়ে৷
তোর এইম ইন লাইফ কী সবুজাভ?
এ জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে দেরি করল না সবুজাভ৷ প্রত্যয়ী গলায় বলল, স্কুলশিক্ষক হতে চাই আমি৷
সবাই বিস্মিত৷ এত ভাল পড়াশোনায় হয়ে কিনা সামান্য শিক্ষক!
আদর্শ শিক্ষক! এ আমার ভাল লাগার জায়গা৷ দৃঢ় কন্ঠে বলল সবুজাভ৷
শিক্ষকই হল সবুজাভ৷ নিজের জেলায়, নিজের অঞ্চলে৷ বাডি় থেকে যাতায়াত করে৷ বিয়ে করেছে বাডি়র পছন্দের মেয়েকে৷ বছর না ঘুরতেই সে মেয়ের বাবা হল৷ এই নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে ঠাট্টামস্করা কম হয়নি৷ এত ধীরস্থির ছেলেটার মধ্যে এত তাড়াহুড়ো ঘাপটি মেরে ছিল! ওর বউ রূপা নিপাট গৃহবধূ৷ সুখে আছে ওরা৷ যদিও তনয়রা মাঝেমধ্যেই আফসোস করে বলে, একটি প্রতিভার অপমৃতু্য৷ ও চাইলেই বিরাট কিছু হতে পারত৷
সবুজাভকে ফোনে পেল তনয়৷ বলল, সবু, তুই আছিস কেমন? অনেকক্ষণ ধরে ট্রাই করছি…৷ ফের সুন্দরবন টু্যরের ব্যবস্থা করতে হবে তোকে৷ এবার বড় দল৷ সবাই উইথ ফ্যামিলি৷ তুইও ফ্যামিলি নিয়ে যাবি৷ কোনও ধানাইপানাই শুনব না৷ বাঘ বেরুচ্ছে…৷ আশা করছি, এবার আর মিস্ হবে না৷ হরিণও জুটে যেতে পারে৷ দু’দিনের টু্যর, বড় বোট আর ভাল রিসর্ট চাই৷ যত জলদি পারিস, করোনার ছোটভাই ওমিক্রন ছড়াচ্ছে, ফের রেস্ট্রিকশন ঘোষণার আগেই…, বুঝলি…৷ তুই আজকালের মধ্যেই কী ব্যবস্থা হল জানা৷
তনয় বড় একগুঁয়ে আর জেদি৷ যেটা করতে চায় সেটা করেই ছাডে়৷ আর তা যত শীঘ্র সম্ভব৷ এতে অবশ্য তনয়ের চাকরি জীবনে দেদার সাফল্য এসেছে৷ মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে প্রমোশনের পর প্রমোশন পেয়ে এখন অফিসার তনয়৷ ব্যবস্থা করার জন্য সবুজাভকে তাড়া লাগাল৷ এ সময়টা সুন্দরবন ঘোরার পিক টাইম৷ থাকা ঘোরার ব্যবস্থা সব অনেক আগে থেকেই বুকড হয়ে যায়৷ তার মধ্যেও চেষ্টাচরিত্র করে সবুজাভ ব্যবস্থা করে দেয়৷ কিন্ত্ত এবার কি পারবে সে? ঘন ঘন বাঘ বেরোচ্ছে যে! ওই টানে টু্যরিস্টরাও হামলে পড়ছে৷ সবুজাভকে বুদ্ধি জোগাল তনয়, শোন সবু, পাওয়া মুশকিল জানি, তুই শুধু ওৎ পেতে থাক, ওমিক্রন ঠেকাতে যে কোনও সময়ে রেস্ট্রিকশন ঘোষণা হতে পারে ভেবে অনেকে বুকিং ক্যান্সেল করতে পারে, যাতে করে পুরো টাকাটা চোট না যায়! ওই ফাঁকগুলোয় আমাদের জন্য ব্যবস্থা করে দিবি৷ সবাইকে বলে ফেলেছি, প্রেস্টিজ ইসু্য, বুঝলি…৷
পাশের ঘরে এল তনয়৷ বেশ হূষ্ট চিত্ত৷ বিশ্বাস, একটা ব্যবস্থা সবুজাভ করবেই৷ জয়া বিছানায় উপুড় হয়ে আধশোয়া৷ পা দুটো আলম্ব ভাঁজ করা৷ হাউসকোটসহ পেটিকোট অনেকটা নেমে যেতে সুডোল, কাঞ্চনদীপ্ত পায়ের গোছ উন্মুক্ত জয়ার৷ কামনার হাতছানি মন উচাটন করে দিচ্ছে তনয়ের৷ পুব দিকের জানালা দিয়ে বড় একফালি রোদ এসে পডে়ছে বিছানায়৷ তারই কিছুটা গডি়য়ে নেমেছে মেঝেতে৷ থেকে থেকে রোদে তাত টুকরো টুকরো হাওয়ার দাপুটে খেলা চলছে ঘর জুডে়৷ সবমিলিয়ে বেশ একটা আনছান ভাব লাগছে তনয়ের মনে৷ কার সঙ্গে এত কথা বলছে জয়া! ওফ্, মেয়েরা পারেও, এত কী যে কথা থাকে ওদের! ধৈর্য হারাল তনয়৷ একরকম ঝাঁপিয়েই পড়ল জয়ার উপর৷ পেছন থেকে বাঘ যেমন…৷ ডান হাত বাডি়য়ে জয়ার পুরো কাঁধটা আঁকডে় ধরল, ডান হাঁটু দিয়ে কটিদেশের দখল নিতে জয়া তনয়ের দেহফাঁসে জডি়য়ে গেল৷ পিঠের উপর ছড়ানো ঘন কালো চুল এলিয়ে পডে় জয়ার কাঁধ আর ঘাড় ঢেকেছে৷ যেন বনমেখলা৷ জয়ার কাঁধ আর মাথার সঙ্গম ঢালে মাথা ঢুকিয়ে তনয় বজ্রনির্ঘোষ ডাক ছাড়ল, হালুম! বলল, খুব দায়িত্ব সচেতন ছেলে সবু, ও ঠিক ব্যবস্থা করে ফেলবে, দেখো৷ বাঘের দেখা এবার আর কেউ আটকাতে পারবে না৷ হরিণের পেছনে ছুটন্ত বাঘ, আহা কী রোমহর্ষক দৃশ্য!
জয়া সহসা বেসামাল৷ কপট বিরক্তি দেখিয়ে দেহে মোচড় মেরে তনয়কে দূরে হঠিয়ে দিতে চাইল৷ চাপা গলায় বলল, এ কী বিরক্তিকর কাণ্ড! একজনের সঙ্গে কথা বলছি তো নাকি, সরো প্লিজ! ছিঃ, ছিঃ, তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান নেই? অসভ্য একটা! ফোন অন আছে, দীপান্বিতা কিন্ত্ত সব শুনছে!
কিন্ত্ত তনয় আরও কঠিন করে জয়াকে জাপ্টে ধরে বলল, পালে বাঘ পডে়ছে, বুঝলে? হালুম… হুলুম…!
ও প্রান্ত থেকে দীপান্বিতার রোমাঞ্চশিহরিত প্রগলভ কথা ভেসে এল, তনয় তোকে খুব প্যাম্পারিং করছে, না রে! এনজয় ইট৷ কবে থেকে তোকে বলছি, এবার নিয়ে নে!
চুপ করলি তুই, যাচ্ছেতাই একটা! কিসের মধ্যে কী, পান্তাভাতে ঘি! নিয়ে নে বললেই যেন নেওয়া যায়৷ নিজেরা নিয়েছিস, জানিস না? এতই সহজ! কপট রাগ, আনন্দ, মজা উপভোগের মধ্যে দিয়ে দীপান্বিতার সঙ্গে বেশ সময় গড়ায় জয়ার৷ বলল, প্যাম্পারিং না হাতি! ডিসটার্বিং এ্যানিমেল একটা! তনয়ের উদ্দেশে বলল, সরে শোও বলছি! কনুই উঁচিয়ে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল জয়া৷ তনয় সরল না৷ উল্টে বেহায়ার মতো নিরুচ্চারে হাসছে৷
দীপান্বিতা খিলখিল করে হেসে উঠল৷ তারপর ফিসফিস করে বলল, এই সুযোগে কন্ডিশন করিয়ে নে, তুই যা চাইছিস তা না পেলে…৷ এমনকী ওর সঙ্গে কোত্থাও ঘুরতেও যাবি না! তবে যদি তনয়টার শিক্ষা হয়!
যাঃ, এ হয় নাকি, তোকে না মারব এক গাট্টা! খুব পেকেছিস কিন্ত্ত তুই দীপান্বিতা!
উচ্চস্বরে হেসে উঠল দীপান্বিতা৷ সে হাসির দমক তনয়ের কানেও গেল৷ জিজ্ঞেস করল, কী বলছে দীপান্বিতা?
জয়া বলল, কী আর বলবে, সবাই আমাদের কাছ থেকে যা এক্সপেক্ট করে৷ আর বলল, না পেলে সব বন্ধ! বলেই হেসে উঠল জয়া৷ কষ্টের হাসি৷ বলল, সবুজাভদাকে দেখ না, বউ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে দিব্যি সংসার করছে না সে? তোমার যত লোভই আমার কষ্টের কারণ! জয়া এখন সিরিয়াস৷ দীপান্বিতা বুঝল, ওদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারে এর বেশি ইন্ধন জোগানো ঠিক নয়৷ বাকিটুকুর ব্যবস্থা জয়া নিজেই করে নিতে পারবে৷ বলল, এ্যাই,আমি রাখছি রে৷ টু্যরের কী ব্যবস্থা হল জানাস৷
তনয় এখনও জয়াকে জডি়য়ে ধরে শুয়ে থাকলেও বন্ধন শিথিল৷ এই সুযোগে চট করে বিছানা থেকে নেমে পড়ল জয়া৷ চুল, ড্রেস ঠিকঠাক করতে করতে বলল, আমি কিন্ত্ত সুন্দরবন যাচ্ছি না৷ যদিও আমিই যাওয়ার কথা উত্থাপন করেছিলাম কিন্ত্ত এখন ফিরিয়ে নিচ্ছি৷ তুমিও আমাকে আর কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বলবে না৷ এখন থেকে এই নিয়ে কেউ কথা বললে তুমি জবাব দেবে৷ আশা করি সত্যিটাই বলবে৷ ধুপধুপ পা ফেলে রান্নাঘরে ঢুকে গেল জয়া৷ চা বসাবে৷ মাথাটা খুব ধরেছে জয়ার৷
তনয় এখনও বিছানায় চুপচাপ শুয়ে৷ শরীরমন ছেডে় দেওয়া শিথিল বাঘ এক৷ কী যেন ভাবছে৷ দু’জনের মনের সেতুবন্ধন আরও শক্ত করতে একটি শিশুর আসার কথা! নিজেকে প্রশ্ন করে তনয়, কেন সে এমন স্বার্থপরের মত আচরণ করছে? দু’জনের মাঝে তৃতীয় একজন যে আসার তাকে কেন সে এত অপেক্ষা করিয়ে রাখবে৷ কিসের অভাব আছে তাদের যে শিশু বঞ্চিত থাকবে৷ আরও উন্নতি আরও উন্নতি আর জয়ার শরীরী আবেদনের ঘোর এই দুইয়ের ঘেরাটোপে বন্দি তনয় বুঝতে পারছে তার জগৎ আজ কত ছোট! একটি শিশুর আগমনেরও অধিকার নেই সে জগতে! এই সুন্দর পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ আর তাদের আদর স্নেহভালবাসা থেকে তাকে বঞ্চিত করে রাখার অধিকার তার নেই৷ এ পাপ, এ অন্যায়৷ ছোট্টবেলার একটা বাঁধানো ছবির কথা মনে পড়ছে তনয়ের৷ মায়ের কোলে বসে আছে সে৷ নাদুসনুদুস ভারি মিষ্টি দেখতে৷ মায়ের সারা মুখমণ্ডল জুডে় সন্তানের প্রতি বাৎসল্যের অনির্বচনীয় এক আলোর আভা৷ সবাই খুব প্রশংসা করে ছবিটার৷ পৈতৃক বাডি়তেই রয়ে গেছে ওটা৷ ফ্ল্যাট কিনে কলকাতার এই দক্ষিণে চলে আসার সময় সমস্ত জিনিসপত্র গোছানো সারা৷ নীচে লরি দাঁডি়য়ে৷ জয়া ওর শাশুড়িমায়ের কাছে আব্দার করেছিল, ওই ছবিটা নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ শাশুডি়মা মনে আঘাত পেলেও মুখ ফুটে কিছু বলেননি৷ পলকহীন পাথরের মূর্তির মত জয়ার দিকে তাকিয়েছিলেন৷ জয়ার তখন অপ্রস্তুত অবস্থা৷ নিজের ভালো লাগা থেকে বলা কথাটা যে এতটা কঠিন আঘাত হানবে তা বুঝতে পারেনি জয়া৷ শ্বশুরমশাই পরিস্থিতি সামাল দিতে বলেছিলেন, না বউমা, ওটা এ বাডি়তেই থাক৷ তোমরা তো সবসময়ই আসা যাওয়া করবে৷ ছবিটা দেখবে৷ তনয়ও ওর বাবার সঙ্গে যোগ দিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটা কেন ফ্ল্যাটে যাবে! এখানেই থাকবে৷ মায়ের ওই দৃঢ় মূর্তি ভুলতে পারে না তনয়৷ ভাবে তনয়, ওই ছবিটার আবেদনই কি জয়ার মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে আরও উদ্বেলিত করে তোলে? পৃথিবীতে আরেকটি তনয় আনতে চায় জয়া! যে তনয় তার সবসময়ের সঙ্গি হয়ে থাকবে৷ পালপোষ করে নিজের মনের মত করে বড় করবে৷ এমনই নানা ভাবনার ঘোরের মধ্যে রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল তনয়৷ আকুতিভরা অস্ফুট কন্ঠে জয়ার উদ্দেশে বলল, আই অ্যাম ভেরি স্যরি জয়া, প্রমিস করছি, তুমি যা চাইছ…, শোন না!
সাড়া পেল না তনয়৷ সসপ্যানে ধূমায়িত গরম চা উথলে উঠছে৷ সেদিকে ভ্রুক্ষেপহীন জয়া৷ মন তার বিক্ষিপ্ত৷ পায়ে পায়ে জয়ার পিছনে এসে দাঁড়াল তনয়৷ আরও কাছে৷ সারা শরীর দিয়ে জয়াকে পেছন থেকে জডি়য়ে ধরে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, চাটা নামাও, পুডে় যাবে যে! আমিও একটু খাব৷ যা শীত পডে়ছে! এবার বল, আমরা যাচ্ছি তো সুন্দরবন? বলেই আরও কঠিন করে জয়াকে নিজের শরীরের সঙ্গে আটকে নেয় তনয়৷ জয়া কপট রাগ করে বলে, ছাড়লে তুমি! যাচ্ছেতাই একটা, চাটা বাড়তে দেবে তো নাকি! তনয়ই বা এখন এত সহজে ছাড়বে কেন, জয়াকে দিয়ে প্রমিস করিয়ে নিতে বলল, আগে কথা দাও যাচ্ছ! আমি কিন্ত্ত কথা দিয়েছি!
এই মুহূর্তগুলো ভাল লাগছে জয়ার, ভীষণ ভাল৷ আদুরে গলায় জয়া বলল, হুম্! সোহাগাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠে সে৷ তার হরিণী চোখের আবেদনে হেরে যেতে থাকে তনয়৷ ট্রেতে দু’জনের চা নিয়ে জয়া আগে আগে ড্রইংরুম পেরিয়ে ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে৷ পিছু পিছু তনয়৷ বাধ্য বাঘ এক!