কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে ১৯৬৪ সালে সিপিএম তৈরি হয়েছিল সেই থেকে এতদিন বাংলা সিপিএমের সম্পাদক পদে কোনও সংখ্যালঘু নেতার স্থান হয়নি। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বাংলা সিপিএমে নতুন ইতিহাস তৈরি হল। সিপিএমের ২৬ তম রাজ্য সম্মেলনে মহম্মদ সেলিম রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। এই পদের জন্য দৌঁড়ে এগিয়েছিলেন শ্রীদীপ ভট্টাচার্য।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তথা পলিটব্যুরোর হস্তক্ষেপেই সিপিএম রাজ্য সম্পাদক করল সেলিমকে। শ্রীদীপ এবং সেলিমকে রাজ্য সম্পাদক করার জন্য সিপিএমের অন্দর দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল।
পলিটব্যুরোর তরফে রাজ্য সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে বক্তৃতা দেন প্রকাশ কারাত। এই সময় তিনি তাঁর বক্তব্যে বুঝিয়ে দেন, গণ আন্দোলনে ভূমিকা নেই, এমন কোনও নেতা নেতৃত্বের সামনের সারিতে আসতে পারেন না। তখনই দেওয়াল লিখনটা স্পষ্ট হয়ে যায়। মহম্মদ সেলিমের পাল্লা ভারী হয় রাজ্য সম্পাদক পদে।
কাকাবাবুর পর ১৯৫৩ থেকে ১৯৬১-র প্রথম দিক পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য সম্পাদক ছিলেন জ্যোতি বসু। তারপর সেই দায়িত্ব পান প্রমোদ দাশগুপ্ত। পার্টি ভাগ হওয়ার পর থেকে আমৃত্যু রাজ্য সম্পাদক ছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। এরপর সরোজ মুখোপাধ্যায়, শৈলেন দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাস বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র রাজ্য সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান।
এবার সেই পদে বসলেন মহম্মদ সেলিম। এবার রাজা কমিটি থেকে সরে গেলেন বিমান বসু সূর্যকান্ত মিশ্র, রবীন দেব, গৌতম দেব, নেপাল দেব মৃদুল দের মতো প্রবীণ নেতারা। নতুন ৮০ জনের রাজ্য কমিটিতে জায়গা পেলেন সুশান্ত ঘোষ।
তরুণ মুখের মধ্যে রয়েছেন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, শতরূপ ঘোষ, ময়ূখ বিশ্বাস। রয়েছেন আত্রেয়ী গুহ, পার্থ মুখোপাধ্যায়, সুদীপ্ত সেনগুপ্ত, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় শেখ ইব্রাহিম, গীতা হাঁসদা।
উল্লেখ্য, সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম দু’দফায় রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। রায়গঞ্জ ও কলকাতা উত্তর পূর্ব লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ হয়েছিলেন। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্ত্রিসভায় যুবকল্যাণ ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী হয়েছিলেন। সুবক্তা হিসেবে সেলিম যথেষ্টই জনপ্রিয়।
এবার বাংলায় সিপিএমকে নেতৃত্ব দেবেন মহম্মদ সেলিম। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মুখ মহম্মদ সেলিম বাংলার পাশাপাশি হিন্দি-ইংরাজিতে সরগ্র তিন ভাষাতেই ভাল বক্তৃতা করতে পারেন। যথেষ্ট পরিচিত মুখ এবং সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক তুলনামূলক সহজ।
এই সমস্ত বিষয়ই তাঁকে নেতৃত্বের দিক থেকে এগিয়ে রেখেছিল বলেই সিপিএমের অন্দরের খবর। সিপিএমের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে কেরল, ত্রিপুরা বা পশ্চিমবঙ্গে যাঁরা রাজ্য সম্পাদক হন তাঁরা পলিটব্যুরোর সদস্য হন। মহম্মদ সেলিমও পলিটব্যুরোর সদস্য।
ফলে বাকি যাঁদের নাম নিয়ে জল্পনা শোনা যাচ্ছিল, সকলকেই এ জায়গায় কিছুটা পিছনে ফেলে দিয়েছেন সেলিম। তারুণ্যকে যে এবার রাজ্য কমিটিতে প্রাধান্য দেওয়া হবে অনেকদিন ধরেই এ কথা শোনা যাচ্ছিল।
এবার বয়সের সীমা বেঁধে সিপিএম বিষয়টি তুলে ধরেছে। এই ‘সংরক্ষণেই বাদ পড়েছেন বাংলায় বামপন্থী রাজনীতির অন্যতম পরিচিত দুই মুখ বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র।
বাদ পড়ছেন রবীন দেব। মৃদুল দে, নেপালদেব ভট্টাচার্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত নেতারাও এবার থাকছেন না রাজ্য কমিটিতে। কমিটিতে এসেছেন শতরূপ ঘোষ, মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, সৃজন ভট্টাচার্য, ময়ূখ বিশ্বাসরা।
নিঃসন্দেহে এবার রাজ্য কমিটিতে সুশান্ত ঘোষের উঠে আসা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বেনাচাপড়া কঙ্কালকাণ্ডের পর হাজতবাস, দীর্ঘদিন প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে থাকা, এরপর ফের ফিরে এসে ভোটে দাঁড়ানো, পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক হওয়া সুশান্ত ঘোষ এবার সিপিএমের রাজ্য কমিটিতে।
নতুন প্রজন্মের উপর ভরসা করে আগামীতে পথ চলতে চায় সিপিএম। সে কারণে সিপিএম পলিটব্যুরো অনেক আলোচনার পর সদস্যদের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছে।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্ত ছিল, ৭২ বছরের বেশি বয়সী কাউকে রাজ্য কমিটিতে রাখা যাবে না সেই সঙ্গে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে কোনও নেতা পারবেন না রাজ্য কমিটির সদস্য হতে। নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের দলের মধ্যে তুলে আনতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই বার্তাই ছড়িয়ে গিয়েছিল রাজ্যজুড়ে। এবার সিপিএমের নতুন রাজ্য কমিটিতে এল একবাক নতুন মুখ।
যাদবপুর এলাকায় শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা সময় সুদীপ্ত সেনগুপ্তকে জোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। সেই সুদীপ্ত এবার রাজ্য কমিটিতে। এসএফআইয়ের রাজ্য সভাপতি প্রতিকুর রহমান এবার রাজ্য কমিটিতে জায়গা পেলেন।