প্রদীপ মারিক
কেবলমাত্র কথায় নয়, বাস্তবে ডাকঘর সারা দিন সারাটা বেলা সারা রাত খোলা থাকে৷ সকাল থেকে চলে চিঠি, পার্সেল, মানি অর্ডার বুকিংয়ের কাজ, আর সারা রাত জেগে চলে সেই চিঠি দেশে বিদেশে পেঁৗছে দেওয়ার কাজ৷ কোন চিঠি প্লেনে যাবে, কোনটা ট্রেনে, তা নিয়ে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রত্যেকটি আলাদা ব্যাগে ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা ও গোবিন্দপুরকে নিয়ে কলকাতা শহরটি গড়ে ওঠে৷ এর মধ্যে ডিহি কলিকাতা নামটি থেকে কলকাতা বা কোলকাতা নামটির উৎপত্তি৷ ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসক জব চার্নককে এই শহরের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা দিয়েছিলেন৷ ১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা সদর কার্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জব চার্নক নামে এক ইংরেজ বণিক সুতানুটিতে উপস্থিত হন৷ কলিকাতা গ্রামে স্থানীয় লোকদের বসতি না থাকায়, এই গ্রামটি ইংরেজরা সহজেই দখল নিতে পারে৷ ১৬৯৬ সালে কোনওরূপ আইনি অধিকার ব্যতিরেকেই বর্তমান জিপিও অঞ্চলে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু হয়৷ মোবাইল ফোন তো দূরের কথা, এই সময়ে টেলিফোনও ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে৷
প্রিয়জনের খবর পাওয়ার জন্য মানুষকে নির্ভর করতে হয় সেই চিঠি তথা ডাকঘরের উপরেই৷ ডাকঘরে আসা ইনল্যান্ড লেটার, পোস্টকার্ড সাধারণ মানুষের হাতে পেঁৗছে দিতেন রানাররা৷ কেমন ছিল তখনকার রানারদের পোশাক? কেমন ছিল তাঁদের সঙ্গে থাকা লণ্ঠন? রানারদের সঙ্গে থাকা এইসব সামগ্রী, তখনকার দিনের ডাক পিওনদের বেল্ট, ব্যাজ এখনও সংরক্ষিত আছে কলকাতা জিপিওতে৷ ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় কলকাতায় জিপিও বা জেনারেল পোস্ট অফিস তৈরি হয় ১৭৭৪ সালের ১৭ মার্চ৷ প্রথম পোস্টমাস্টার ছিলেন মিস্টার রেডফার্ন৷ ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের কাছে কোথাও ছিল সেই ডাকঘর৷ পরে তা উঠে আসে চার্চ লেন ও হেস্টিং স্ট্রিটের মাঝামাঝি৷ এই সময় পালকিতে ডাকের পুঁটুলি বহন করা হত৷ এ ব্যবস্থা বর্ষাকাল বাদে অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই চার মাস বাদে সারা বছর চালু থাকত৷ বর্তমান জিপিওর নকশা করেছিলেন মিস্টার ওয়াল্টার বি গ্রেনভিল৷ নির্মাণে সহযোগিতা করেছিলেন ম্যাকিনটস বার্ন৷ খরচ হয়েছিল প্রায় ৬ লক্ষ টাকা৷ বাড়িটি দোতলা, থামে করিন্থিয়ান নকশা৷ মাথায় বিশাল গম্বুজ৷ দক্ষিণদিক অর্ধচক্রাকার৷ ভেতরে পাক খাওয়া সিঁড়ি৷ শোনা যায় লর্ড ক্লাইভ সিরাজদৌল্লার কাছে পরাজিত হয়ে এর গায়ে লিখে দিয়েছিলেন পুরনো কেল্লার সীমানা৷ ওয়ারেন হেস্টিংসের পর ডাক যোগাযোগের দায়িত্ব এসে পড়ে সেই অঞ্চলের জমিদারদের ওপর৷ এছাড়া ব্যবসায়ীরাও নিজেদের প্রয়োজনে নিজস্ব ডাক ব্যবস্থা চালু করল৷ একে বলা হত মহাজনী ডাক৷ রাজরাজাদের বাড়ির ভেতরেই অনেকসময় এই ব্যবস্থা চালু করা হয়৷
এরপর লর্ড ওয়েলেসলি ডাক বিভাগের আরও নানা সংস্কার সাধন করেন৷ ১৭৯৮-৯৯ সালে কলকাতা জিপিওর ন’টি শাখা অফিস গড়ে ওঠে ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, নাটোর, কুমারখালি, রঘুনাথপুর, সিলেট ও রামুতে৷ ১৮৫৪ সালে সমন্বিত আধুনিক ডাকব্যবস্থার অধীনে দূরত্বভিত্তিক চিঠি পাঠানোর মাশুলের পরিবর্তে ওজনভিত্তিক মাশুল আদায়ের ব্যবস্থা চালু করা হয়৷ এ সময়ে প্রথম সর্বভারতীয় ডাকটিকিট প্রবর্তন করা হয়৷ দ্রুত ডাক পরিবহণের মাধ্যম হিসাবে রেল পরিবহণ ব্যবস্থার সহায়তা গ্রহণ করা হয় এবং রেলওয়ে মেইল সার্ভিস (আরএমএস) চালু হয়৷ এ সময় প্রথম আধ আনা মূল্যের লালচে কমলা এবং এক আনা মূল্যের উজ্জ্বল নীল রঙের ডাকটিকিট চালু হয়৷ ১৮৫৬-৫৭ সালে প্রথম চিঠি ফেলার বাক্স ও লেটার বক্স চালু হয় এবং এই বাক্সের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের শাসনভার রানি ভিক্টোরিয়ার হাতে সমর্পণ করার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়৷ ১৮৬১ সাল থেকে ৮৮৯টা ডাকঘর তৈরি হয়৷
ডিজিটাল যুগেও হারিয়ে যায়নি চিঠি লেখার অভ্যাস৷ তবে সে যুগের মতো সে অনুভূতি আর নেই৷ শরতের আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখা দিলেই ডাকপিয়নের অপেক্ষায় দরজার দিকে চেয়ে থাকা৷ সেই চিঠি, যে বয়ে আনবে কলকাতা প্রবাসে থাকা মানুষটির ঘরে ফেরার সংবাদ, শারদোৎসবে বাড়ি ফেরার বার্তা, সঙ্গে থাকবে উপহার৷ খোকার জন্য নতুন কাপড়, খুকির ফ্রক, আর ভালোবাসার মানুষটির জন্য নতুন লাল পেড়ে তাঁতের শাড়ি, স্নো, পাউডার, আলতা আরও কতকিছুর কথা৷ দীর্ঘ চার বছর ধরে জিপিওর বাড়িটা নির্মাণ হয়৷ নকশা করেছিলেন সেই সময়ে ব্রিটিশ ভারতের কনসাল্টিং আর্কিটেক্ট ওয়াল্টার বি গ্রেনভিল৷ ইতিহাস বলছে, এই ভবনটি তৈরি করতে সেই সময়ে খরচ হয়েছিল সাড়ে ৬ লাখ টাকা৷ ভেতরে ঢুকলেই ব্রিটিশ আমলের ছোঁয়া৷ আসবাবপত্রে পুরাতনী স্পর্শ৷ কাঠের টেবিল, চেয়ার, দেওয়াল জোড়া রানারের সেই লণ্ঠন আর বর্শা৷ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ওপর প্রকাশিত স্ট্যাম্প, পুরনো মান্ধাতা আমলের লাল ওজন মেশিন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং সিলিং থেকে নেমে আসা সেই লম্বা রডওয়ালা পাখা৷ দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে যায়৷ সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে গোধূলি অবধি কলকাতা জিপিওৃর অফিসপাড়া জেগে থাকে৷ তারপর রোদের তেজ একটু ঝিমোতেই এখানে ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা৷ এই বড় পোস্ট অফিস এবং তার সামনের সিঁড়ি, ফুটপাথ জুড়ে জেগে ওঠা এই সংগ্রহ সামগ্রীর বাজারটি কিন্ত্ত চমৎকার৷ জিপিওকে কেন্দ্র করে কয়েকশো পরিবারের পেটের ভাত সংস্থান হয়ে যায়৷
ঠিক কবে থেকে এটি শুরু হয় তা নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যেও জনশ্রুতি আছে, আশির দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে জমে ওঠে এই বাজার৷ জিপিওর ব্যস্ততা চিরদিনই৷ পার্সেল, চিঠি, ইনল্যান্ড লেটার, পোস্টকার্ড, মানি অর্ডার— আরও কত কী নিত্য বুকিং করতে বহু মানুষের আনাগোনা হয়৷ কিছু মানুষ আসতেন নতুন ডাক টিকিট সংগ্রহের জন্য৷ কোনও বিশেষ দিবস উপলক্ষে ডাক বিভাগ থেকে প্রকাশ পায় বিশেষ দিবস কভার বা ‘ফার্স্ট ডে কভার’, যেমন প্রকাশ পায় ডাকটিকিট৷ ফার্স্ট ডে কভার যেদিন প্রকাশ পাচ্ছে, শুধুমাত্র সেই দিনের জন্যই ব্যবহূত হয় একটি বিশেষ প্রথম দিবস ছাপ বা ক্যানসেলেশন৷ এগুলি সংগ্রাহকদের কাছে ভীষণ মূল্যবান৷ ডাক ব্যবস্থা এখন আধুনিক৷ সমস্ত ব্যাঙ্কিং পরিষেবা দেওয়া হয় ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে৷
পোস্ট অফিসে এসে একসঙ্গে আরও অনেক কাজ সেরে ফেলা যায়৷ ডাকঘরে চালু হয়েছে কমন সার্ভিস সেন্টার৷ এই সার্ভিস সেন্টারে গেলে একজন সাধারণ গ্রাহক অনেকগুলো পরিষেবা পায় এবং সময়েরও সাশ্রয় হয়৷ ডাক বিভাগের মাধ্যমে ইলেকট্রিক বিল, মোবাইল রিচার্জ, আধার কার্ডের সঙ্গে মোবাইল নম্বরের সংযুক্তিকরণ, ট্রেনের টিকিট বুকিং, ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্ন, পাশপোর্ট, নতুন আধার কার্ড তৈরি ও সংশোধন, জীবন প্রমাণপত্রের নথি জমা দেওয়ার মতো সকল সুযোগসুবিধা রয়েছে৷ পোস্ট অফিসের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখেই এই সুযোগসুবিধা দেওয়ার কথা জানিয়েছে ভারতের ডাক বিভাগ৷ একদিকে ঐতিহ্য, অন্যদিকে আধুনিকতার প্রকৃত নিশান বহন করে চলেছে কলকাতা জিপিও আড়াইশো বছর ধরে৷ যেখানে কেবলমাত্র সরকারি কর্মচারীরাই নয়, প্রায় শ’পাঁচেক পরিবার জিপিওর চারপাশে ব্যবসা করে তাদের পেটের ভাতের সংস্থান করে চলেছে৷