• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

সরকারি কর্মচারীরা ছাড়াও, কয়েকশো পরিবারের রোজগারের পথ দেখিয়ে আসছে কলকাতা জিপিও

প্রদীপ মারিক কেবলমাত্র কথায় নয়, বাস্তবে ডাকঘর সারা দিন সারাটা বেলা সারা রাত খোলা থাকে৷ সকাল থেকে চলে চিঠি, পার্সেল, মানি অর্ডার বুকিংয়ের কাজ, আর সারা রাত জেগে চলে সেই চিঠি দেশে বিদেশে পেঁৗছে দেওয়ার কাজ৷ কোন চিঠি প্লেনে যাবে, কোনটা ট্রেনে, তা নিয়ে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রত্যেকটি আলাদা ব্যাগে ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷

প্রদীপ মারিক
কেবলমাত্র কথায় নয়, বাস্তবে ডাকঘর সারা দিন সারাটা বেলা সারা রাত খোলা থাকে৷ সকাল থেকে চলে চিঠি, পার্সেল, মানি অর্ডার বুকিংয়ের কাজ, আর সারা রাত জেগে চলে সেই চিঠি দেশে বিদেশে পেঁৗছে দেওয়ার কাজ৷ কোন চিঠি প্লেনে যাবে, কোনটা ট্রেনে, তা নিয়ে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রত্যেকটি আলাদা ব্যাগে ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা ও গোবিন্দপুরকে নিয়ে কলকাতা শহরটি গড়ে ওঠে৷ এর মধ্যে ডিহি কলিকাতা নামটি থেকে কলকাতা বা কোলকাতা নামটির উৎপত্তি৷ ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসক জব চার্নককে এই শহরের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা দিয়েছিলেন৷ ১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা সদর কার্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জব চার্নক নামে এক ইংরেজ বণিক সুতানুটিতে উপস্থিত হন৷ কলিকাতা গ্রামে স্থানীয় লোকদের বসতি না থাকায়, এই গ্রামটি ইংরেজরা সহজেই দখল নিতে পারে৷ ১৬৯৬ সালে কোনওরূপ আইনি অধিকার ব্যতিরেকেই বর্তমান জিপিও অঞ্চলে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু হয়৷ মোবাইল ফোন তো দূরের কথা, এই সময়ে টেলিফোনও ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে৷

প্রিয়জনের খবর পাওয়ার জন্য মানুষকে নির্ভর করতে হয় সেই চিঠি তথা ডাকঘরের উপরেই৷ ডাকঘরে আসা ইনল্যান্ড লেটার, পোস্টকার্ড সাধারণ মানুষের হাতে পেঁৗছে দিতেন রানাররা৷ কেমন ছিল তখনকার রানারদের পোশাক? কেমন ছিল তাঁদের সঙ্গে থাকা লণ্ঠন? রানারদের সঙ্গে থাকা এইসব সামগ্রী, তখনকার দিনের ডাক পিওনদের বেল্ট, ব্যাজ এখনও সংরক্ষিত আছে কলকাতা জিপিওতে৷ ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় কলকাতায় জিপিও বা জেনারেল পোস্ট অফিস তৈরি হয় ১৭৭৪ সালের ১৭ মার্চ৷ প্রথম পোস্টমাস্টার ছিলেন মিস্টার রেডফার্ন৷ ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের কাছে কোথাও ছিল সেই ডাকঘর৷ পরে তা উঠে আসে চার্চ লেন ও হেস্টিং স্ট্রিটের মাঝামাঝি৷ এই সময় পালকিতে ডাকের পুঁটুলি বহন করা হত৷ এ ব্যবস্থা বর্ষাকাল বাদে অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই চার মাস বাদে সারা বছর চালু থাকত৷ বর্তমান জিপিওর নকশা করেছিলেন মিস্টার ওয়াল্টার বি গ্রেনভিল৷ নির্মাণে সহযোগিতা করেছিলেন ম্যাকিনটস বার্ন৷ খরচ হয়েছিল প্রায় ৬ লক্ষ টাকা৷ বাড়িটি দোতলা, থামে করিন্থিয়ান নকশা৷ মাথায় বিশাল গম্বুজ৷ দক্ষিণদিক অর্ধচক্রাকার৷ ভেতরে পাক খাওয়া সিঁড়ি৷ শোনা যায় লর্ড ক্লাইভ সিরাজদৌল্লার কাছে পরাজিত হয়ে এর গায়ে লিখে দিয়েছিলেন পুরনো কেল্লার সীমানা৷ ওয়ারেন হেস্টিংসের পর ডাক যোগাযোগের দায়িত্ব এসে পড়ে সেই অঞ্চলের জমিদারদের ওপর৷ এছাড়া ব্যবসায়ীরাও নিজেদের প্রয়োজনে নিজস্ব ডাক ব্যবস্থা চালু করল৷ একে বলা হত মহাজনী ডাক৷ রাজরাজাদের বাড়ির ভেতরেই অনেকসময় এই ব্যবস্থা চালু করা হয়৷

এরপর লর্ড ওয়েলেসলি ডাক বিভাগের আরও নানা সংস্কার সাধন করেন৷ ১৭৯৮-৯৯ সালে কলকাতা জিপিওর ন’টি শাখা অফিস গড়ে ওঠে ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, নাটোর, কুমারখালি, রঘুনাথপুর, সিলেট ও রামুতে৷ ১৮৫৪ সালে সমন্বিত আধুনিক ডাকব্যবস্থার অধীনে দূরত্বভিত্তিক চিঠি পাঠানোর মাশুলের পরিবর্তে ওজনভিত্তিক মাশুল আদায়ের ব্যবস্থা চালু করা হয়৷ এ সময়ে প্রথম সর্বভারতীয় ডাকটিকিট প্রবর্তন করা হয়৷ দ্রুত ডাক পরিবহণের মাধ্যম হিসাবে রেল পরিবহণ ব্যবস্থার সহায়তা গ্রহণ করা হয় এবং রেলওয়ে মেইল সার্ভিস (আরএমএস) চালু হয়৷ এ সময় প্রথম আধ আনা মূল্যের লালচে কমলা এবং এক আনা মূল্যের উজ্জ্বল নীল রঙের ডাকটিকিট চালু হয়৷ ১৮৫৬-৫৭ সালে প্রথম চিঠি ফেলার বাক্স ও লেটার বক্স চালু হয় এবং এই বাক্সের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের শাসনভার রানি ভিক্টোরিয়ার হাতে সমর্পণ করার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়৷ ১৮৬১ সাল থেকে ৮৮৯টা ডাকঘর তৈরি হয়৷

ডিজিটাল যুগেও হারিয়ে যায়নি চিঠি লেখার অভ্যাস৷ তবে সে যুগের মতো সে অনুভূতি আর নেই৷ শরতের আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখা দিলেই ডাকপিয়নের অপেক্ষায় দরজার দিকে চেয়ে থাকা৷ সেই চিঠি, যে বয়ে আনবে কলকাতা প্রবাসে থাকা মানুষটির ঘরে ফেরার সংবাদ, শারদোৎসবে বাড়ি ফেরার বার্তা, সঙ্গে থাকবে উপহার৷ খোকার জন্য নতুন কাপড়, খুকির ফ্রক, আর ভালোবাসার মানুষটির জন্য নতুন লাল পেড়ে তাঁতের শাড়ি, স্নো, পাউডার, আলতা আরও কতকিছুর কথা৷ দীর্ঘ চার বছর ধরে জিপিওর বাড়িটা নির্মাণ হয়৷ নকশা করেছিলেন সেই সময়ে ব্রিটিশ ভারতের কনসাল্টিং আর্কিটেক্ট ওয়াল্টার বি গ্রেনভিল৷ ইতিহাস বলছে, এই ভবনটি তৈরি করতে সেই সময়ে খরচ হয়েছিল সাড়ে ৬ লাখ টাকা৷ ভেতরে ঢুকলেই ব্রিটিশ আমলের ছোঁয়া৷ আসবাবপত্রে পুরাতনী স্পর্শ৷ কাঠের টেবিল, চেয়ার, দেওয়াল জোড়া রানারের সেই লণ্ঠন আর বর্শা৷ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ওপর প্রকাশিত স্ট্যাম্প, পুরনো মান্ধাতা আমলের লাল ওজন মেশিন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং সিলিং থেকে নেমে আসা সেই লম্বা রডওয়ালা পাখা৷ দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে যায়৷ সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে গোধূলি অবধি কলকাতা জিপিওৃর অফিসপাড়া জেগে থাকে৷ তারপর রোদের তেজ একটু ঝিমোতেই এখানে ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা৷ এই বড় পোস্ট অফিস এবং তার সামনের সিঁড়ি, ফুটপাথ জুড়ে জেগে ওঠা এই সংগ্রহ সামগ্রীর বাজারটি কিন্ত্ত চমৎকার৷ জিপিওকে কেন্দ্র করে কয়েকশো পরিবারের পেটের ভাত সংস্থান হয়ে যায়৷

ঠিক কবে থেকে এটি শুরু হয় তা নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যেও জনশ্রুতি আছে, আশির দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে জমে ওঠে এই বাজার৷ জিপিওর ব্যস্ততা চিরদিনই৷ পার্সেল, চিঠি, ইনল্যান্ড লেটার, পোস্টকার্ড, মানি অর্ডার— আরও কত কী নিত্য বুকিং করতে বহু মানুষের আনাগোনা হয়৷ কিছু মানুষ আসতেন নতুন ডাক টিকিট সংগ্রহের জন্য৷ কোনও বিশেষ দিবস উপলক্ষে ডাক বিভাগ থেকে প্রকাশ পায় বিশেষ দিবস কভার বা ‘ফার্স্ট ডে কভার’, যেমন প্রকাশ পায় ডাকটিকিট৷ ফার্স্ট ডে কভার যেদিন প্রকাশ পাচ্ছে, শুধুমাত্র সেই দিনের জন্যই ব্যবহূত হয় একটি বিশেষ প্রথম দিবস ছাপ বা ক্যানসেলেশন৷ এগুলি সংগ্রাহকদের কাছে ভীষণ মূল্যবান৷ ডাক ব্যবস্থা এখন আধুনিক৷ সমস্ত ব্যাঙ্কিং পরিষেবা দেওয়া হয় ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে৷

পোস্ট অফিসে এসে একসঙ্গে আরও অনেক কাজ সেরে ফেলা যায়৷ ডাকঘরে চালু হয়েছে কমন সার্ভিস সেন্টার৷ এই সার্ভিস সেন্টারে গেলে একজন সাধারণ গ্রাহক অনেকগুলো পরিষেবা পায় এবং সময়েরও সাশ্রয় হয়৷ ডাক বিভাগের মাধ্যমে ইলেকট্রিক বিল, মোবাইল রিচার্জ, আধার কার্ডের সঙ্গে মোবাইল নম্বরের সংযুক্তিকরণ, ট্রেনের টিকিট বুকিং, ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্ন, পাশপোর্ট, নতুন আধার কার্ড তৈরি ও সংশোধন, জীবন প্রমাণপত্রের নথি জমা দেওয়ার মতো সকল সুযোগসুবিধা রয়েছে৷ পোস্ট অফিসের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখেই এই সুযোগসুবিধা দেওয়ার কথা জানিয়েছে ভারতের ডাক বিভাগ৷ একদিকে ঐতিহ্য, অন্যদিকে আধুনিকতার প্রকৃত নিশান বহন করে চলেছে কলকাতা জিপিও আড়াইশো বছর ধরে৷ যেখানে কেবলমাত্র সরকারি কর্মচারীরাই নয়, প্রায় শ’পাঁচেক পরিবার জিপিওর চারপাশে ব্যবসা করে তাদের পেটের ভাতের সংস্থান করে চলেছে৷