মেঘলা আকাশ, ঝিরঝিরে বৃষ্টি। মঙ্গলবার সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার হলেও বোলপুরে খুশির জোয়ার। কারণ দীর্ঘ দু’বছর পর মেয়েকে নিয়ে ঘরে ফিরলেন অনুব্রত মণ্ডল। কেষ্টর ঘরে ফেরার খবর পেতেই আনন্দে মেতে উঠেছিল গোটা বোলপুর। মঙ্গলবার সেই আনন্দ যেন বেড়ে গিয়েছিল আরও কয়েক গুণে। তাই সকাল থেকেই এক অন্য ছবি দেখা গেল বোলপুর কালিকাপুরের নীচুপট্টির নেতাজি রোডে।
২০২২ সালের ১১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার। বোলপুরের কালিকাপুরের বাড়ি থেকে অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। পরে অনুব্রতর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে মামলায় যুক্ত হয় ইডিও। শেষে অনুব্রতর ঠাঁই হয় তিহাড় জেলে। কেষ্টর অনুপস্থিতিতে যেন ঝিমিয়ে পড়েছিল গোটা বোলপুর। পরে অনুব্রত মণ্ডলের একমাত্র কন্যা সুকন্যা মণ্ডলকেও গ্রেপ্তার করে তিহাড় জেলে রাখে সিবিআই। ১০ সেপ্টেম্বর সুকন্যার তিহাড়-মুক্তি হলেও বোলপুরে না ফিরে দিল্লিতেই থেকে যান তিনি। এর ১০ দিন পর অর্থাৎ ২০ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান অনুব্রত মণ্ডলও। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর এবার বাবা-মেয়ে একসঙ্গেই পা রাখলেন নিজের বাড়িতে।
২৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার রাত ৯টা ১০ মিনিটে তিহাড় জেলের বাইরে পা রাখেন অনুব্রত মণ্ডল। সঙ্গী তাঁর মেয়ে সুকন্যা মণ্ডল। তিনি বাবার পায়ে জুতো পরিয়ে দিয়ে তাঁকে সঙ্গে নিয়েই গাড়িতে করে সোজা পৌঁছে যান দিল্লির বিমানবন্দরে। সেখান থেকে কলকাতা বিমানবন্দর এবং কলকাতা থেকে সরাসরি বোলপুরে পা রাখেন তাঁরা। বর্ধমান থেকে বোলপুর যাওয়ার পথে বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে অনুব্রত মণ্ডল এবং সুকন্যাকে স্বাগত জানান বহু মানুষ।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই অধীর অপেক্ষায় ছিল বোলপুরবাসী। ঘড়ির কাঁটায় যখন ঠিক সকাল ৯টা বেজে ১৫, তখনই মেয়ে সুকন্যাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে পা রাখেন কেষ্ট। চারিদিকে তখন শঙ্খধ্বনি, বাজনা, উলুধ্বনি আর সবুজ আবির। বাড়ির বাইরে অনুব্রতর প্রিয় নকুলদানা বিলি করেন দলীয় কর্মীরা। তাঁকে স্বাগত জানাতে বোলপুরে এই বিশাল আয়োজন দেখে চোখে জল ধরে রাখতে পারেননি অনুব্রত মণ্ডল।
মঙ্গলবার পার্টি অফিসে বসে কথাবার্তা চলার মাঝে হঠাৎই আবেগঘন হয়ে পড়েন সুকন্যা মণ্ডলও। কিছু একটা কথা বলার সময় কেঁদে ফেলেন সুকন্যা। খুব স্পষ্ট কিছু শোনা যায়নি। কিন্তু মেয়ে ভেঙে পড়েছে দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা অনুব্রত মণ্ডল। কান্না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও পারেননি তিনি। দু’হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরেন কেষ্ট।
এর আগে বাবা অনুব্রত মণ্ডলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে খুব একটা দেখা যায়নি সুকন্যাকে। শুধুমাত্র ভোটের সময় বাবার সঙ্গে বুথে যেতেন সুকন্যা। তবে মঙ্গলবার দেখা গেল অন্য ছবি। জেল থেকে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সর্বদাই মেয়ের শাসন-শৃঙ্খলে বাঁধা থেকেছেন অনুব্রত।
১১০ কেজি ওজন নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। ফিরলেন ৮৮ কেজি ওজন নিয়ে। নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে কেষ্ট জানান, পায়ে ও শরীরে ব্যথা রয়েছে। এর পাশাপাশি সকলকে শারদীয়ার শুভেচ্ছাও জানান তিনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে কেষ্ট বলেন, ‘তিনি আমার নেত্রী। বাংলা এবং ভারতের নেত্রী। তিনি যখন যেখানে ডাকবেন, সেখানে আগের মতোই হাজির হব। আমি আদালতকে সম্মান করি, আইন মেনে চলি। দিদির জন্য আছি, বরাবরই থাকব।’
বাড়ি ফেরার পর অনুব্রতর নিরাপত্তাতেও জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সুকন্যা মণ্ডলও সরকারি নিরাপত্তারক্ষী পাবেন বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এই আবহে মঙ্গলবার সিউড়ির বিধায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী ও রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাঁদের বাধা দেয় নিরাপত্তারক্ষীরা। এ বিষয়ে বিকাশ রায়চৌধুরী বলেন, ‘বহু মানুষের ভিড় ছিল। অনুব্রত আমাদের দেখে হাত নাড়ার পরে আর ভিতরে ঢোকা হয়নি। পরে আমরা কথা বলব।’ অন্যদিকে মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহার মন্তব্য, ‘অনুব্রত আমাদের নেতা। ভিড়ের জন্য কথা হয়নি। পরে কথা হবে।’ চন্দ্রনাথ সিনহা এবং বিকাশ রায়চৌধুরীর পাশাপাশি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি বোলপুরের সাংসদ অসিত মালকেও। তবে অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান বোলপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান পর্ণা ঘোষ।
কেষ্টর ঘরে ফেরা নিয়ে একদিকে ঘাসফুল শিবিরের অন্দরে আনন্দের আবহ। অন্যদিকে কটাক্ষের সুর বিরোধীদের গলায়। অনুব্রতর ঘরে ফেরা প্রসঙ্গে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘অনুব্রত পুরোপুরি মুক্ত হননি, জামিন পেয়েছেন। ভারতের বিচারব্যবস্থা সময়সাপেক্ষ, তাই অপেক্ষা করতে হবে।’ সিপিআইএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় উনি এ রাজ্যের থ্রেট কালচারের একজন প্রতিনিধি। সবসময় তাতে প্রশ্রয় ছিল মমতার।’
দু’বছর পরে অনুব্রত ঘরে ফিরলেন ঠিকই। কিন্তু তাঁকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে কুলুপ। প্রথম থেকেই জল্পনা চলছিল, মঙ্গলবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক বৈঠকে হাজির থাকতে পারেন অনুব্রত। তা তো হলই না, উল্টে অনুব্রতর ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়াই দিলেন না মমতা। এক কালে কেষ্টকে ‘বাঘ’ বলে বর্ণনা করেছিলের রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। কিন্তু সেই ‘বাঘ’-এর ঘরে ফেরা নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়াই দিলেন না মুখ্য়মন্ত্রী? প্রশাসনিক বৈঠকের মঞ্চ তো দূর, ব্যক্তিগতভাবেও অনুব্রতকে নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেননি মমতা। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিকমহলে প্রশ্ন উঠছে, কেষ্টর ঘরওয়াপসি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তৃণমূলের অন্দরে ফের কি আগের ফর্মে দেখা যাবে অনুব্রত মণ্ডলকে?