গঙ্গাসাগর মেলাকে গ্রিন ও ক্লিন রাখতে তৎপর প্রশাসন, থাকবে ১০ হাজার শৌচাগার

নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস দাস

ফুরসত নেওয়ার সময় নেই। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে গঙ্গাসাগর মেলার প্রস্তুতি। দিন রাত পরিশ্রম করছেন বিভিন্ন দপ্তরের আধিকারিকরা। আবহাওয়া প্রতিকূল। তা সত্ত্বেও থমকে থাকার অবকাশ নেই। গঙ্গাসাগর মেলাকে ঘিরে পুণ্যার্থীদের ভিড় উপচে পড়বে। সেই কথা মাথায় রেখে জোরকদমে কাজ চলছে। এবারেও পুণ্যার্থী সমাগমে নিজের রেকর্ড ভাঙতে চাইছে গঙ্গাসাগর মেলা। এই মেলা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্য রাজ্য মন্ত্রীসভার বাছাই করা সদস্যরা ঘাঁটি গাড়বেন গঙ্গাসাগর সংলগ্ন এলাকায়। এই মেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে রাজ্য সরকারের একাধিক দপ্তর একসঙ্গে কাজ করবে। এর মধ্যে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি, পূর্ত, পরিবহন, সেচ, জলসম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, পরিবেশ, দমকল বিভাগ ছাড়াও রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশ প্রশাসন। সেই কারণে এই মেলা প্রাঙ্গণে রাজ্য সরকারের মন্ত্রী ও সচিবরা পর্যায়ক্রমে আসছেন প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে। ইতিমধ্যে পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী, সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া গঙ্গাসাগরে গিয়ে প্রস্তুতি খতিয়ে দেখেছেন।

শনিবার পূর্ত ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের শীর্ষ আধিকারিকদের নিয়ে গঙ্গাসাগর মেলা অফিসে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন মন্ত্রী পুলক রায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী বঙ্কিম হাজরা। এছাড়া জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের প্রধান সচিব সুরেন্দ্র গুপ্তা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক থেকে মন্ত্রী পুলক রায় দুই দপ্তরের আধিকারিকদের নির্দেশ দেন, এই মেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে কোনও ধরনের ফাঁকফোকর রাখা যাবে না। কোথাও কোনও সমন্বয়ের অভাব হলে দ্রুত আধিকারিকদের জানাতে হবে। সেখানে সমস্যার সমাধান না হলে তাঁকে পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করতে হবে। প্রয়োজনে দুই দপ্তরের আধিকারিকদের মধ্যে মত বিনিময় করার জন্য হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।


উল্লেখ্য, এই মেলা সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য ইতিমধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। সেই গ্রুপে এই জেলার আধিকারিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী যারা এই মেলা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গঙ্গাসাগরে যাবেন তাঁদেরকেও যুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, পুলক রায়, মানস ভুঁইয়া, স্নেহাশিস চক্রবর্তীরা বিশেষ দায়িত্বে থাকছেন। নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গতবারের তুলনায় নিরাপত্তা অনেক বেশি জোরদার করা হচ্ছে। কুম্ভ মেলা এ বছর হলেও গঙ্গাসাগরে পুণ্যার্থী সমাগমে খুব একটা ভাটা পড়বে না বলে মনে করছে জেলা প্রশাসন। সব মিলিয়ে গঙ্গাসাগর মেলাকে ঘিরে এখন সাজসাজ রব। সারা বছর ধরে এই এলাকার মানুষ তাকিয়ে থাকেন এই মেলার দিকে। পুণ্যার্থীদের সমাগমে পর্যটন শিল্প চাঙ্গা হয়, জোরদার হয় বিকিকিনি।

এদিকে গ্রিন ও ক্লিন। এই দুই মন্ত্রকে মাথায় রেখেই এবারের গঙ্গাসাগর মেলা করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মেলার জন্য ১০ হাজার শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি মেলা চত্বর ও আশপাশ এলাকায় বসবে একাধিক গাদা ফুল সহ অন্যান্য ফুল ফলের গাছ। এছাড়াও চলছে রাস্তাঘাটের মেরামতির কাজ। জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত চলবে গঙ্গাসাগর মেলা। এর প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। রাস্তা তৈরি থেকে জলের ব্যবস্থা, গঙ্গাসাগর মেলার প্রস্তুতি নিয়ে শনিবার বৈঠক করেছেন পূর্ত ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের মন্ত্রী পুলক রায়।

৬ জানুয়ারি গঙ্গাসাগর মেলার প্রস্তুতির কাজ খতিয়ে দেখতে যেতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগেই সমস্ত কাজ শেষ করার জন্য বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রীরা নির্দেশ দিয়েছেন। এই একই নির্দেশ এসেছে মন্ত্রী পুলক রায়ের কাছ থেকেও। কারণ গঙ্গাসাগর মেলায় সবচেয়ে বেশি বড়সড় ভূমিকা থাকে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের। সেই কারণে সময় থাকতে থাকতে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ফেলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী পুলক রায়। গঙ্গাসাগর মেলাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর আগ্রহ এবং ধারাবাহিক প্রয়াস রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। সেই কারণে এবারেও কোনও ধরনের খামতি রাখতে চান না মুখ্যমন্ত্রী।

কুম্ভ মেলার মতো গঙ্গাসাগর মেলাকেও জাতীয় মেলার স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন তিনি। পাশাপাশি তাঁর অভিযোগ, গঙ্গাসাগর মেলায় অর্থ সাহায্য দেয় না কেন্দ্র। সম্প্রতি গঙ্গাসাগর মেলাকে জাতীয় মেলার তকমা দেওয়ার দাবি জানিয়ে রাজ্যসভায় সরব হয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর। গতবারই সাগরমেলার উদ্বোধনে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘কুম্ভমেলার থেকেও বড় এই মেলা। অথচ কুম্ভের জন্য আর্থিক সাহায্য করলেও গঙ্গাসাগর মেলার জন্য এক পয়সাও দেয় না কেন্দ্র।’ বিষয়টি নিয়ে আসরে নেমেছিল তৃণমূলও। তাদের বক্তব্য ছিল, সারা দেশ থেকে আসা পুণ্যার্থীদের জন্য কেন্দ্র এই দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। এই আবহে রাজ্য একা হাতে গঙ্গাসাগর মেলার খরচ বহন করছে। মেলাকে গ্রিন ও ক্লিন রাখাই রাজ্যের একমাত্র লক্ষ্য। এর জন্য একাধিক মন্ত্রীকে ময়দানে নামানো হয়েছে। শনিবারের বৈঠকে পূর্ত দপ্তর ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের আধিকারিকদের দ্রুত কাজ শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

২০২৫ সালের গঙ্গাসাগর মেলার জন্য প্রায় ১০ হাজার শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কচুবেড়িয়া থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত রাস্তার কিছু অংশ মেরামত করা এখনও বাকি রয়েছে। এই কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী পুলক রায়। জলের পাউচ যাতে ভালোভালে সরবরাহ করা হয় এবং জলের অপচয় বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। গঙ্গাসাগর মেলাকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে থাকবে ডাস্টবিন। এই ডাস্টবিনগুলিতে লেখা থাকবে ‘ইউস মি’। জলের পাউচ যাতে এদিক ওদিক ছড়িয়ে না থাকে সেই কারণে এই ধরনের প্রচুর ডাস্টবিন রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ডাস্টবিনগুলি পরিষ্কার করার জন্য থাকবে নির্দিষ্ট লোক।

গঙ্গাসাগর মেলা চত্বরে ৩১ টি ওয়াচ টাওয়ার বসানো হচ্ছে। যার মধ্যে ২১ টি ওয়াচ টাওয়ারের কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলি কাজ ৪ জানুয়ারির মধ্যে শেষ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। ১৫৪০ টি জলের ট্যাঙ্ক প্রস্তুত করা হচ্ছে। যার মধ্যে মেলা প্রাঙ্গণে থাকছে ৩৫২ টি ট্যাঙ্ক। জলের পাইপলাইন বসানোর কাজ ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে ১৪টি সেসপুল। ১০ হাজারটি শৌচাগার তৈরির কাজ ৪ জানুয়ারির মধ্যে শেষ করা হবে। বাংলা, হিন্দি ও ইংরাজি ভাষায় মেলা সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য লিফলেটের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে। পুন্যার্থীরা যখন গঙ্গাসাগরে যান তখন স্বাভাবিকভাবে মেলা প্রাঙ্গণে পৌঁছতে আর কত কিলোমিটার বাকি তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে উৎকণ্ঠা থাকে। সেই উদ্বেগ দূর করতে পথনির্দেশিকার ব্যবস্থা থাকছে। সব মিলিয়ে অতীতের থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার একাধিক নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে গঙ্গাসাগরে আসা পুণ্যার্থীদের সমস্যা সমাধানে। রাজ্য সরকার চায় বহিরাগত পুণ্যার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আতিথিয়তা বিশেষভাবে তুলে ধরুক।
এরপর পাঁচের পৃষ্ঠায়