• facebook
  • twitter
Monday, 16 September, 2024

ইতিহাসের বারাকপুরে একদিন

সুখেন্দু হীরা ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জুন, পলাশীর প্রান্তরে অস্ত গেল ভারতের স্বাধীনতা সূর্য। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লা। জয়ী হলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভ বারাকপুরে ‘বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যানট্রি’ নামে একটা সেনাবাহিনী তৈরি করেন। যদিও সেই পদাতিক বাহিনীতে কোনও বাঙালি ছিলনা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

সুখেন্দু হীরা
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জুন, পলাশীর প্রান্তরে অস্ত গেল ভারতের স্বাধীনতা সূর্য। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লা। জয়ী হলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভ বারাকপুরে ‘বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যানট্রি’ নামে একটা সেনাবাহিনী তৈরি করেন। যদিও সেই পদাতিক বাহিনীতে কোনও বাঙালি ছিলনা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাটের কাছ থেকে দেওয়ানি লাভের পর বারাকপুরে ক্যান্টনমেন্ট অর্থাৎ সেনানিবাস তৈরি করে। ব্রিটিশ ভারতে এটাই ছিল প্রথম ক্যান্টমেন্ট। তখন থেকেই বারাকপুরের শ্রীবৃদ্ধি শুরু।
বারাকপুরের পূর্বতন নাম চানক। চানক- এর নাম উল্লেখ পাওয়া যায় বিপ্রদাস পিপলাই রচিত ‘মনসা বিজয়’ (১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দ) কাব্যে। কেউ কেউ বলেন এখানে ইংরাজ ব্যারাক (Barrack) তৈরি হয়েছিল বলে এই অঞ্চলের নাম হয় ব্যারাকপুর এবং তা থেকে বারাকপুর। তবে এই যুক্তি অনেকে মানেন না।
বারাকপুর নামের জনপদ অন্যত্র আছে। যেমন বনগাঁ শহরের কাছে ‘বারাকপুর’ গ্রামে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অদ্ভুত এক সমাপতন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ জীবন এই চানক বারাকপুরে কাটিয়েছিলেন। বর্তমানে বিভূতিভূষণের বংশধরগণ বারাকপুরের স্টেশনের কাছে, সুকান্ত সদনের পাশে ‘আরণ্যক’ নামে একটি বাড়িতে থাকেন। যদিও সেই বাড়িতে বিভূতিভূষণ থাকেননি। তিনি মারা যাওয়ার পর এই বাড়ি নির্মিত। তিনি ভাড়া থাকতেন আমরানি বেড় রোড (বর্তমান মঙ্গল পাণ্ডে সরণী)-এ ‘ভূতনাথ কুটিরে’। এখানেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র সাহিত্যিক তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। বিভূতিভূষণের এখানে ভাড়া আসার কারণ হল, তাঁর শ্বশুর মহাশয় থাকতেন এই বারাকপুরে। আরণ্যক বাড়িতে একটি কক্ষে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংরক্ষিত আছে। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অনুমতি নিয়ে সেগুলো দেখা যায়।
বারাকপুর গঙ্গা তথা হুগলী নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত। এর উল্টোদিকে অর্থাৎ গঙ্গার পশ্চিম তীরে বর্ধিষ্ণু জনপদ শ্রীরামপুর। শ্রীরামপুরে ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করেছিল দিনেমার (ডেনমার্ক) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। গঙ্গা তীরবর্তী বারাকপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল অপার। সেই সঙ্গে ছিল স্বাস্থ্যকর স্থান। তাই এই জায়গাটা ইংরেজরা খুব পছন্দ করত। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি (১৭৯৮-১৮০৫ খ্রিস্টাব্দ) -র এই জায়গাটিকে খুব ভালো লেগে যায়। তিনি বারাকপুরকে ইংল্যান্ডের ক্ষুদ্র সংস্করণ রূপে গড়ে তুলতে চান। শুরু হয় লাটভবন বা গভর্নমেন্ট হাউস তৈরির কাজ। কিন্তু কাজ শেষে হবার আগেই তাকে ইংলন্ডে ফিরে যেতে হয়। শুধু তাই নয়, তিনি বারাকপুরে চিড়িয়াখানা তৈরি করেছিলেন। এটি ছিল এশিয়া মহাদেশের প্রথম চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানার স্মৃতি বহন করছে বারাকপুরের ‘চিড়িয়া মোড়’ নামটি।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল, তার সূচনা হয়েছিল বারাকপুরে। সিপাহীদের বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল একটা খবর বা গুজব। খবর ছিল সিপাহীদের এনফিল্ড রাইফেলের যে টোটা ব্যবহৃত হয়, তাতে গরু ও শুকরের চর্বি মেশানো আছে। দাঁত দিয়ে টোটা ছিঁড়ে গুলি বন্দুকে পুরতে হত। তখন হিন্দু ও মুসলিমদের নিষিদ্ধ দুই পশুর চর্বি মুখে লেগে যাবে। জাত নষ্ট করার এই ব্যবস্থাপনায় সিপাহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বারাকপুরে এই বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন মঙ্গল পাণ্ডে। বিচারে মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসি হয়।
এর আগে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে বারাকপুরে একবার সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল। সেই সময় বিদ্রোহের কারণ ছিল কালাপানি অর্থাৎ সমুদ্র পার করে ব্রহ্মদেশে সেনা পাঠানো হবে। আর কালাপানি পেরোনো মানে হিন্দুদের জাত নষ্ট। তখন বিন্দা তেওয়ারি নামে এক সিপাহীর ফাঁসি হয়েছিল। এই কারণে বলা যেতে পারে বারাকপুর ‘সিপাহী বিদ্রোহ’-এর শহর।
চানক বারাকপুরের পশ্চিম প্রান্তে প্রাচীন জনপদ মণিরামপুর। এইখানে বসবাস করতেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। গঙ্গার ধারে ছিল প্রাসাদোপম বাড়ি। এই বাড়িতে পদার্পণ ঘটেছে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী সহ আরো অনেকের। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ ৩৪ বছর উত্তর বারাকপুর পৌরসভার প্রধান ছিলেন। তাই বারাকপুর রাষ্ট্রগুরুর শহর।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বারাকপুরে এসেছিল অনেকবার। তিনি আসতেন তালপুর অঞ্চলে অন্নপূর্ণা মন্দিরে। এখানে গঙ্গার ধারে রাসমণি ঘাট। ঘাটের কাছেই অন্নপূর্ণা মন্দির। এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন রানি রাসমণির চতুর্থ তথা কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বা দেবী। মন্দিরটি রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অনুরূপ। বরঞ্চ মন্দিরটি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের চেয়ে সামান্য উঁচু। এটি একটি নবরত্ন মন্দির। দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে। আর অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে।
এহেন ঐতিহাসিক নিদর্শন সমৃদ্ধ বারাকপুরের একদিনের ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা যাত্রা শুরু করলাম অন্নপূর্ণা মন্দির দিয়ে। কলকাতা থেকে বি.টি. রোড ধরে টিটাগর বাজার ছাড়িয়ে একটু এগোলেই ব্রহ্মস্থান মোড়। এখানে আছে একটা ব্রহ্ম মন্দির। আগে ব্রহ্মদেব গাছতলাতেই ছিলেন। পরে মন্দির হওয়াতে উঠে এসেছেন। সচরাচর ব্রহ্ম মন্দির দেখা যায় না, তাই দাঁড়িয়ে দর্শন করলাম। আগে বাস কন্ডাক্টাররা এখানে হাক দিত ‘বড়ামস্তান’ ‘বড়ামাস্তান’ বলে। ব্রহ্মস্থান লোকমুখে ‘বড়ামাস্তান’ হয়ে গেছে। আসলে এটি একটি লৌকিক ঠাকুর ব্রহ্মবাবা।
ব্রহ্মস্থান মন্দিরের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা বাম দিকে চলে যাচ্ছে সেটা ধরে সামান্য এগোলেই অন্নপূর্ণা মন্দির। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মতো নহবত ও নাটমন্দির আছে, আছে ছটি শিব মন্দির। মন্দিরে চারবার রামকৃষ্ণদেব এসেছিলেন। মন্দির নির্মাণের জন্য জমি ক্রয়ের সময়, মন্দিরের ভিত স্থাপনের দিন, ১৮৭৬ সালে ১২ এপ্রিল মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন এবং শেষে একবার উল্টো রথের দিন মাহেশের রথ দেখে বিকালে। এখানে অন্নপূর্ণা অষ্টধাতুর। বাম হাতে অন্নপাত্র, ডানহাতে হাতা, পাশে মহাদেব দণ্ডায়মান।
অন্নপূর্ণা মন্দির দেখে আবার আমরা সামান্য এগিয়ে ডান দিকে এসে আবার বিটি রোডের উপর উঠব। বিটি রোডে উঠেই মোড়ের মাথায় বারাকপুর রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়। এর প্রায় উল্টোদিকেই বারাকপুর মহকুমা হাসপাতাল যার নাম ডা: বি.এন. বোস (ভোলানাথ বোস) হাসপাতাল। এই স্কুল ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন এমিলি ইডেন। এমিলি ইডেন ছিলেন স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষিকা। যে কারণে এই স্কুল একসময় ইডেন স্কুল নামে পরিচিত ছিল। যদিও সরকারির নাম ছিল ব্যারাকপুর স্কুল, বর্তমানে বারাকপুর গভর্নমেন্ট হাই স্কুল।
এমিলি ইডেন ছিলেন গভর্নর জেনারেল জর্জ ইডেনের বোন। জর্জ ইডেন লর্ড অকল্যান্ড (১৮৩৬-১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দ) নামে পরিচিত ছিলেন। এমিলি ইডেন ছিলেন মরমী চিত্রশিল্পী। তিনি ভারতীয় জীবনযাত্রার প্রচুর ছবি এঁকেছেন। এমিলি ইডেনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলকাতার ইডেন উদ্যানের নাম। লর্ড অকল্যান্ড তাঁর বোনদের সান্ধ্য ভ্রমণের জন্য এই উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন।
স্কুলের মূলভবনটি গির্জার আদলে তৈরি। এখন আর এই ভবনে ক্লাস হয় না। নতুন বিল্ডিং-এ ক্লাস হয়। পুরাতন হেরিটেজ ভবনে প্রধান শিক্ষকের চেম্বার সহ অন্যান্য অফিস। পুরাতন ভবনটি অবস্থা খুবই খারাপ। বৃষ্টি হলে ছাদ থেকে জল পরে। পূর্ত দপ্তর থেকে লোহার দণ্ড দিয়ে ঠেকনা দিয়ে ছাদের পতন বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। অবিলম্বে এটা সারাই নাহলে লর্ড একল্যান্ড ও এমিলি ইডেনের স্মৃতি অচিরেই হারিয়ে যাবে। এই স্কুলের কৃতি ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রখ্যাত নাট্যকর ও অধ্যাপক ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ এবং ডা: ভোলানাথ বসু; যার নামে মহকুমা হাসপাতালের নাম।
আমরা আবার একই পথে অন্নপূর্ণা মন্দিরের দিকে যাবো। তবে সামান্য গিয়ে বাঁ দিকে না গিয়ে ডান দিকে নেবো। বামদিকে অন্নপূর্ণা মন্দির, আর ডানদিকে ধরে এগিয়ে গেলে বামদিকে পড়বে গান্ধীঘাট। রাস্তার ডানদিকে পড়বে রাজ্য পুলিশের সশস্ত্র বাহিনীর দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ ব্যাটেলিয়ান। বোঝা যায় বেশ ভাব গম্ভীর পরিবেশ।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ৩০শে জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর নিধন হওয়ার পর সিদ্ধান্ত হয়, তাঁর চিতাভস্ম ভারতের বিভিন্ন নদীতে অর্পণ করা হবে। পশ্চিমবঙ্গে সেই স্থান নির্বাচিত হয় বারাকপুর লাট বাগানের এই স্থানটি। গভর্নমেন্ট হাউস তৈরি হওয়ার পর হাউসের সংলগ্ন বাগান এলাকার নাম হয়ে যায় লাট বাগান। লাট কথাটি ইংরাজি লর্ড শব্দ থেকে এসেছে। যদিও সরকারি ভাবে নাম ছিল ‘ব্যারাকপুর পার্ক’। স্বাধীনতার পর সমস্ত লাটবাগানের নাম হয় মঙ্গল পাণ্ডে উদ্যান। এই উদ্যানে এখন পুলিশ ট্রেনিং কলেজ; যার এখন পোশাকি নাম ‘স্বামী বিবেকানন্দ স্টেট পুলিশ একাডেমি’ (SVSPA)। আর আছে রাজ্য পুলিশের কতকগুলো ব্যাটালিয়ন।
১৯৪৮ সালের ১৮ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গে তৎকালীন মহামান্য রাজ্যপাল চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী এই ঘাটে গান্ধীজির চিতাভস্ম অর্পণ করেন। ১৯৪৯ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু কতৃক গান্ধী ঘাট প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষ আকৃতির সৌধে প্রখ্যাত ভাস্কর সুনীল পাল তৈরি করে দিয়েছেন গান্ধী জীবন নিয়ে পোড়ামাটিতে নির্মিত একটি আলেখ্য। শুধু বারাকপুর নয় সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের এটি একটি দর্শনীয় স্থান।
গান্ধীঘাট পেরোলেই বামদিকে অর্থাৎ গঙ্গার তীরে ‘জহর কুঞ্জ’। শীতকালে পিকনিকের ভালো চাপ থাকে। আরেকটু এগিয়ে গেলে মালঞ্চ টুরিস্ট লজ। যদিও বর্তমান নাম ‘মঙ্গলধারা ট্যুরিজম প্রপার্টি’। গঙ্গার ধারে নিরিবিলিতে দিন যাপনের খুব সুন্দর ব্যবস্থা। কেউ চাইলে এখানে এসে অনায়াসে কাটিয়ে যেতে পারেন।
মঙ্গলধারাতে না ঢুকে আমরা একটু এগিয়ে যাব শঙ্কর মণ্ডল রোড ধরে। বারাকপুর গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে আমরা শঙ্কর মণ্ডল রোড ধরেই এসেছি। সামান্য এগিয়ে রাস্তার বাঁদিকে পাবো একটি লোহার গেট, তাতে পুলিশ প্রহরা। এখান থেকে শুরু পুলিশ ট্রেনিং কলেজের সীমানা শুরু। গাড়ি নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ। অনুমতি নিয়ে পায়ে হেঁটে প্রবেশ করলেই বাম দিকে শিবঘাট। শিবঘাটের সামনে প্রশস্ত চোখ জুরানো সবুজ খেলার মাঠ। তার উল্টোদিকে ঘোড়ায় সওয়ার লর্ড ক্যানিং-এর মূর্তি। আর তার সামনে লেডি ক্যানিং-এর সমাধি।
লর্ড ক্যানিং (১৮৫৬ – ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ)-এর স্ত্রী লেডি ক্যানিং এমিলি ইডেনের মতো বারাকপুরকে ভালোবাসতেন। তাঁর নামেই আমাদের বিখ্যাত মিষ্টি লেডিকিনি। তিনি লাট বাগানের মধ্যে বিখ্যাত বটগাছটিকে আবিষ্কার করেন। কথিত এই বট গাছে নাকি মঙ্গল পাণ্ডেকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। তবে ঐতিহাসিকগণ বলেন সেই বট গাছটি ছিল সেনা বাহিনীর প্যারেড গ্রাউন্ডের কাছে।
লাট বাগানের বট গাছটি মূল কাণ্ড ১৮৬৯ সালের সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি আমফানে অন্যান্য স্তম্ভ মূলগুলো আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাছটি বর্তমানে পুলিশ ট্রেনিং একাডেমির প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থিত। আবার গভর্নর হাউসের কাছ থেকেও দেখা যায়।
এবার আমরা যাবো গভর্নর হাউস। লেডি ক্যানিং-এর সমাধি দেখে আমরা গঙ্গার ধার দিয়ে পায়ে হেঁটে চলে আসতে পারি গভর্নর হাউস। গাড়ি নিয়ে এলে আবার শিবঘাট গেট থেকে বেরিয়ে বামদিকের রাস্তা ধরে বাম দিক বরাবর সোজা আসতে হবে পি.টি.সি. (বর্তমান SVSPA)-এর ওয়েস্ট গেটের দিকে। গেটের কাছাকাছি এসে বামদিকে তাকালেই দেখা যাবে ঝকঝকে গভর্নর হাউস।
আগে এরকমটি ছিল না। রঙচটা, প্লাসটার খসা অবস্থায় পিটিসির হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ‘ট্রেনি’রা বলতো এটা ব্রিটিশদের নাচ ঘর। অনেকেই ভূতের ভয় পেতো। যখন সৌমেন মিত্র সাহেব এডিজি ট্রেনিং ছিলেন, তিনি হেরিটেজ কমিশনের সাহায্য নিয়ে এই অট্টালিকা পুনরুদ্ধার করেন। একতলায় হয়েছে একটি মিউজিয়াম। দেখা যাবে, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, ব্যারাকপুরের ইতিহাস এবং কিছু অস্ত্রশস্ত্র।
গভর্নর হাউস দেখতে হলে ট্রেনিং একাডেমির অনুমতি নিতে হবে। গভর্নর হাউস দেখে একাডেমির পশ্চিম গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবো। বেরোনোর আগে বেরোতে হবে ১৯১১ সালে নির্মিত ঐতিহাসিক লেডি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। পশ্চিম দ্বার পেরিয়ে আমরা পাব রিভার সাইড রোড। সোজা গেলে পার্ক রোড। আমরা সোজা না গিয়ে বাম দিকের রিভার সাইড রোড ধরবো। রাস্তাটা ডানদিকে মোড় নিয়ে গঙ্গা নদীর সমান্তরালে চলে গেছে। সামান্য এগিয়ে বামদিকে আছে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউস। এটা পশ্চিমবঙ্গের মহামান্য রাজ্যপালের সম্পত্তি।
কলকাতা রাজভবন ছাড়াও রাজ্যপালের আরও দুটি বাসস্থান আছে। একটি দার্জিলিঙে এবং অপরটি বারাকপুরে। এটি ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। এখানে গভর্নরের প্রাইভেট সেক্রেটারীরা বাস করতেন। এখানের ঘাটটিকে নিশান ঘাট বলে। এর ভেতরে মঙ্গল পাণ্ডে পার্কের পাঁচিল ঘেঁষে আছে একটি সীমাফোর টাওয়ার। অনেকে বলেন এখান থেকে নিশান দেখানো হতো বলে এই ঘাটের নাম নিশান ঘাট। এই ঘাটের কাছে মঙ্গল পাণ্ডে বিদ্রোহ করেছিলেন।
ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসের মধ্যে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে যে ব্রিটিশ পুরুষদের মূর্তি ছিল সেগুলো স্বাধীনতার পর এখানে এনে রাখা হয়েছে। ১৯৬৯ সালে মহামান্য রাজ্যপাল ধরমবীর-এর সময় কলকাতা থেকে এগুলো স্থানান্তরিত হয়েছে। এই মূর্তিগুলো দেখতে এখনও অনেক বিদেশীরা আসেন। ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসের ভেতরে কেয়ারি করা বাগান আর ক্যাম্পাসটা গাছ-গাছালিতে ভরা। কিন্তু ফ্লাগ স্টাফ হাউসের মধ্যে প্রবেশ কলকাতা রাজভবনের অনুমতি সাপেক্ষ।
ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসের গাঁয়েই আছে মঙ্গল পাণ্ডে পার্ক। নির্দিষ্ট দক্ষিণার বিনিময়ে গাছ-গাছালির পূর্ণ গঙ্গার হওয়ার স্নিগ্ধ উদ্যানের মজা নিতে পার্কে প্রবেশ করতে পারেন। এখানে আছে মঙ্গল পাণ্ডে ঘাট।
আবার রিভার সাইড রোড ধরে বামদিকেই এগিয়ে যাব। তারপর পড়বে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন। গঙ্গার ধারে ঐতিহাসিক গোয়ালিয়র ভবন গ্রহণ করে ১৯৭৬ সালে স্বামী নিত্যানন্দ মহারাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন এই মিশন। গঙ্গার ধারে মনোরম পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রামকৃষ্ণ মন্দির। শিক্ষাক্ষেত্রে এই মিশনের অবদান উল্লেখযোগ্য। ২০২৩ সালে বারাকপুর মিশন থেকে ৮৭৫ ছাত্র-ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন থেকে বেরিয়ে যাব আমরা গান্ধী স্থারক সংগ্রহালয়-এ।
১৪ নং রিভার সাইড রোডে হুগলী নদীর তীরে ৯ বিঘা জায়গা নিয়ে গান্ধী মেমোরিয়াল মিউজিয়াম। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ৭মে মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কিত জিনিসপত্র সংগ্রহ করে এখানে জনসাধারণের প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। শোনা যায় ইংরেজ আমলে এখানে গোলাবারুদ রাখার জায়গা ছিল। মহাত্মা গান্ধীর হাতে লেখা চিঠি, ব্যবহৃত জিনিস এখানে এলে দেখা যাবে। এখানের লাইব্রেরীটি খুব উন্নত মানের। এখানে গান্ধীজী সম্পাদিত ইয়ং ইন্ডিয়া এবং হরিজন পত্রিকার সংগ্রহ এখানে আছে। হরিজন পত্রিকা বাংলা ভাষাতেও বের হত। সেই সংস্করণ গুলো এখানে আছে।
এরপর আমাদের গন্তব্য রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। রিভার সাইড রোড ধরে বামদিকে গিয়ে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে উঠব। সেই রাস্তা ধরে বাঁদিকের সোজা এগিয়ে গেলে মহাদেবানন্দ কলেজ। তার আগেই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। গঙ্গার ধারে সত্যি সুদৃশ্য বাড়ি। বর্তমান একতলার একটি ঘরে সংগ্রহশালা। সেখানে একটি রাষ্ট্রগুরুর ব্যবহার করা চেয়ার ছাড়া বিশেষ কিছু নেই।
বাকি ঘরগুলোতে মহাদেবানন্দ কলেজের ক্লাস হয়। বর্তমানে এই বাড়িটি মহাদেবানন্দ কলেজের সম্পত্তি। সরকার থেকে এই বাড়ি অধিগ্রহণ এই কলেজকে দিয়েছে। যদিও ব্যারাকপুরে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ-এর নামে কলেজ আছে, কিন্তু মহাদেবানন্দ কলেজের নিকটবর্তী হওয়ায় দারুণ বাড়িটি মহাদেবানন্দ কলেজকে দেওয়া হয়েছে।
মহাদেবানন্দ কলেজ কর্তৃপক্ষ সুরেন্দ্রনাথের বসতবাটির চত্বর সুন্দর করে সাজিয়েছেন। বাড়ির সামনে রাষ্ট্রগুরু কর্তৃক খনন করা পুকুরটি এখনও আছে। বাড়ির গাড়ি বারান্দার ওপরে সুন্দর একটি ঝুলবারান্দা আছে। এখান থেকে গঙ্গার অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। বাড়ির পশ্চিম দিকে গঙ্গার তীরে ঘেঁষে রাষ্ট্রগুরুর চিতাভস্মের ওপর নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিফলক।
এরপর আমরা যাব বারাকপুর রেলস্টেশন ৩৬ টি পিলার দিয়ে নির্মিত ব্রিটিশ স্থাপত্যের ঐতিহাসিক স্টেশন। ১৮৬২ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম ট্রেন চলছিল ব্যারাকপুরের ওপর দিয়ে।
আমরা এখানেই আমাদের ভ্রমণ শেষ করতে পারি। যারা আগ্রহী আছেন তাঁরা স্টেশন এর কাছে আরণ্যক ভবনে যেতে পারেন। যারা আরও বেশি আগ্রহী ঘুরে দেখতে পারেন আর্দালি বাজার (বর্তমান নাম গান্ধী বাজার) সদর বাজার, ঔপনিবেশিক ব্যারাকপুরের পরশ পাবেন। ঘুরতে পারেন ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া; এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর বাংলো আছে, যা ব্রিটিশ আমেজ ধরে রেখেছে। এছাড়া আছে গথিক স্থাপত্যের অট্টালিকা, যেমন – হুগলি সার্ভিসেস অফিসার্স ইনস্টিটিউট।
খাওয়া দাওয়ার জন্য বারাকপুর তো এখন ‘বিরিয়ানিপুর’। সমস্ত নামীদামি কোম্পানির বিরিয়ানির দোকান, রেস্টুরেন্ট এখানে আছে। চিড়িয়ামোড় ও স্টেশন চত্বরে খাবার দোকানের অভাব নেই। তাই একদিন ‘ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া’ ঘুরে আসুন বারাকপুর।
১) ইতিহাসের শহর বারাকপুর – কানাইপদ রায় (পূর্ণ প্রতিমা)
২) Under the Banyan tree – The forgotten story of Barrackpore Park: Monabi Mitra/ Soumen Mitra (AAKAR)