সুপারসহ সাসপেন্ড ১২ জন চিকিৎসক

নিজস্ব চিত্র

স্যালাইন কাণ্ডে চিকিৎসকদেরই দায়ী করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ঘটনায় মেদিনীপুর মেডিক্যালের এমএসভিপি (মেডিক্যাল সুপারিনটেন্ডেন্ট কাম ভাইস প্রিন্সিপ্যাল সহ ১২ জন চিকিৎসককে সাসপেন্ড করার নির্দেশ দিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে স্যালাইন–কাণ্ড নিয়ে মুখ খুলেছেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। তাঁর দাবি, চিকিৎসকরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে প্রসূতি ও সদ্যোজাতকে বাঁচানো যেত। পাশাপাশি এদিন অপারেশন থিয়েটারের সামনে সিসিটিভি লাগানোর নির্দেশ দেন মমতা।

সরকারি হাসপাতালগুলির উপর নজর রাখতে এবার অপারেশন থিয়েটারের বাইরেও সিসিটিভি লাগানোর নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকী তিনি মনে করেন ওটির ভিতরেও সিসিটিভি লাগানো উচিত। কিন্তু অনেক রোগীর তাতে আপত্তি থাকতে পারে, এই বিষয়টি বিবেচনা করে ওটির গেটের বাইরে সিসিটিভি লাগানোর নির্দেশ দেন তিনি। তাঁর দাবি, গেট পর্যন্ত কে যাচ্ছে, কে আসছে, কারা ভিতরে ঢুকছে, কারা বেরোচ্ছে, সেই সব তথ্য রাখা দরকার। কোনও ক্ষেত্রে গাফিলতির অভিযোগ উঠলে তখন সেটা খতিয়ে দেখতে সুবিধা হবে। কেউ যদি সিসিটিভি লাগাতে বাধা দেয় সেক্ষেত্রে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘যারা আপত্তি জানাচ্ছে, তাঁদের বলুন প্লিজ ছুটি নিন। কারণ, আপনার ভুলের জন্য মানুষের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে কারও বাধা মানব না।’

৮ জানুয়ারি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন পাঁচজন প্রসূতি। তাঁদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থদের মধ্যে ৩ জনকে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। রেখা সাউ নামে এক প্রসূতি মেদিনীপুর মেডিক্যালেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বৃহস্পতিবার রেখার সদ্যোজাত শিশুরও মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ, প্রসূতিদের শরীরে নিম্নমানের রিঙ্গার্স ল্যাকটেট (আরএল) স্যালাইন ব্যবহার করা হয়েছে। এর জেরেই এই মৃত্যু ও অসুস্থ হওয়ার ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর হস্তক্ষেপ করে স্বাস্থ্যদপ্তর। তদন্তের জন্য একটি ১৩ সদস্যের তদন্তকারী কমিটি গড়ে দেয়। পাশাপাশি সিআইডিকে এই ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হয়। এদিন মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, সিআইডি এবং স্বাস্থ্যদপ্তরের তদন্তকারী কমিটির দেওয়া রিপোর্ট একে অপরের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। দুটি রিপোর্টেই প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের গাফিলতির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। এই দুই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই মেদিনীপুর মেডিক্যালের ১২ জন চিকিৎসককে সাসপেন্ড করার নির্দেশ দিয়েছেন মমতা।


এদিন মৃত প্রসূতির পরিবারকে ৫ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা ও  ১ জনকে চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দাবি, মৃতের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে আঙুল তোলার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কোনও সান্ত্বনাই তাঁদের জন্য যথেষ্ট নয়। ওই পরিবারগুলি সরকারকে কিছু বললে তা শুনতে হবে। মমতার দাবি করেন, ঘটনার দিন অপারেশন থিয়েটারে কোনও সিনিয়র চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন না। এই গাফিলতি একেবারেই বরদাস্ত করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। এরপরই ৮ জানুয়ারি প্রসূতিদের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ১২ জন চিকিৎসককে সাসপেন্ড করার নির্দেশ দেন মমতা। সেই তালিকায় রয়েছেন মাতৃমা বিভাগের ইউনিট ১সি–র বেড ইনচার্জ দিলীপ পাল, সিনিয়ার চিকিৎসক হিমাদ্রি নায়েক, আরএমও সৌমেন দাস, পিজিটি প্রথমবর্ষের চিকিৎসক মৌমিতা মণ্ডল, পূজা সাহা, অ্যানাসথেশিস্ট পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্টার্ন চিকিৎসক সুশান্ত মণ্ডল, পিজিটি থার্ড ইয়ার চিকিৎসক জাগৃতি ঘোষ, ভাগ্যশ্রী কুন্ডু, পিজিটি ফাস্ট ইয়ার অ্যানাথেশিস্ট মণীশ কুমার, বিভাগীয় প্রধান মহম্মদ আলাউদ্দিন এবং হাসপাতাল সুপার জয়ন্ত রাউত। চিকিৎসক দিলীপের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি অপারেশনের দিন ডিউটি থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালের বাইরে অন্য হাসপাতালে কাজ করছিলেন। সেখানে অস্ত্রোপচার করছিলেন। এই নিয়ে দিলীপকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন মমতা। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়ে দেন, কোনও চিকিৎসকের সরকারি হাসপাতালে ডিউটি থাকলে তিনি সেই সময় হাসপাতালের বাইরের কোনও কাজে যেতে পারবেন না। তাঁর কথায়, ‘আমি চিকিৎসকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু যেখানে অন্যায় হয় সেখানে আমাকে শত সমালোচনা করলেও আমার কিছু যায় আসে না। মানুষের দিকটাও দেখা আমাদের কর্তব্য। তাই দুটি তদন্ত রিপোর্ট দেখে, মুখ্যসচিব ও স্বাস্থ্যসচিবের পরামর্শ মেনে আমরা ব্যবস্থা নিলাম।’

এদিন নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে মমতা তাঁর আমলে স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতির বিষয়টা তুলে ধরেছেন। তিনি জানান, তাঁর আমলে রাজ্যে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৭। পাশাপাশি আসনের সংখ্যাও উল্লেখজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজ্যে এমবিবিএস আসনের সংখ্যা ১৩৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৬৫০। বৃদ্ধি পেয়েছে এমডি আসনের সংখ্যাও। এছাড়াও সরকারি হাসপাতালে বেড়েছে শয্যার সংখ্যাও। প্রচুর ব্লাড ব্যাঙ্ক ও ট্রমা কেয়ার ইউনিট তৈরি হয়েছে। রাজ্যে ১৪ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা। চিকিৎসকদের পাশাপাশি নার্সিং কর্মী, প্যারামেডিক্যাল কর্মী ও আশা কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের মাধ্যমে প্রচুর মানুষ পরিষেবা পাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেছেন মমতা। এত সব কিছুর পরেও কেন চিকিৎসায় গাফিলতি হচ্ছে এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তাঁর দাবি, চিকিৎসার বিষয়টা ডাক্তারদের উপরই নির্ভর করে। এ বিষয়ে তাঁর বা মুখ্যসচিব ও স্বাস্থ্যসচিবের জ্ঞান নেই। এই দায়িত্ব সম্পূর্ণ চিকিৎসকদের উপর বর্তায়। চিকিৎসকদের একাংশ নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালে গিয়ে যথার্থ পরিষেবা পাচ্ছেন না বলে জানালেন মমতা। চিকিৎসকদের এই গাফিলতির প্রবণতার জন্য এক্সামিনেশন সিস্টেমকে দায়ী করেছেন তিনি। তিনি জানান, এক্সামিনেশন সিস্টেমে বদল আনার জন্য একটি বিদেশি সংস্থার সাহায্যে রাজ্যের চিকিৎসক ও নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ধারাবাহিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে।