দেবাশিস দাস
ঘাটালকে বন্যার কবল থেকে মুক্ত করতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ শুরু হয়েছে। ১৯৫৭ সালে মান সিং কমিটির রিপোর্টে প্রথম ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কথা বলা হয়েছিল। ১৯৮২ সালে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত করতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দ চেয়ে ছ’বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, চারবার দেখাও করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই প্রকল্প যাতে দিনের আলো দেখতে পায়। রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য এবং দলীয় সাংসদদের এক প্রতিনিধি দলকে দিল্লি পাঠিয়েছিলেন ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের প্রয়োজনীয়তার কথা কেন্দ্রকে বিশেষভাবে বোঝানোর জন্য। কিন্তু কেন্দ্র সাড়া না দেওয়ায় অবশেষে রাজ্যের নিজের টাকায় এই মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত করার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে এই প্রকল্পের জন্য ১৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করার কথা জানানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৫০০ কোটি টাকা এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য জমির প্রয়োজন।
কৃষকদের কাছ থেকে জমি নেওয়ার জন্য তাঁদের কাছে আবেদন জানানো হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে ১০৫ একর জমির প্রয়োজন। এর জন্য প্রায় ১০ হাজার কৃষক পরিবারকে জমি দিতে হবে। কিন্তু যে জমি নেওয়া হবে, তার সিংহভাগ জায়গায় ফসল হয় না। জমির জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে আবেদন জানানো হবে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের তরফে। ইতিমধ্যে এই নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যতদূর জানা গিয়েছে, জমির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের সম্মতি নিয়ে জমি কিনবে রাজ্য সরকার। এই জমির জন্য বাজার মূল্যের চেয়ে ২ থেকে আড়াই গুণ অর্থ দেওয়া হবে সরকারের তরফে। কৃষকদের উন্নয়নে এর আগে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে রাজ্য সরকার। কৃষকদের জমির খাজনা মকুব থেকে শুরু করে শস্যবিমা প্রকল্প সবকিছুই হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের সৌজন্যে। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সেচ দপ্তরের আধিকারিকরা রীতিমতো আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন। এই প্রসঙ্গে রাজ্যের সেচমন্ত্রী ডা. মানস ভুঁইয়া জানান, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চান দ্রুত এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে। ফি বছর ঘাটাল বন্যার কবলে পড়ে। ঘাটালবাসীকে বন্যার কবল থেকে মুক্ত করতে এর আগে বিগত বাম সরকার কোনও উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের ডাকে সাড়া দিল না। কেন্দ্রীয় বঞ্চনা সত্ত্বেও ঘাটালবাসীর দুর্দশার কথা মাথায় রেখে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে রাজ্যের সেচমন্ত্রী ডা. মানস ভুঁইয়া সেচ দপ্তরের আধিকারিকদের মাঠে নামিয়েছেন এই প্রকল্পে গতি আনার জন্য। রবিবার ঘাটালে গিয়ে এই নিয়ে একটি মনিটরিং কমিটির বৈঠক হয়। পাঁচ ঘণ্টা ধরে এই বৈঠকে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ছাড়াও অঞ্চল স্তরের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। ঘাটালের সাংসদ দেব এই বৈঠকে যোগ দেন।
ইতিমধ্যে ২০১৮ থেকে ২০২১ সময়কালে এই প্রকল্পের আওতায় ৩৪১.৩৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় পরবর্তী কাজগুলি ২০২৪-২৫ থেকে শুরু করে ২০২৬-২৭ এই তিন অর্থবর্ষের মধ্যে শেষ করতে ১৫০০ কোটি টাকা ধার্য হয়েছে এবং সম্পন্ন করার পরিকল্পনা হয়েছে। পাঁচটি স্লুইস নির্মাণের কাজ শুরু হতে চলেছে। যেহেতু সময়মতো এবং কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন বিভাগ, সংস্থা, প্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা সহ কিছু প্রকল্প রূপায়ণের জন্য জমির সংস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে কমিটির প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
বর্তমান চন্দ্রেশ্বর খালকে ৫.৮ কিমি সম্প্রসারিত করে দাসপুর-১ ব্লকে গুড়ুসলীতে একটি নতুন সুইস গেটের মাধ্যমে শিলাবতী নদীর সাথে সংযুক্তকরণ।
চন্দ্রেশ্বর খালকে শিলাবতীর সাথে সংযুক্ত করার উপকারিতা—
১) শিলাবতী নদীর জলে ঘাটাল পুরসভার এলাকা প্রায়ই প্লাবিত হয়। চন্দ্রেশ্বর খালের সাথে সংযুক্তকরণের ফলে শিলাবতীর জলপ্রবাহের একটি অংশ চন্দ্রেশ্বর খালের মাধ্যমে আরও কম সময়ে রূপনারায়ণ নদীতে পৌঁছবে। ফলে ঘাটাল পুরসভায় বন্যার প্রকোপ কমবে।
২) প্রস্তাবিত সম্প্রসারণের জন্য চিহ্নিত ৫.৮ কিমি অংশ প্রধানত কৃষিজমি। উক্ত পথে বাড়ি, দোকান বা অন্যান্য পরিকাঠামো সবচেয়ে কম। কাজেই এই সম্প্রসারণের ফলে সাধারণ মানুষ এবং ছোট ব্যবসায় যুক্ত মানুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তবুও, খাল সম্প্রসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট মানুষজনকে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
৩) সম্প্রসারণের জন্য চিহ্নিত ৫.৮ কিমি পথে কোনও বাঁক নেই। ফলে জলের গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হওয়া বা নদীক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
৪) সম্প্রসারিত ৫.৮ কিমি অংশের আশেপাশে দাসপুর-১ ব্লকে, খাল ছাপিয়ে নদীর জল পাশের এলাকা প্লাবিত করার সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ শিলাবতীর সাথে সংযোগস্থলে প্রস্তাবিত ফ্লুইস রেগুলেটারের মাধ্যমে প্রয়োজনমতো জলপ্রবাহ চন্দ্রেশ্বর খালে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হবে। খালের বহন ক্ষমতা থেকে বেশি জল কখনওই চন্দ্রেশ্বর খালে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। পার্শ্ববর্তী কৃষিজমি জলে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা তাই অমূলক।
৫) দাসপুর-১ ব্লকে, প্রস্তাবিত ৫.৮ কিমি সম্প্রসারিত খালের আশেপাশের এলাকায় বৃষ্টি হলে, ওই জল খুব সহজেই খালে গিয়ে পড়বে, যার জন্য যথাসংখ্যক খালের সাথে ফ্লুইস এবং সংযুক্ত নালা থাকবে। এছাড়া দুই পাশের যাতায়াতের জন্য যথাসংখ্যক সেতু নির্মাণ করা হবে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় রাজ্য সরকার নিজস্ব বাজেটের মধ্যে থেকে প্রকল্পের বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রবল বন্যার প্রকোপ থেকে পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ঘাটাল সহ অন্যান্য এলাকার বন্যা ক্লিষ্ট মানুষের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে মূল প্রকল্পের অতিরিক্ত কিছু কাজ সম্পাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেমন পূর্বের তিনটি সেতুর সঙ্গে আরও একটি সেতুর সম্প্রসারণ এবং পুনর্নিমাণ সহ চন্দ্রেশ্বর খালের সম্প্রসারণ।