• facebook
  • twitter
Saturday, 2 November, 2024

আর কবে প্যালেস্তাইনের সাধারণ নাগরিকেরা পাবে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি?

মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশে ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত এই ভূখণ্ডটি বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কেন এত গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, যে সমস্তরকম আন্তর্জাতিক আইন মানবাধিকার লংঘন করে দশকের পর দশক ধরে ইজরায়েলের বর্বরতা কে মার্কিনীরা মদত জুগিয়ে যাচ্ছে!

গত ৭ই অক্টোবর,২০২৪ এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে প্যালেস্টিনিয়দের উপর চলমান ইজরায়িলি গণহত্যার। গণহত্যার বর্ষপূর্তিতে লন্ডনের রাসেল স্কোয়ার থেকে শুরু করে কলকাতার ধর্মতলা—বিশ্বের এরকম অজস্র জনপদে মানবতাবাদী যুদ্ধ বিরোধী শান্তিকামী মানুষ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট ইজরায়েল সরকারের বিরুদ্ধে ‘স্বাধীন প্যালেস্তাইন’ এর দাবিতে সোচ্চার হয়ে মিছিলে হাঁটছে। নানা রঙের পতাকা হাতে নানা মতের নানা ভাষার মানুষের সমাহার ঘটেছে এই সব মিছিলে। ‘নট ইন মাই নেম’ লেখা ব্যানারে যেমন ইহুদিরা পা মেলাচ্ছে আবার কোথাও হিটলারের কুখ্যাত কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী থাকা ইহুদি দম্পতির বৃদ্ধ মেয়েও “আমি ইহুদি, আমি প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার পক্ষে” এই স্লোগান দিতে দিতে মিছিল এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই নারকীয় গণহত্যার প্রথম বর্ষে বিশ্বজুড়ে মানবতাবাদী মানুষ নানা প্রতিবাদে সামিল হলেও আরব দুনিয়াতে মার্কিন মদতপুষ্ট ইজরায়েলের দখলদারি আগ্রাসনের ইতিহাসের দীর্ঘ অতীত রয়েছে। যার প্রাতিষ্ঠানিক সূত্রপাত ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে হয়। এই ঘোষণা ছিল আসলে প্যালেস্তাইনের মাটিতে একটি ইহুদি আবাসভূমির ধারণাকে মান্যতা দেওয়া, যার ফলে এই অঞ্চলে সেই সময় থেকে দলে দলে ইহুদি অভিবাসীদের আগমন ঘটা শুরু হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের উপর হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বর্বরতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৮ সালের ১২ মে’ আরব দুনিয়ার সাথে কোনও আলোচনা ছাড়া সম্পূর্ণ মার্কিনীদের মদতে আরব ভূমিতে ইজরায়েল কে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইহুদি জায়নবাদীরা। যাদের প্রধান ছিলেন দাভিদ বেন গুরিয়ন (পরবর্তীতে তিনি ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন)৷ এই ঘোষণার দশ মিনিটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ঘোষণার অনিবার্য পরিণতি দাঁড়ায় বিভিন্ন আরব বাহিনীর সাথে ইজরায়েলের সংঘাত। বিগত আট দশকে একদিকে বিশ্ব দেখেছে এমন অজস্র সংঘাত বা যুদ্ধ। বিশেষ করে উল্লেখ্য ১৯৪৮-৪৯, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩, ১৯৮২, ২০০৬ এবং ২০২৩ এর ৭ অক্টোবর থেকে চলমান গনহত্যা। অন্যদিকে বিশ্ববাসী এ-ও প্রত্যক্ষ করেছে ১৯৯৩ সালে ‘অসলো’ চুক্তির মধ্য দিয়ে ইজরায়েল-প্যলেস্টাইনের দীর্ঘ দ্বন্দ্বের অবসানের প্রচার থেকে ১৯৯৪ সালে দুই নেতা ইয়াসির আরাফাত ও আইজাক রবিনের যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। কিন্তু শান্তি ফেরেনি অসহায় প্যালেস্তাইনের সাধারণ নাগরিকদের জীবনে।

মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশে ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত এই ভূখণ্ডটি বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কেন এত গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, যে সমস্তরকম আন্তর্জাতিক আইন মানবাধিকার লংঘন করে দশকের পর দশক ধরে ইজরায়েলের বর্বরতা কে মার্কিনীরা মদত জুগিয়ে যাচ্ছে! আসলে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে প্যালেস্তাইন। এখানকার জেরুজালেম শহর হল কয়েক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে খ্রিস্টান, মুসলিম এবং ইহুদি এই তিন ধর্মের অনুসারীদের জন্য পবিত্র স্থান। স্বাভাবিকভাবে ভৌগোলিক অবস্থান ও তিন ধর্মের সূতিকাগার হওয়ায় এই ভূখণ্ডটির রয়েছে ধর্ম, সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও ভূ-রাজনীতির এক দীর্ঘ গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই কারণে বিশ্ব-রাজনীতিতে মার্কিনীদের আধিপত্য বজায় রাখতে এই ভূখণ্ডের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু গোটা বিশ্বকে গণতন্ত্রের পাঠ দেওয়া, মানবতার কথা বলা মার্কিনীরা ভুলে গেছে ইংল্যান্ড যদি ইংরেজদের স্বভূমি হয়, যুক্তরাস্ট্র যদি মার্কিনীদের স্বভূমি হয়, ফ্রান্স যদি ফরাসিদের স্বভূমি হয় তাহলে প্যালেস্তাইন এর মাটি অবশ্যই আরবদের স্বভূমি হবে। আজ তারা নিজ ভূমে পরবাসী। নিজভূমে ‘স্বাধীন প্যালেস্তাইনের’ স্বপ্ন বুকে নিয়ে প্রতিদিন লড়ে যাচ্ছে প্যালেস্তাইনের মতাদর্শগত নানা পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলিও। এই দলে পিএফএলপি, ডিএফএলপি-র মতো মার্ক্সবাদী গেরিলা বাহিনী, প্যালেস্তাইন পিপলস পিপলস পার্টির মত কমিউনিস্ট পার্টি যেমন আছে, ঠিক তেমন আছে হামাসের মতো ইসলামপন্থী শক্তির উজ্জ্বল উপস্থিতি। প্যলেস্টাইনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রসঙ্গে এদের নিজেদের মধ্যে আছে হাজারো বিরোধ তা সত্যেও এদের মিলিয়ে দেয় ইজরায়েলি আগ্রাসনের হাত থেকে নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করবার অদম্য লড়াই এর জেদ। অজস্র সাধারণ নাগরিকদের সাথে প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে ইজরায়িলি বর্বরতায় এই দলগুলির অজস্র স্বাধীনতাকামী স্বপ্নদ্রষ্টারা।

এখনও পর্যন্ত গত এক বছরে ইজরায়েলের আক্রমণে গাজাতে প্রায় ৪২০০০ সাধারণ মানুষের প্রাণ গেছে, তার মধ্যে শিশু ১৬৫০০ জন। ১ লক্ষের বেশি আহত, দশ হাজার মানুষ নিখোঁজ। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘর ছাড়া, ৩৫ টি বড় হাসপাতালের মধ্যে ৩১ টি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ। অসাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য শিশুরা নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত।

জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি পন্ডিত নেহরু থেকে মনমোহন সিং সরকার পর্যন্ত ভারতের প্যালেস্তাইন এর পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট থাকলেও আজকের মোদি জমানায় ভারত গনহত্যার বিরুদ্ধে মানবতার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করতে পারছে না। আর ইজরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু প্রতিদিন আন্তর্জাতিক সব আইনের সীমা লংঘন করে গনহত্যা চালিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন হামাস কে শেষ না করা পর্যন্ত এই যুদ্ধ চালিয়ে যাবে৷ কিন্তু প্রতিদিন তারা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে গাজার বাইরেও ওয়েস্ট ব্যাংকের মত স্থানেও, যেখানে হামাস নেই। এই সময়ে ওয়েস্ট ব্যাংকে ইজরায়েলের আক্রমণে সরকারি হিসেবে ৭৫০ জন মারা গেছে যার মধ্যে ১৬০ জন শিশু এবং ৬০০০ এর বেশি আহত। আসলে এই যুদ্ধ মার্কিনীদের মদতে প্যালেস্টিনিয়দের পুরোপুরি ধ্বংস করে ইজরায়েলের দখলদারি সম্পূর্ণ কায়েম করার জন্য গনহত্যা। পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে যুদ্ধ শুধু প্যলেস্টাইন আর ইজরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সরাসরি জড়িয়ে পড়ছে লেবানন ইয়েমেন ইরানের মত রাষ্ট্রগুলি। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয়েছে চাপা উত্তেজনা, এর ফলে আর কত ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে আগামীদিনে তা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করবে। এরপরেও কি আমরা প্রশ্ন করব না, আধুনিক উন্নয়নশীল বিশ্বের বুলি আওড়ানো বিশ্ব রাজনীতির মোড়লদের! যে, ইজরায়েলের এই গনহত্যায় ন্যায় সংগত ‘স্বাধীন প্যলেস্টাইন’ এর স্বপ্ন দেখা আর কত সাধারণ নাগরিক মৃত্যুর মিছিলে সামিল হবে!আর কত শিশুর প্রাণ থেকে শৈশব শেষ হবে! আর কবে প্যালেস্তাইনের সাধারণ নাগরিকেরা পাবে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি?