• facebook
  • twitter
Saturday, 19 October, 2024

ছোট্ট ছুটিতে বেনারস

বেনারস বললেই বাঙালির মানসপটে ভেসে ওঠে ফেলুদা, জটায়ু আর মগনলাল মেঘরাজের মুখ। বাঙালির সঙ্গে বেনারসের সম্পর্ক এমনই ওতপ্রোতভাবে জুড়ে রয়েছে। বায়োস্কোপের বেনারসের বাইরেও কিন্তু এ শহরের আলাদা চার্ম। লিখছেন শঙ্খজিৎ বিশ্বাস।

বারাণসীর প্রাচীন গলিগুলো যদি এর হৃদয় হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে এই শহরের আত্মা হল এর ঘাট। নদীবক্ষে ভ্রমণই হোক বা মন্দির দর্শন, সময় কীভাবে কেটে যাবে এখানে, তা ঠাওর করতে পারবেন না। আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং রসনার এক অনন্য সংমিশ্রণ রয়েছে এই শহরে। কী বারাণসী বা বেনারসকে একটি অনন্য শহর করে তোলে এবং কেন এটি আপনার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করতে পারে, তা খুঁজতেই যাওয়া।

মন্দিরের শহর বেনারস। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি শতাব্দী-প্রাচীন মন্দির রয়েছে এখানে। কাশীর নামকরা মন্দিরের তালিকায় রয়েছে – অন্নপূর্ণা মন্দির, কালভৈরব মন্দির। সারা বছরই বেনারসে ঘোরা যায়, তবে গরমকালে রোদের তীব্রতা কিছুটা বেশি থাকায়, বছরের অন্যান্য সময়ে বেনারসে বেশি ভিড় করেন পর্যটকেরা।

এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, বিভিন্ন পুজো বা বিশেষ তিথিতে বেনারসের মন্দিরগুলিতে ভিড় উপচে পড়ে। সেই সব দিনে বাবা বিশ্বনাথকে দর্শন বা পুজো দিতে হলে বেশ খানিকটা সময় হাতে নিয়ে বেরোবেন।

দু-তিন দিনের ছুটিতে বেড়ানোর জন্য বেনারস কিন্তু আদর্শ জায়গা। ঘুরে দেখতে পারেন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি, বিএইচইউ-এর ক্যাম্পাসের বিশ্বনাথ মন্দির, সারনাথ, দুর্গা মন্দির, ত্রিদেব মন্দির, তুলসীদাস মন্দির, রামগড় ফোর্ট ইত্যাদি।

রাতে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে পরের দিন সকালে পৌঁছে যেতে পারেন বেনারস। এরপর স্টেশন থেকে অটো নিয়ে সোজা চলে যান হোটেলে। স্টেশনে প্রিপেড কাউন্টার থেকে অটো বুক করবেন। সেক্ষেত্রে আপনার ভাড়া কিছুটা কম পড়বে। হোটেলে ব্যাগপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ুন খেতে। বেনারসে খাবারের অসংখ্য হোটেল রয়েছে, সেখানেই লাঞ্চ সেরে হোটেলে গিয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিন।

এরপর বিকেলে বেরিয়ে পড়ুন আরতি দেখতে। বেনারসের অবশ্য দ্রষ্টব্য হল- গঙ্গা আরতি। সন্ধ্যেবেলা গঙ্গা আরতি হলেও বিকেল থেকেই দশাশ্বমেধ ঘাটে ভিড় জমান পর্যটকরা। আপনি যেমন ঘাটে বসে আরতি দেখতে পারেন, ঠিক তেমনই লঞ্চ বা ক্রুজ থেকেও এই আরতি দেখতে পারেন। দেড় ঘণ্টার ক্রুজ সফরে গঙ্গার সমস্ত ঘাট ঘুরিয়ে দেখানোর পাশাপাশি, দশাশ্বমেধ ঘাটের আরতিও দেখানো হবে। এছাড়া আপনাকে বিনামূল্যে চা এবং কুকিজ দেওয়া হবে।

এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, এই সমস্ত ক্রুজের টিকিটের খুবই চাহিদা রয়েছে। বেশিরভাগ দিন চারটি ক্রুজ চলে, তবে অফ সিজনে চাহিদা কম থাকলে অনেক সময় তিনটি ক্রুজও চলে। ৭০০ টাকা থেকে ভাড়া শুরু হয়, সর্বোচ্চ ভাড়া ১০০০ টাকা। ইন্টারনেটে আপনি বেনারস ক্রুজ বুকিং লিখে সার্চ করলেই বুকিংয়ের যাবতীয় তথ্য পেয়ে যাবেন। নমো ঘাট থেকে ক্রুজ সফর শুরু হবে। সেখান থেকে সমস্ত ঘাট ঘুরিয়ে আপনাকে ফের নমো ঘাটেই নামিয়ে দেবে ক্রুজ। চাইলে ঘাটে প্রদীপ ভাসাতে পারেন। এখানকার ঝালমুড়িও বেশ ভালো।

এরপর ঘাট থেকে অটো নিয়ে সোজা চলে আসুন গোদালিয়া চকে। বেনারসের সুস্বাদু খাবার খেয়েই গোটা একটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দেওয়া যায়। পরদিন ভোরে উঠে সোজা চলে আসুন কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে। লাইন দিয়ে মন্দির দর্শন করতে পারেন বা চাইলে আগে থেকে সুগম দর্শনের টিকিট কেটে রাখতে পারেন। মূল্য জনপ্রতি ৩০০ টাকা।

এই সুগম দর্শনের ভিড় প্রায় হয় না বললেই চলে। বিভিন্ন স্লটে এই সুগম দর্শন করা যায়। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকেই দর্শনের টিকিট পাওয়া যায়। এছাড়া টিকিট কেটে আপনি আরতি দর্শন করতে পারেন, রুদ্রাভিষেক করতে পারেন। মন্দিরের ভিতরে বিনামূল্যে জুতো-জমা রাখার ব্যবস্থা আছে। মন্দির ট্রাস্টের অফিসেও ব্যাগ রাখার ব্যবস্থা আছে।

সুগম দর্শন বুক করলে সবার প্রথমে আপনাকে মন্দির ট্রাস্টের অফিসে যেতে হবে। সেখান থেকে আপনাকে একজন পুরোহিত নিতে হবে। ওই পুরোহিতই আপনাকে দর্শনে সাহায্য করবেন। দর্শন হয়ে যাওয়ার পর সোজা চলে আসুন মন্দির ট্রাস্টের অফিসে। প্রতি টিকিট পিছু আপনাকে একটি করে প্রসাদের প্যাকেট দেওয়া হবে।

আপনার অতিরিক্ত প্রসাদ দরকার হলে মন্দির ট্রাস্টের অফিস থেকেই সামান্য পয়সার বিনিময়ে কিনে নিতে পারেন। ট্রাস্টের নিজস্ব দোকানে রকমারি জিনিসও মেলে। দাম কিছুটা চড়া হলেও কোয়ালিটি বেশ ভালো। মন্দির চত্বরে খাবার জল থেকে শুরু করে শৌচালয়- সবই রয়েছে।

সকাল সকাল পুজো দেওয়ার পর আপনি মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে জলখাবার খেয়ে নিন। এরপর চলে আসুন অন্নপূর্ণা মন্দিরে। এই মন্দিরে দিবারাত্র খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সকালে জলখাবার, দুপুরে লাঞ্চ এবং রাতে ডিনারের ব্যবস্থা রয়েছে। চেয়ার টেবিলে বসে খাওয়ানো হয়। খাবারের স্বাদ খুব ভালো। আপনি চাইলে সামান্য কিছু টাকা দানও করতে পারেন, তবে খাওয়ার জন্য কোনও টাকা-পয়সা নেওয়া হয় না।

অন্নপূর্ণা মন্দির দর্শনের পর বাইরে বেরিয়ে অটো নিয়ে নিন। এই অটোই আপনাকে বেনারসের অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান ঘুরিয়ে দেখাবে। সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যেবেলা চলে আসুন গোদালিয়া চকে।

মন্দিরের শহর বারাণসীতে চেখে দেখার মতো প্রচুর খাবার রয়েছে। বারাণসীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হল চাট। সন্ধ্যেবেলা হাঁটতে বেরিয়ে চেখে দেখতে পারেন রকমারি সব চাট। টম্যাটো চাট, আলু টিকিয়া চাট, দই ফুচকা অবশ্যই চেখে দেখুন। বেনারসের মিষ্টিও বেশ বিখ্যাত এখানকার অলিতে গলিতে ছোটখাটো মিষ্টির দোকান রয়েছে। প্যাঁড়া, সন্দেশ থেকে শুরু করে রসগোল্লা, রাবড়ি সবই মেলে। বেনারসের লস্যি না খেলে আপনি বিরাট মিস করবেন। সেই সঙ্গে বেনারসি পান তো রয়েইছে। শুধুমাত্র খাবার জন্য বেনারসে একটা দিন হাতে রাখতেই পারেন।

পরের দিন হোটেল থেকে চেক আউট করে অটো বুক করে চলে যান সারনাথ। বেনারস থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সারনাথ, গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত। সারনাথ ভালোভাবে বেড়াতে কয়েক ঘণ্টা লাগবে। অটোওয়ালাকে বলুন সারনাথ ঘোরা হয়ে গেলে আপনাকে বারাণসী স্টেশনে নামিয়ে দিতে। দুপুর থেকে শুরু করে রাত অবধি, বেশ কয়েকটি ট্রেন বেনারস থেকে হাওড়া আসে। এক্ষেত্রেও সবচেয়ে ভালো ট্রেন বিভূতি এক্সপ্রেস। বেনারস থেকেই এই ট্রেনটি ছাড়ে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা ৫-এ এবং পরদিন সকাল ৭টা ৪০-এ হাওড়া পৌঁছে যায়।

কীভাবে যাবেন

রেলপথে হাওড়ার সঙ্গে খুব ভালোভাবে সংযুক্ত রয়েছে উত্তরপ্রদেশে বারাণসী জংশন। মোট তিনটি স্টেশন রয়েছে বারাণসীতে। মূল স্টেশনটির নাম বারাণসী জংশন। এটি বারাণসী ক্যান্টনমেন্ট নামেও পরিচিত। এছাড়া রয়েছে বারাণসী সিটি এবং কাশী স্টেশন।
হাওড়া থেকে বারাণসী যাওয়ার সুবিধাজনক ট্রেন বিভূতি এক্সপ্রেস। এই ট্রেনটি প্রত্যেকদিন রাত ৮টায় ছেড়ে, পরের দিন সকাল সাড়ে ৯টায় বারাণসীতে পৌঁছোয়। এছাড়াও দুন এক্সপ্রেস, হিমগিরি এক্সপ্রেস, হাওড়া অমৃতসর মেল, শিয়ালদা জম্মু তাওয়াই, হামসফর এক্সপ্রেস, দুর্গিয়ানা এক্সপ্রেসে চড়ে আপনি কলকাতা, হাওড়া বা শালিমার থেকে বারাণসী পৌঁছোতে পারেন।

কোথায় থাকবেন

অন্যান্য ধর্মস্থানের মতো বারাণসীতে থাকার প্রচুর হোটেল রয়েছে। বিলাসবহুল হোটেল থেকে শুরু করে সাধারণ ধর্মশালা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বারাণসীর অলিতে গলিতে। থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা গোদালিয়া চক। এই চৌমাথার সঙ্গে বেনারসের সমস্ত রাস্তা যুক্ত রয়েছে, সেই কারণে গোদালিয়া চক লাগোয়া হোটেলগুলির ভাড়া বেশ চড়া। কয়েক বছর ধরেই বারাণসীর আনাচে-কানাচে প্রচুর হোম স্টে তৈরি হয়েছে। মন্দির থেকে এক দেড় কিলোমিটারের মধ্যে বেশ কিছু হোম স্টে রয়েছে। অনলাইন হোটেল বুকিং সাইটগুলিতেই এইসব হোম স্টের হদিশ মেলে৷