এটি একটি শ্লোক তার অর্ধেক দিয়ে শিরোনা গৌরীর শরণ্যে কারা আসবে তা ভীষণভাবে শক্ত ব্যাপার। গৌরী আসছে সুদূর হিমালয় থেকে নিজ পিতৃগৃহে। ত্রম্বকে গৌরী কথার অর্থ। পরম পূজনীয় আদরণীয় কন্যা। আমাদের কাছে এসো তোমার পরিচর্যায় আমার উদগ্রীব তোমার সেবা করাই আমাদের কর্তব্য, তোমার সুখ ও আরাম প্রদানের দিকে আমাদের যাতে সজাগ দৃষ্টি থাকে। তাই তোমার শরণ্যে সমস্ত মা, বাবা, ভক্ত ও সন্তানরা অপেক্ষারত।
আপামর জনসাধারণ কখনও তাঁকে মা দুর্গা হিসেবে দেখছেন কখনও কন্যা রূপে। যার যেরূপ ভাব তার কাছে ঈশ্বরের প্রকাশ সেরূপ। তাই ভক্তের দল দু’ভাগে বিভক্ত। যারা চাওয়া-পাওয়ায় বিশ্বাসী তারা জানে মা আসছেন সুদূর হিমালয় থেকে বাপের বাড়ি, যা নিয়ে আসছেন তা যেন তিনি তার লোভী ভক্তদের দিয়ে যেতে পারেন। দাও দাও দাও খালি দিয়ে যাও মা তাই যশোং দেরি, পুত্রং দেহি, ধনং দেরি রূপং দেহি। কী করে মা আমাদের পেট ভরবে সেদিকে খেয়াল রাখিস মা। নইলে তো আমরা পথে বসবো। আমার আরও টাকা চাই, গাড়ি চাই, বাড়ি চাই সব সময়ে রসে বসে থাকতে চাই মা। কৃপা কর। এরা হল ধনী, মধ্যবিত্ত উচ্চ শ্রেণির ধনী, সমাজের স্বনামধন্য ব্যক্তি সব বড় ভক্তের। এই পূজার চারদিন আকণ্ঠ সুরা ভোগ, সুস্বাদু খাদ্য ভোজন করে তোর আরাধনায় মত্ত থাকবো মা রে মা।
আর এক শ্রেণির ভক্ত যারা মাকে কন্যা রূপে দেখে অর্থাৎ মেয়ে শ্বশুরবাড়ি তেকে বাপের বাড়িতে এলে কীভাবে তার আদর যত্ন করবে, তাতেই তারা ব্যস্ত থাকে, যাতে মেয়ের যত্নের কোনও ত্রুটি না ঘটে। যার যা সামর্থ, কাপড়, আলদা, সিঁদুর, ফল, মিষ্টি, সাজাবার প্রসাধনী সামগ্রী, কুমারী মেয়ের যা যা প্রয়োজন তা দিতে মাকে যাতে এই চারটি দিন মেয়ে যত্ন, আদর থেকে বঞ্চিত না হয়। এই আর এক শ্রেণির ভক্ত। কেননা দুর্গাপূজা মূলত ‘নবরাত্রি ব্রত’ এই শ্রেণির ভক্তরা নিয়মনিষ্ঠা ও সংযমের মধ্যে থেকে দেবী আরাধনায় ব্রতী হয়। মাকে কন্যারূপে পেয়ে শেষের দিনে চোখের জলে বিদায় দিয়ে আগামী বৎসর াসার যে কাতর প্রার্থনা জানায় মাও পিতার বিষণ্ণ মুখেই তা ফুটে ওঠে, কন্যার মুখ হয়ে ওঠে দুঃখে পরিপূর্ণ আবার তাকে ফিরে যেতে হবে শ্বশুরালয়ে। আবার দীর্ঘ প্রতীক্ষা বাস্তবের সঙ্গে বড় মিল একথা অনস্বীকার্য।
স্মরণ মাত্রই তিনি কৃপা করেন। তাঁর কৃপাতেই তাঁকে জানা যায়। দুর্গম স্বার্থান্ধকেরে ডুবে জীব অশেষ দুর্গতি ভোগ করে। জীবের এই অহিতকারী বুদ্ধি দূরকরে তাকে কল্যাণকর নিঃস্বার্থ বুদ্ধিদান করে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। আবার অজ্ঞান অবিদ্যার অধীন হয়ে জীব মায়ার বাঁধনে বাধা পড়ে সংসারচক্রে ঘুরপাক খায়। জ্ঞান অসি দিয়ে ত্রিতাপ ও সত্ত্বাদি ত্রিগুণজাতা অবিদ্যা বন্ধন ছেদন করে মা দুর্গা সন্তানদের মোহভ্রান্তি নাশ করেন— তাই তিনি দুর্গা। তন্ত্রশাস্ত্রে জগন্মাতা দুর্গার রহস্যকে জানাই হল আত্মদর্শন। আত্মদর্শনই হল নিজেকে জানা ও চেনার উপায়, যাকে আধ্যাত্মবিদ্যা বলা হয়। আধ্যাত্মবিদ্যাই হল বেদ। বেদের আত্মতত্ত্ব ব্রহ্মকেই তন্ত্রে আদর করে নাম দিয়েছে ব্রহ্মস্বরূপিনী মহামায়া। হিরন্ময় পাত্রের আচ্ছাদনের যে সত্য মুখটি আবৃত হয়ে আছে, আত্মসাক্ষাৎকারের দ্বা সেটিকে অনাবৃত করে নিজেকে ব্রহ্মরূপে প্রতিষ্ঠিত করাই হল বেদ ও তন্ত্রের সারকথা। তাই ঋকবেদে অস্তৃর্ণ ঋষির কন্যা বাগদেবী ব্রহ্মস্বরূপা হয়েছেন এবং নিজেকে ব্রহ্মভাবে বিভাবিত হয়ে নিজেই অনুভব করে বলেছেন যে, আমি ব্রহ্মস্বরূপিনী। ঋকবেদ এই ভাবটিকে ‘দেবীসূক্ত’ বলা হয়। দেবীসূক্তেই নিহিত আছে আমাদের দুর্গতি বিনাশের উপায়।
‘বেদে যিনি অদিতি, গৌরী, ঊষা, আয়তি; উপনিষদে যিনি উমা, হৈমবতী, কাত্যায়নী ও কন্যাকুমারী; পুরাণে তিনিই আবার ‘দুর্গা দুর্গতিনাশিনী’। তাই ঋষি উপদেশ দিয়েছেন— ‘তমুপৈহি মহারাজ শরং পরমেশ্বরীম। / আরাধিতা সৈব নৃণাং ভোগস্বররগাপবর্গদা।’ (চণ্ডী, ১৩/৪-৫)
হে মহারাজ, সেই পরমেশ্বরী শরণ লও, যিনি আরাধিতা হলে জনগণকে ভোগ, স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন। রাজা সুরথ দেীর কাছে বর চাইলেন— রাজ্য সুখ ও বিষয় ভোগ। আর বৈশ্য চাইলেন— জ্ঞান, বিবেক, বৈরাগ্য। রাজা পেলেন ভূক্তি আর বৈশ্য পেলেন মুক্তি। ভূক্তি ও মুক্তি ছাড়াও জগৎ জননী আরো একটি পরম সম্পদ প্রদান করেন। তা হল বিষ্ণু ভক্তি— ‘সুখদা মোক্ষদা দেবী বিষ্ণুভক্তিপ্রদায়িনী।’ যার যা অভাব এবং তার জন্য যা আর্তি, তা মহাদেবী দূর করেন। দেবগণ তাই মহাদেবী দুর্গার স্তবে যথার্থই বলেছেন— ‘শরণাগত দীনার্ত্ত পরিত্রাণ পরায়ণে। / সর্বস্যার্ত্তিহরে দেবী নারায়ণী নমোহসস্তুতে।।’ (চণ্ডী,১১/১২)