• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

দেশের মত গ্রাম ও ক্ষেত্র আছে, তাহা আমি এই প্রথম জানিতে পারিলাম। আর ঝাঁপান যাইবার পথ নাই। আমরা এখন পার্ব্বতীয় লাঠি ধরিয়া ধীরে ধীরে সেই জল-প্রপাতের নিকটে শিলাতলে উপস্থিত হইলাম।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ইহা সেই করুণাময়েরই নিশ্বাস। চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে দেখি যে, আমার বাসার সংলগ্ন জলাশয়ে কোথা হইতে অপ্সররা আসিয়া রাজহংসীর ন্যায় উল্লাসের কোলাহলে জলক্রীড়া করিতেছে। এমনি করিয়া চকিতের মধ্যে সুখে কালস্রোত চলিয়া গেল।

বৈশাখ মাস আসিয়া পড়িল। তখন সূর্য্যের তাপ অনুভব করিলাম। দোতালায় থাকিতাম, একতলায় নামিয়া আইলাম। দুই দিন পরে সেখানেও সূর্য্যের তাপ প্রবেশ করিল। বাড়ীওয়ালাকে বলিলাম, ‘আমি আর এখানে থাকিতে পারি না; ক্রমে উত্তাপ বাড়িতেছে, আমি এখান হইতে চলিয়া যাইব।’ সে বলিল, ‘নীচে তয়খানা আছে; গ্রীষ্মকালে সেখআনে বড় আরাম।’ আমি এত দিনে জানিতাম না যে, ইহার মাটির নীচে আবার ঘর আছে। আমাকে সেই মাটির নীচে লইয়া গেল। সেই নীচে ঠিক তাহার উপরের একতালার মত ঘর, পাশ দিয়া আলোক ও বাতাস আসিতেছে। সে ঘর খুব শীতল। কিন্তু আমার সেখানে থাকিতে পছন্দ হইল না। মাটির ভিতরে ঘরের মধ্যে বন্দীর ন্যায় থাকিতে পারিব না।

আমি চাই মুক্ত বায়ু, প্রমুক্ত গৃহ। আমাকে একজন শিখ বলিল যে, ‘তবে সিমলা পাহাড়ে যান, সে বড় ঠাণ্ডা জায়গা।’ আমি তাহাই আমার মনের অনুকূল স্থান ভাবিয়া ১৭৭৯ শকের ৯ই বৈশাখে সিমলার অভিমুখে প্রস্থান করিলাম।
তিন দিনের পথ অতিক্রম করিয়া, পঞ্জৌর ছাড়াইয়া ১২ই বৈশাখে কালকা নামক উপত্যকায় আসিয়া পঁহুছিলাম। দেখি যে, সম্মুখে পর্ব্বত বাধা দিয়া রহিয়াছে। আমার নিকটে অদ্য ইহার নূতন মনোহর দৃশ্য বিকশিত হইল। আমি আনন্দে ভাবিতে লাগিলাম যে, ‘কাল আমি ইহার উপরে উঠিব, পৃথিবী ছাড়িয়া স্বর্গের প্রথম সোপানে আরোহণ করিব।’ এই আনন্দে সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম। সুখে নিদ্রা হইল, পথের পরিশ্রম দূর হইল।
(১৮৫৭, এপ্রিল, মে)

কিন্তু বৈশাখ মাসের অর্দ্ধেক চলিয়া গেল। আমি ১৬ই বৈশাখের প্রাতঃকালে একটা ঝাঁপান লইয়া পথ ঘুরিয়া ঘুরিয়া পর্ব্বতে উঠিতে আরম্ভ করিলাম। যত উচ্চ পর্ব্বতে উঠি, ততই আমার মন উচ্চ হইতে লাগিল। উঠিতে উঠিতে দেখি যে, আবার আমাকে লইয়া অবতরণ করিতেছে। আমি চাই ক্রমিক উঠিতে, আর এরা আবার আমাকে নামায় কেন? কিন্তু ঝাঁপানীরা আমাকে একেবারে খদে, একটা নদীর ধারে গিয়া নামাইল। সম্মুখে আবার আর একটা উচ্চতর পর্ব্বত; তাহার পাদদেশে এই ক্ষুদ্র নদী। এখন বেলা দুই প্রহর। তখনকার প্রখর রৌদ্রে নিম্ন পর্ব্বত উত্তপ্ত হইয়া আমাকে বড়ই পীড়িত করিল। সমভূমির উত্তাপ বরং সহ্য হয়, আমার এ উত্তাপ অসহ্য হইল। এখানে একটি ছোট মুদির দোকান, তাহাতে বিক্রয়ের জন্য মক্কার খই রহিয়াছে; আমার বোধ হইল, এই রৌদ্রে মক্কা আপনিই খই হইয়া গিয়াছে। সেই নদীর ধারে আমাদের রান্না ও আহার হইল। আমরা নদী পার হইয়া এখন আবার সম্মুখের পর্ব্বতে উঠিতে লাগিলাম, এবং শীতল স্থান প্রাপ্ত হইলাম। হরিপুর নামক একটা স্থানে রাত্রি যাপন করিলাম।

পরদিন সকালে চলিতে আরম্ভ করিয়া মধ্যাহ্নে একটা বৃক্ষতলে আহার করিয়া সন্ধ্যার সময়ে সিমলার বাজারে উপস্থিত হইলাম। আমার ঝাঁপান বাজারেই রহিল। দোকানদারেরা আমার প্রতি হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল। আমি ঝাঁপান হইতে উঠিয়া দোকানে তাহাদের জিনিষ পত্র দেখিতে লাগিলাম। আমার সঙ্গী কিশোরীনাথ চাটুয্যে বাসার অনুসন্ধানে চলিয়া গেল, এবং সেই বাজারেই এক বাসা স্থির করিয়া শীঘ্রই আমাকে সেখানে লইয়া গেল। সেইখানে আর এক বৎসর কাটিয়া গেল।

অনেক বাঙ্গালীর সেখানে কর্ম্ম কাজ; তাহারা অনেকে আমার সঙ্গে দেখা করিতে আইল। প্যারীমোহন বাঁড়ুয্যা প্রত্যহ আমার সংবাদ লইতে আসিতেন। তিনি সেখানে ইংরাজের একটা দোকানে কর্ম্ম করিতেন। তিনি এক দিন আমাকে বলিলেন যে, ‘এখানে একটি বড় সুন্দর জলপ্রপাত আছে, যদি আপনি যান তো আপনাকে তাহা দেখাইয়া আনিতে পারি।’ তাঁহার সঙ্গে আমি খদে নামিয়া দেখিতে গেলাম। খদের নীচে যাইতে যাইতে দেখি যে, মধ্যে মধ্যে সেখানে লোকের বসতি, মধ্যে মধ্যে শস্যক্ষেত্র। কোন খানে গোরু মহিষ চরিতেছে, কোন খানে পার্ব্বতীয় মহিলারা ধান ঝাড়িতেছে। আমি ইহা দেখিয়া আশ্চর্য্য হইলাম। এখানেও দেশের মত গ্রাম ও ক্ষেত্র আছে, তাহা আমি এই প্রথম জানিতে পারিলাম। আর ঝাঁপান যাইবার পথ নাই। আমরা এখন পার্ব্বতীয় লাঠি ধরিয়া ধীরে ধীরে সেই জল-প্রপাতের নিকটে শিলাতলে উপস্থিত হইলাম। এখানে তিন শত হস্ত ঊর্দ্ধ হইতে জলধারা পড়িতেছে, এবং প্রস্তরের উপরে প্রতিঘাত পাইয়া রাশি রাশি ফেনা উদগীরণ করিতেছে, এবং বেগে স্রোত নিম্নমুখে ধাবিত হইতেছে।
(ক্রমশ)