• facebook
  • twitter
Sunday, 22 December, 2024

উৎসবের রাত দখল ও অন্যান্য

আরজি কর কাণ্ডে শাসকের লোকলজ্জাও যেন উধাও। তাই যে কোনও অঞ্চলের মনসবদারি ব্যবস্থার অত্যাচারের ছবিটিকে গোটা রাজ্যের, গোটা দেশের সামনে প্রকট করে তোলাই এখন কাজ।

যাঁর যায়, তাঁরই যায়, আমরা শুধু কিছুটা অনুভব করার চেষ্টা করতে পারি মাত্র,কথাটা সত্যি। কিন্তু এ বার যে বৃদ্ধ নাকে অক্সিজেনের নল নিয়ে অটোতে এলেন প্রতিবাদ মিছিলে, যে প্রবীণা হুইলচেয়ারে বসে স্লোগান দিলেন, যে বয়স্ক দম্পতি লাঠিতে ভর দিয়ে নিজের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে মোমবাতি ধরলেন সামনে দিয়ে যাওয়া মিছিলের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে নিজেদের, যে অসংখ্য তরুণতরুণী ‘আমার দিদির বিচার চাই’ বলে ধ্বনি তুলে চলেছে, যে সব মানুষ খাবার জোগালেন, পাখা দিয়ে হাওয়া করে গেলেন আন্দোলনকারীদের, শুধু এই পুজোয় নয়, আগামী অনেক পুজো ধরেই তাঁরা বহন করে চলবেন সেই মুখ, সেই বেদনা, বিচারের দাবি। গাছ থেকে টুপ করে শিউলি খসে পড়লে তাঁদের মনে হবে সে নেই।

তবে এ লেখা তাঁদের নিয়ে নয়। এ লেখা তাঁদের নিয়ে, যাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এই পরিস্থিতিতে উৎসবে ফিরতে বলার মানসিকতা দেখান, সন্তান হারানোর দু’দিনের মধ্যে টাকার কথা বলতে যাঁদের বাধে না। এই লেখা সেই বরিষ্ট সাংবাদিকের জন্য যিনি আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের নিয়ে ব্যঙ্গ করেন, এ লেখা তাঁদের নিয়ে যাঁরা উৎসব দ্বিগুণ করে দেব বলে চ্যালেঞ্জ ছোড়েন। শুধু মাত্র মানুষের ভোটে জিতে এই স্পর্ধা আসে কি? না,এই সাহস আসে মানুষের দুর্দশা, মানুষের দেহ, মানুষের বিপর্যয় নিয়ে রাজনীতি করার এবং সাফল্য পাওয়ার সাহস থেকে। নির্বাচনী পাটিগণিতে আসনসংখ্যাই শুধু সাফল্য হতে পারে না। দোর্দণ্ডপ্রতাপ আমেরিকা ইরাকে যে ‘শক অ্যান্ড অ’, যে ভয় ছড়ানোর নীতি নিয়ে এগিয়ে লেজেগোবরে হল, সেই নীতি কোনও জায়গাতেই সফল হতে পারে না, হয়নি কোনও দিন। দেশ, রাজ্য, কোথাও না।

মানুষের মন বড় ভয়ঙ্কর বস্তু। এক বার সরে গেলে আর ফেরে না। বিশেষত আর জি করের ঘটনা নিয়ে যে অসংবেদনশীলতা, যে ক্ষমতার দম্ভ এবং সব কিছু কার্পেটের তলায় ঢুকিয়ে দেওয়ার যে মরিয়া মানসিকতা প্রশাসন এবং শাসক দলের মধ্যে দেখা গিয়েছে, তার পর তাদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, এই দম্ভ আমরা শিখ-দাঙ্গার সময়ে দেখেছি, ‘মহীরুহের পতন হলে চার পাশ কাঁপবেই’ জাতীয় মন্তব্যে, গুজরাতে দেখেছি,শুনেছি ‘একটি কুকুর ছানা গাড়ি চাপা পড়লেও আমার মন কাঁদে’,আবার সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটের ফলাফলও দেখেছি। শুনেছি, ‘এ রকম তো হয়েই থাকে’। এ-ও দেখছি, ‘তাজা নেতা’, ‘ছোট ছেলেরা করে ফেলেছে’, ‘সাজানো ঘটনা’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলার মানসিকতা যা এখন প্রায় রাজ্য-সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহিলাদের সম্মান দেওয়ার বিষয়ে শাসক কিংবা বিরোধী নেতানেত্রীরা প্রায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই চলেন, তফাত শুধু তোমার রাজ্য, আমার রাজ্যে।সেই স্পর্ধাকে জবাব দেওয়ার সাহস কি এই দুর্গাপুজোয় দেখাতে পারব আমরা? উত্তর এককথায় – না।

তৃতীয়া,চতুর্থী রাতের রাস্তায় মানুষের ঢল প্রমাণ করেছে যে ধনগর্বী, সোনার গয়না পরা নেতাদের টাকা ছড়ানো প্যান্ডেলের আকর্ষণ, ধর্মতলার মঞ্চে কয়েকটা অনশনরত ছেলে মেয়ের দিকে তাকানোর থেকে অনেক বেশি। পুজো কমিটিগুলো এবার আর কোনও রিস্ক নিতে রাজি নয় তাই দিনরাত তারা জারি রাখছে লাউডস্পিকারের গর্জন, ভুলেও যেন সেখানে শোনা না যায়— আর কবে? আর কবে? আর কবে? দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত পাড়ায় এবার থিম বস্তি বাড়ি।একে কি বলা উচিত,ভাবনার দৈন্য, না দৈন্যের ভাবনা? সম্মিলিত যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, বড় এবং ছোট ছোট করে হয়েই চলেছে প্রতিদিন, তা কিন্তু শাসকের মনে এমন ভয় ঢোকাতে পারনি যাতে প্রতিমার চক্ষুদান করতে গিয়ে মনে হয়, ওই অত্যাচারিত মেয়েটি তাকিয়ে রয়েছে সোজাসুজি শাসকের চোখে,কিংবা প্রতিমার মুখের আবরণ সরাতে গিয়ে তাঁরা দেখতে পাবেন সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে মণ্ডপ জুড়ে। না তেমনটা হয়নি। প্রদীপের আলোকে মনে হয়নি আগুন, ঢাকের শব্দকে মনে হচ্ছে না বিচারের দাবি? দর্পণ বিসর্জনের সময়ে মনে হবে কি দর্পণ থেকে আমার বিবেক আমাকে প্রশ্ন করছে, ‘কী করেছ তুমি এত দিন’?

না না, হালায় এসব সেন্টিমেন্টাল দিয়া লাভ নাই, এসব দিয়া বাঙালির বাচ্চার রক্তের তেজকে দাবায়ে রাখা যাবে না। সারা রাজ্যে যখন উৎসবের রঙমশাল জ্বলছে সেখানে দুচার জন কি বলল, কি লিখল তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। তবে ওই যে যুদ্ধে একজন বিপরীতে লড়েছিল, এটা বলার জন্যও যুদ্ধের ময়দানে থাকতে হয়। নির্মম, নিরন্ধ্র পরাজয় মেনেও থাকতে হয়। তবে হ্যাঁ,পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি থেকে আর জি কর,শাসকের শরীর আর শাসকের তথাকথিত বিবেকের মধ্যে চিরকাল শুয়ে থাকবেন সেই মধ্যবর্তিনীরা। আর রাতের অন্ধকারে নিজের কাছে চমকে উঠে টিনের তলোয়ার নাটকের সেই সংলাপের মত বলতে হবে, ‘ও কে? ও কে গো?’ তাঁদের জেনে রাখতে হবে – “পাপ কি কখনও ছাই চাপা থাকে? যাকে ভাব মৃত, মুক,বধির হঠাৎ তার অবিনশ্বর আত্মা চিৎকার করে বলে,আমায় খুন করেছে,প্রতিশোধ চাই”।

এই গ্রামবাংলার এক অশীতিপর মৃৎশিল্পী কাঁপা হাতে তুলি নিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরায় বলেছেন, ‘মূর্তি গড়ছি আর হাত কাঁপছে, কী মুখ গড়ব? মেয়েটার কথা মনে হচ্ছে।’ নির্যাতিতার এক ‘পেশেন্ট’ টেলিভিশন চ্যানেলের সামনে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে বলেছেন, ‘যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস মা’। এই অনুভব, এই অশ্রু নিখাদ।কিন্তু মুখে ‘মা’ বলে অত্যাচারের নিদর্শন বিদ্যমান গোটা সমাজেই। সে সমাজে ‘আর জি কর করে দেব’ শব্দবন্ধ ছড়িয়ে যায় এই প্রতিবাদের পরেও। শোনা যায় ‘চুড়ি পরে বসে থাকুন’ লব্জ। ছাড় পায় না কয়েক মাসের,নয় বছরের কন্যা। সেখানে মেয়ে বলে মুখে সন্দেশ দেওয়াই হোক, আর মা বলে আরতি করাই হোক, সেখানে ‘দেবী নাই’।

সম্মিলিত প্রতিবাদ সেই বাস্তব দেখিয়ে দিয়েছে নতুন করে, সুযোগ দিয়েছে টাকা ছড়ানোয় অভ্যস্ত শাসক আর সুযোগসন্ধানী বিরোধীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার যে জনগণ কারও দাস নয়। পেরিয়ে গেছে প্রায় দুমাসের বেশী বিনিদ্র রাত। নারকীয় নির্যাতন ও প্রাতিষ্ঠানিক খুনের বলি আমাদের সবার ঘরের “অভয়া” আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। প্রকৃত বিচারের আলো এখনো বহু ক্রোশ দূরে। অভয়ার পরিবারের শূন্যতা, আমাদের সব পরিবারে। একই সাথে পালন হোক শারদোৎসব, পাশে নিয়ে দ্রোহের উৎসবের মশালের দীপ্তি। দাবী থাকুক এক ও অভিন্ন। ‘অভয়ার প্রকৃত বিচার’। আসামি ও নেপথ্যের ষড়যন্ত্রীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। চাই না দেখতে কোনো দ্বিতীয় অভয়া। ফিরে আসুক মানবতার চেনা ছন্দ। বেআব্রু হোক দুর্নীতির ও হুমকি সংস্কৃতির এখনও অদেখা বহু স্তর। পুজোর দিনগুলোতে জ্বলতে থাকুক, স্মৃতির সম্মানে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ।মনের পাথর সরছে না কিছুতেই। ক্ষোভের আগুনও নেভবার নয় সহজে।

অথচ এবার মাটির প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা যেত একেবারে অন্য ভাবে। সেই মেয়েটি, সেই সব মেয়েরা যখন এসে দাঁড়িয়েছেন আমাদের সামনে। আমরা তাঁদের বরণ করে নেব না আমাদের হৃদয়ে? আমাদের বিবেকে?আপনারা কি কেউ কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেন না? শাসক কিংবা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না, ঘৃণা ছলকে উঠেছে মায়ের নয়নে?এই প্রগাঢ় অন্ধকারের মধ্যে একটি আলোর রেখা ছিল, রাজ্যের শাসকের শীত ঘুম যদি ভাঙা সম্ভব হয়, তবে সে কাজের একমাত্র আয়ুধ লোকলজ্জা। কিন্তু আরজি কর কাণ্ডে শাসকের লোকলজ্জাও যেন উধাও। তাই যে কোনও অঞ্চলের মনসবদারি ব্যবস্থার অত্যাচারের ছবিটিকে গোটা রাজ্যের, গোটা দেশের সামনে প্রকট করে তোলাই এখন কাজ। বারংবার। শাসককে বারে বারে প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে বাধ্য করাটাই এখন উপায়। সুশাসনের শর্তগুলিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যে ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার রক্ষা করা যায় না, এ কথাটি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে থাকা, যত ক্ষণ না বোধোদয় হয়।জুনিয়র ডাক্তার ও নাগরিক সমাজ এই মুহূর্তে সেটাই করছেন।