পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। বনেদিবাড়ি থেকে বারোয়ারি পুজো সর্বত্র প্রস্তুতি তুঙ্গে। সময় পাল্টেছে সময়ের নিয়মে। এখন বিভিন্ন জায়গায় বারোয়ারি এবং থিম পুজোর রমরমা চলছে। কিন্তু এরই মাঝে বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোগুলো আমাদের মন কেড়ে নেয়। একদা জমিদার ও সামন্ত প্রথার আতিশয্যে ভরপুর জমিদার বাড়িগুলো সময়ের দাপটে অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু। অধিকাংশই জীর্ণ ও শীর্ণ তবু এইসব বিশাল দালান, কড়ি বরগাস্থাপত্য ও সময়ের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
বনেদি বাড়ির পুজো দেখতে তাই চলে যেতেই পারেন জনাই। জনাই ও পাশ্ববর্তী গ্রাম বাকসা মিলে বেশ অনেকগুলি বনেদি বাড়ির আছে যেগুলো মধ্যে অন্যতম হল জনাই রাজবাড়ি, বাজারবাড়ি, গোলাবাড়ি, আদি মুখার্জীবাড়ি, মিত্রবাড়ি, মাঝেরবাড়ি, চৌধুরীবাড়ি, সিংহবাড়ি, পুরাতনবাড়ি, গাঙ্গুলিবাড়ি, ভট্টাচার্যবাড়ি, কর্তাবাড়ি, সিংহবাড়ি, কালীবাবুর বাড়ি, দ্বাদশ শিবমন্দির, বদ্যি মা মন্দির, কালীমন্দির ইত্যাদি। সব বাড়ির পূজোর রীতি-নীতিতে রয়েছে সহস্রাধিক বছরের প্রাচীনত্বের মেলবন্ধন। প্রতিটি বাড়ির কর্তা ব্যক্তিদের আতিথিয়েতা মন ভরিয়ে দেয়।
গত বছর নবমীর দিন আমরা গিয়েছিলাম জানাই, গরলগাছা আর বাকসার পুজো দেখতে। সকাল সকাল দমদম থেকে ট্রেনে করে ডানকুনি পৌঁছিয়ে স্টেশনের বাইরে থেকে অটো ধরে নিলাম আমরা। প্রথমেই এসে নামলাম বাবুদের বাড়ি বা গরলগাছা জমিদার বাড়ির সামনে। বাড়িতে প্রবেশ করতেই বাড়ির সৌন্দর্য দেখে মন ভরে গেল। বাড়িটায় ঢুকতেই মন যেন হারিয়ে গেছিল সেই জমিদারি, ব্রিটিশ আমলে। প্রথমেই মা মহামায়াকে দর্শন করে নিলাম। প্রায় ২৫০ বছর ধরে চলে আসছে এই পুজো। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব থেকে স্বয়ং রামপ্রসাদ সেনে স্মৃতিজড়িত এই বাড়ি। প্রথমে বাড়ির একতলা তারপর দোতলা। দেখে নিলাম ওনাদের প্রাচীন বৈঠকখানা। বাড়ির ছাদ থেকে সম্পূর্ণ বাড়িটার সৌন্দর্য অসাধারণ। বাড়ির পিছন দিকে রয়েছে একটি পুরোনো কুয়ো আর সামনে রয়েছে দুটো শিব মন্দির। ছাদের উপরেই আরও একটি পুরোনো ঘর আছে। কত যে ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে এই বাড়ীর দেওয়াল, কড়িকাঠে, ঘরে তো বলে শেষ করা যাবে না। বর্তমানে বাড়িটি বিভিন্ন শুটিং, বিয়েবাড়ি এসবের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়।
গরলগাছা বাবুদের বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা চন্ডীতলা হয়ে এসে পৌঁছলাম হুগলি জেলার জনাইতে। আভিজাত্য ও বনেদিয়ানায় মোড়া দুর্গাপুজোগুলোর মধ্যে জনাইয়ের দুর্গাপুজো অন্যতম। অতীতের মত আজও এখানে বেশ কিছু বনেদিবাড়িতে সব রকম নিয়মনিষ্ঠা পালন করে দুর্গাপুজো উদযাপন করা হয়। জানাইয়েন বিখ্যাত পুজোগুলোর কথা এবার বলব।
উমা ভিলা বা বাজারবাড়ি…
এই বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় উমাকান্ত মুখোপাধ্যায়। বাজার এলাকায় অবস্থিত বলে এই বাড়ির নাম বাজারবাড়ি। এই বাড়ির পুজো প্রায় পাঁচ পুরুষ ধরে চলে আসছে। অনেকে এটি লাল বাড়ি নামেও চেনেন। এই বাড়ির অভিনবত্ব ঝাড় লণ্ঠনের আলোয় পুজো হয়। তবে লণ্ঠনগুলি জ্বালানো হয় ষষ্ঠীর দিন। নবমীতে বলিপ্রথা প্রচলন রয়েছে এই বাড়িতে।
গোলাবাড়ি…
বাজারবাড়ির পিছনেই রয়েছে গোলাবাড়ি। এই বাড়ির পুজো প্রায় ৩৫০বছরের পুরোনো। শুধু দুর্গাপুজোই নয়, এই বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোও উদযাপিত হয়।
কালিবাবুর বাড়ি…
আনুমানিক ২০০-২৫০ বছরের পুরোনো এই বাড়ি, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রী কালিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পলাশির যুদ্ধের সময়। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও সবকটি বাড়ির মধ্যে আয়তনেও বৃহৎ এই বাড়িটি। তৎকালীন ব্রিটিশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল কালীবাবুর। কালীবাবু অনেকদিন ভাগলপুরের দেওয়ান হিসেবে ছিলেন, জন্মস্থান বেনারস। উনি জনাইতেই বসবাস করতেন। এলাকার শ্মশানের একটি অংশে রাজবাড়ি তৈরি করেন কালীপ্রসাদ। কথিত আছে, সাধনা করে এখানেই তিনি দেবী দুর্গার দর্শন পেয়েছিলেন। তারপরই শুরু করেছিলেন আরাধনা। সেই থেকে প্রথা মেনে বংশপরম্পরায় হয়ে আসছে পুজো। বাড়িটি ইন্দো-ক্যাথলিক স্থাপত্যের নিদর্শন। এই বাড়িতে দেবীকে কন্যা রূপে পুজো করা হয়। বৈষ্ণব মতে পুজো হয় বলে এই বাড়িতে কোনো আমিষ ভোগ দেওয়া হয়না। পরিবারের মতে এই বাড়িতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতন মহাপুরুষেরা। বহু বাংলা সিনেমার শুটিং হয়েছে এখানে। বৈষ্ণব মতে দুর্গা পুজো হয় এখানে। হয় না কোনও আমিষ ভোগ। রাজবাড়ির সদস্যদের পাশাপাশি, পুজোয় অংশ নেন এলাকার বাসিন্দারাও।
সিংহীবাড়ি…
এই বাড়ির পুজো প্রায় ৪০০বছরের পুরোনো। এই বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শান্তিরাম সিংহ। মহাভারতের বাংলা অনুবাদ যার হাত ধরে হয়েছিলো সেই কালীপ্রসন্ন সিংহের পৈতৃক বাড়ি এটা।
মিত্রবাড়ি…
এই বাড়ির পুজো আনুমানিক ৪৬৩ বছরের পুরোনো। এই বাড়ির পুর্বপুরুষ ছিলেন পরশুরাম মিত্র। পুজোর মধ্যে প্রতিদিনই এই বাড়িতে বলি হয়। বাড়ির উল্টোদিকেই রয়েছে একটি সুন্দর রাধাকৃষ্ণ মন্দির। এই বাড়ির ঠাকুর দালানেই মায়ের প্রতিমা গড়া হয়। উল্টোরথের আগের দিন শুরু হয় ঠাকুরের কাঠামো গড়ার কাজ। বিসর্জনের সময় বাড়ির দিকে মুখ করে ঠাকুরকে নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়।
চৌধুরীবাড়ি…
এই বাড়ির পুজো ২৭৫ বছরের পুরোনো। চৌধুরীবাড়ি প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল প্রকাণ্ড পূজার দালান, সম্মুখে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, সমস্ত প্রাঙ্গণটি চাঁদোয়ায় ঢাকা। স্বর্গীয় রূপ নারায়ণ চৌধুরী এই বাড়ির পুজো শুরু করেছিলেন। এই বাড়ির দুর্গা প্রতিমা চতুর্ভুজা এবং এখানে মায়ের প্রতিমার সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। জনাই গ্রামের উত্তর-পূর্বে এই বাকসা গ্রাম। এই এলাকায় রঘুনাথ জেউ নবরত্ন মন্দির, বারোটি শিব মন্দির এবং বদি মাতার (কালী) মন্দিরের গৌরব ও খ্যাতি আজও রয়েছে। জনশ্রুতি আছে ‘নিশিপদ্ম’ ছায়াছবিতে মান্না দের বিখ্যাত গানটি’ শুনেছি চৌধুরী বাড়িতে নাকি বসেছে আসর’ রচিত হয়েছিল এই চৌধুরী বাড়িকে ঘিরেই। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও ইন্দিরা গান্ধীর আমলে দেশের অর্থমন্ত্রী শচীন্দ্র চৌধুরী ছিলেন এই চৌধুরী বংশেরই সন্তান। এই বাড়ির দুর্গাপূজার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে পুজোর উপাচার করেন পুরুষেরা। এই বাড়ির এক বংশধর সুশান্ত চৌধুরী জানান, তাঁদের পূর্বপুরুষ জগৎ নারায়ণ চৌধুরী বর্ধমান রাজার দেওয়ান ছিলেন। বর্ধমান মহারাজার এই বাকসা গ্রামে শতাধিক বিঘা জমি জগৎ- নারায়ণকে উপহার দেন। জগৎ নারায়ণ ঠিক করেন তিনি সেখানে দুর্গাপূজা করবেন। কিন্তু কীভাবে মায়ের মূর্তি হবে সেই ধারণা নিতেই তিনি কাশী রওনা হন। কিন্তু কাশী পৌঁছনোর আগেই তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে বক্সা ফিরে এসে মায়ের পুজো চালু করেন। যেহেতু তাঁরা রাধা গোবিন্দের ভক্ত তাই চালচিত্রের উপর জয়া বিজয়া নয়, স্থান দেওয়া হয় রাধাগোবিন্দকে। আসলে এই পুজো ছিল শাক্ত ও বৈষ্ণব মতের মেলবন্ধন।
কর্তাবাড়ি…
এই বাড়ির পুজো ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে। কর্তাবাড়ি, পুরাতনবাড়ি ও জলাবাড়িকে ৩ বোন বলা হয়। তাই বিসর্জনের সময় বড় বোন পুরাতনবাড়ির ঠাকুর আগে বিসর্জন হয়, তারপর মেজো বোন কর্তাবাড়ির ঠাকুর এবং সবশেষে ছোট বোন জলাবাড়ির ঠাকুরকে বিসর্জন দেওয়া হয়।
গাঙ্গুলিবাড়ি….
আনুমানিক ৩০০বছরের প্রাচীন এই বাড়ির দুর্গাপুজো। অতীতে এই বাড়িতে বলিদান হয়েও পরে কোনো এক অলৌকিক কারণে সেই বলিপ্রথা বন্ধ হয়ে যায়। কিশোরীমোহন গাঙ্গুলি যিনি প্রথম ইংরেজীতে রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন এটি তাঁর পৈতৃক বাড়ি।
মা বদ্যিমাতা মন্দির…
জনাই ও বাকসা অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন ও জাগ্রত মন্দির এই মা বদ্যিমাতার মন্দির। অতীতে বদ্যি সম্প্রদায়ের নাম অনুসারে এই মায়ের নাম বদ্যিমাতা। এলাকার লোকেদের মতে মায়ের কাছে গিয়ে মাকে মন ভরে ডাকলে মা তাঁর ভক্তের মনের ইচ্ছে পূরণ করেন। প্রতিবছর চৈত্র মাসের প্রথম রবিবার এখানে বিরাট পুজোর আয়োজন হয়।
বাকসার দ্বাদশ শিব মন্দির ….
জনাই এর আরও একটি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান হলো বাকসার দ্বাদশ শিব মন্দির, জনাই এর মিত্র বাড়ির বংশধর শ্রী ভবানীচরণ মিত্র ১৭৮০ সালে এই দ্বাদশ শিবমন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। তিনিও ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন দেওয়ান। ঠিক দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের আদলে, তিনিই তৈরি করিয়েছিলেন এই একই সারিতে সম- উচ্চতার ১২টি শিবমন্দির। এই আটচালা বিশিষ্ট মন্দিরের ঠিক শেষ প্রান্তে রয়েছে একটি শ্মশান, আর এই শ্মশানেই রয়েছে একটি শ্মশানে কালীমন্দির, যা ওই সময়ে শুধু মিত্রবাড়ির জন্যই ব্যবহার হতো, এখন অবশ্য গ্রামবাসীরা সবাই এই শ্মশান ব্যাবহার করে থাকে।
জনাই এসেছি আর মনোহরা আস্বাদন করবোনা তা তো হয়না। মনোহরা অর্থাৎ মন হরণকারী এই মিষ্টান্নের ইতিহাস প্রায় দুই শতাধিক বছরের। মনোহরার উপকরণ বলতে ছানা, ক্ষীর, পেস্তা, এলাচ ও চিনি। ব্রিটিশ আমলে জনৈক ব্রিটিশ ময়রাদের হুকুম করেন যে, এমন এক মিষ্টি তৈরি করতে হবে, যা পাঁচ দিন রেখে দেওয়া যাবে, এমতাবস্থায় ভীম চন্দ্র নাগের বংশের এক জনৈক ব্যক্তি বুদ্ধি খাটিয়ে মূল মিষ্টির ওপর চিনির আস্তরণ তৈরি করেন, যা মনোহরা নামে পরিচিত। যাইহোক জানাই, গরলগাছা ও বাকসার বনেদিবাড়ির দুর্গাপুজো দেখে, মন হরণকারী মিষ্টি মনোহরা নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম। বাড়ির এত কাছে এমন ইতিহাসকে সাক্ষী নিয়ে বেঁচে আছে একটা গোটা জনপদ, আটপৌরে বাঙালিয়ানাকে ধরে রেখেছে বুকের ভেতরে, তা এখানে না এলে জানতেই পারতাম না।
কীভাবে যাবেন…
যাঁরা ট্রেনে আসবেন তাঁরা ট্রেনে জনাই স্টেশনে নামুন। হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনে জনাই রোড একটি বিখ্যাত রেলস্টেশন। রেলপথে হাওড়া থেকে দূরত্ব ২০ কিমি। সেখান থেকে অটো বা টোটো করে, সরাসরি পৌঁছাতে পারেন জনাই রাজবাড়ি বা কালিবাবুর বাড়িতে বা জনাই বাকসা শিবমন্দিরে। আবার ডানকুনি স্টেশন থেকেও টোটো করে চলে আসা যায় গরলগাছার বাবুদের বাড়ির পুজো দেখতে।
আর যাঁরা নিজস্ব গাড়ি বা বাইকে আসবেন আপনারা গুগল ম্যাপ অন করে পৌঁছাতে পারেন এখানে।