• facebook
  • twitter
Sunday, 6 October, 2024

অমৃত গুহার সন্ধানে

বালতালের দিকে এগোতেই দেখি মেলার পরিবেশ। প্রচুর দোকানপাট শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস‌নয়, ড্রাই ফ্রুট, পোশাক-আশাক, মনিহারী সবরকম। পহল গামের বেসক্যাম্প এত জমজমাট নয়। আমার মনে হচ্ছিল এখানে আজকে থেকে গিয়ে এই মেলাটা দেখে গেলে ভালো হতো।

এবার ফেরার পালা, বলা ভালো নামার পালা। গুহা মন্দির থেকে আবার ধীর পায়ে সোপান শ্রেণী বেয়ে নামতে থাকলাম। নামার পথ কিছুটা ভিন্ন। তবে কিছুটা এসে একই সিঁড়ির দুটি ভাগে নামার ও ওঠার ব্যবস্থা। ফলে সুচারু ভাবে গুহা মন্দিরে প্রবেশ ও বাহির হওয়া যায়। নামার সময় আবার কবুতর দ্বয়ের দর্শন পেলাম। আর একটু নীচে জুতোর ক্লকরুম থেকে জুতো নিয়ে পায়ে বাঁধলাম। বৃষ্টির মধ্য দিয়ে হাটতে হবে বলে ‘ওয়াটার প্রুফ’ জুতা কিনেছিলাম। কিন্তু পরীক্ষিত হলোনা জুতোটা।

গুহার সোপান শ্রেণী ছেড়ে নদীর ধারের বাঁধানো পথে যখন এলাম, তখন দেখি প্রচুর লোক আমরাবতীতে স্নান করছেন। যাওয়ার সময় এত লোক ছিলনা। আবার সতর্কবাণী আছে স্নান করা নিষেধ।

বাঁধানো পথের ধারে পরপর কয়েকটি ভাণ্ডারা আছে। প্রাতরাশের ক্ষুধা মেটালাম। যেখানে ব্রীজ পেরিয়ে ছিলাম সেখানে প্রচুর ঘোরার সমাহার। বোঝা গেল পঞ্চতরণীর সমস্ত যাত্রীরা ঢুকে পড়েছেন। এরপর বালতালের যাত্রীদের ঢোকার পালা।
আমরা সাড়ে নটা নাগাদ বালতাল-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। পিঠের বোঝা গুলো আবার ঘোড়ার পিঠে তুলে দেয়া হল। আমরা ধীর গতিতে এগোতে শুরু করলাম।

বালতালে যাওয়ার জন্য যে পথটা অমরাবতী নদীর ডানতীর দিয়ে, সে পথে তখনও পথে তীর্থযাত্রীরা আসেননি। ঘোড়ায় করে নদীর ওপার দিয়ে বালতালের তীর্থযাত্রীদের আসতে দেখলাম। ঘোড়া ও পায়ে চলা পথ আলাদা হলেই ভালো। নিরাপদে হাঁটা যায়। ঘোড়াও আপন গতিতে এগিয়ে যেতে পারে।

একটু এগোতেই দেখি, লোকজন থমকে কী যেন দেখছে পাহাড়ে গায়ে। এখানে একটু সবুজ ঘাস হয়েছে সেখানে একটা বড় ধেড়ে ইঁদুরের মত প্রাণী ঘাস খাচ্ছে। বাদামী রংয়ের ওপর কালো ছোপ আছে। রাজীব বলল, “মার্মাসেট!”

কিন্তু মার্মাসেট তো দক্ষিণ আমেরিকার জীব এখানে আসবে কীকরে! ছবি দিয়ে গুগল সার্চ করে রাজীব দেখল, ‘হিমালয়ান মার্মট’, কাঠবিড়ালি শ্রেণীর প্রাণী। উচ্চ হিমালয়ের বিভিন্ন জায়গায় যেমন লাদাখ, সিকিম, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ডে এদের দেখা যায়। যাক তীর্থ করতে এসে একটা হিমালয়ের বন্যপ্রাণী দেখা হয়ে গেল।

আরেকটু এগোতেই একটা বেশ উঁচু গ্লেসিয়াল, সাদা ধবধবে। জনসাধারণ এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি, সেলফি, সবই তুলছে। গ্লেসিয়াল পাহাড়ের সাদা দেওয়ালে অনেকে নাম খোদাই করছে। আমার মনে পড়ে গেল মান্নাদের গানের কথা। মন বলে উঠলো ”যদি বরফে লেখ নাম, এ নাম গলে যাবে”

অবশ্য এখন বরফ তথা গ্লেসিয়াল গলবে অক্টোবর পর্যন্ত। যতটুকু গলার গলল, আবার এর ওপর নতুন বরফ পড়তে শুরু করবে। নদীর অপর পারের গ্লেসিয়ালগুলোও খুব সুন্দর লাগছে।

নামার আগে একটু উঠতে হচ্ছে দেখছি! আসলে সঙ্গম টপ এবং অমরনাথ গুহার মাঝের জায়গাটা বেশ নিচু। তাই সঙ্গম টপে উঠতে একটু চড়াই ভাঙতে হচ্ছে। চড়াই শুরু হওয়া মাত্রই পথের ধারে রেলিং শুরু হয়ে গেছে। অবশেষে সঙ্গম টপে কাছে পৌঁছালাম। সঙ্গম টপের আগে থেকে বালতালের পায়ে হাঁটা যাত্রীদের দেখা পেতে শুরু করলাম।

সঙ্গম টপের কাছাকাছি এসে ওপর থেকে নিচের ঘোড়ায় সওয়ার যাত্রীদের দেখে মনে হচ্ছে চম্বলের উপত্যকা দিয়ে চলেছে ডাকাত দল। সঙ্গমের তাঁবুগুলোকে লিলিপুট নগরী মনে হচ্ছে। একটা সময় পর ঘোড়ায় চড়া পথ ও পায়ে হাঁটা পথ এক হয়ে যাবে, তখন থেকে শুরু হবে ধুলিময় পথ।

সঙ্গম টপের ওপর থেকে অপর পায়ের Y জংশনটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। Y-জংশনের আগে ‘Z’ আকৃতির সর্পিল পথটি সুন্দর বোঝা যাচ্ছে। আগেই বলেছি এই পথটি বালতাল থেকে আগত ঘোড় সওয়ারদের জন্য। সঙ্গমে অপর দিকের পাহাড় থেকে একটি নদী বা ঝরনা এসে মিশেছে। শীর্ণ ধারা জল-ধারাটিও মাঝে মাঝে জমে হিমবাহ হয়ে গেছে। একই ফ্রেমে হিমবাহ নদী, সঙ্গমস্থল, সঙ্গমের অস্থায়ী শিবির (সম্ভবত নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য) ‘Z’ আকৃতির সর্পিল পথ, Y-জংশনের সুউচ্চ সবুজ বাদামি পাহাড়, দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে দেখতে হল।

সঙ্গম টপে এসে এবার ডানদিকে ঘুরতে হবে। পিছন ফিরে একবার তাকালাম গুহা মন্দিরের দিকে। একটা সাইনবোর্ডে লেখা আছে, “Fast View of The Holy Cave”.

আমিও পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করলাম। গুহায় প্রবেশের সিঁড়ির ছাউনি দেখে বোঝা যাচ্ছে ওই স্থানে গুহার অবস্থান। এরপর ডান দিকে ঘুরে গেলে আর অমৃত গুহার দর্শন আর পাব না। জানিনা আর কোনও দিন আসা হবে কিনা? মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। গত পাঁচ দিন ধরে এই গুহাদর্শনের জন্য উতলা হয়ে ছুটে চলেছি; আজ সব শেষ!

সঙ্গম বাঁকের পর কিছু দোকানপাট দেখলাম। সেখানে পুজো দেওয়ার জন্য শুকনো ফলের প্যাকেট ছাড়া নানা মেমেন্টো, মনিহারি দ্রব্য, অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রে যেমনটা থাকে। এই তীর্থযাত্রায় এরকম দোকান এই প্রথম চোখে পড়ল। পহলগামের বেস ক্যাম্পে অনেক দোকান ছিল। কিন্তু এ ধরনের দোকান চোখে পড়েনি।

এখানেও পাহাড় গুলো বাদামি। মাঝে মাঝে ঘাসের প্রলেপ আছে বলে সবুজও লাগছে। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা ‘মাইল সাইনেজ’ দেখলাম, বারারি মার্গ দেড় কিলোমিটার। রায়াল পাথরী সাড়ে চার কিলোমিটার। দোমেল ৭ কিমি। দোমেল পর্যন্ত পাহাড়ি পথ। তারপর সমতলে তিন কিলোমিটার দূরে বালতাল। এছাড়া গোটা রাস্তার আর কোনও স্থান নির্ণায়ক ‘সাইনেজ’ দেখলাম না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘সাবধান, ধ্বস প্রবণ এলাকা’ ‘থামুন, দেখুন, চলুন’ ইত্যাদি ধরনের সাইনেজ। সত্যি কিছু জায়গায় মধ্যে দিয়ে এলাম; পাহাড় দেখলেই বোঝা যাচ্ছে ধ্বসপ্রবণ। পাহাড়গুলোকে কেমন ভঙ্গুর মনে হচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে শিলচূর্ণ এমন ভাবে লেগে আছে, মনে হচ্ছে এখনি গড়িয়ে পড়বে, এই ভঙ্গুর পাহাড়ের জন্য রাস্তার ধুলোর পরিমাণও বেশি।

রাস্তায় এত ধুলো বলার মতো নয়। মাথায় টুপি পরে, নাক মুখ মাস্কে ঢেকে চললাম। ব্যাগে, জামাকাপড়ে, টুপিতে ধুলোর পুরু আস্তরণ পড়ে গেল। মনে হল, এই পথ ধরে অমরনাথ যাত্রা প্ল্যান করা মোটেই সুখকর নয়। অথচ অপর্ণা বলেছিল, ওর নাকি বালতাল দিয়ে অমরনাথ গুহার ওঠা পথটা ভালো লেগেছিল। হয়তো সেটা প্রথম দিন ছিল বলে রাস্তাঘাট মানুষের ও ঘোড়ার খুরের চাপে ভেঙ্গে ধুলিময় হয়নি। আমি শুধু ভাবছিলাম যদি এর মধ্যে বৃষ্টি হয়, তাহলে কাদাময় হয়ে এই পথের দশা কি হবে? ধুলোর জন্য ক্ষণিক দাঁড়িয়ে চারপাশের সৌন্দর্যও উপভোগ করা যাচ্ছে না। আর একটা জিনিস এই পথে ভাণ্ডারাও দেখা পাচ্ছিনা। এই যাত্রাপথে মাত্র দুটো জায়গায় ভাণ্ডারা পেলাম।

বাদামি পাহাড় যেখানে ভেঙ্গে ধ্বস নেমেছে বা ভেঙ্গে পথ করা হয়েছে সেখানে পাহাড় ধুলিময় ধূসর। মাঝে এক জায়গায় ওপর থেকে নিচের দীর্ঘ পাকদণ্ডী দেখতে পেলাম। ঘোড়া বেয়ে লোকজন উঠছে, ডাণ্ডিতে উঠছে, পাশে গ্লেসিয়াল, সবমিলিয়ে খুব সুন্দর চিত্র।

ক্রমশ আমরা নেমেই চলেছি। কিছুক্ষণ বাদে বাদামি-ধূসর পাহাড় সবুজ হতে শুরু করল তৃণভূমির জন্য। তারপর দেখতে পেলাম পাইন গাছের সারি। বুঝতে পারলাম আমরা ক্রমশ সমতলের দিকে চলে এসেছি।

পাহাড় সজীব হয়ে উঠলেও পথের ধুলো কমছে না। চারপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আসতে ভালোই লাগছিল। সবুজ পাহাড়ের মধ্যেও হিমবাহের দেখা পাচ্ছি। এক জায়গায় তো খুব বড় হিমবাহ দেখলাম এক জায়গায় একটা ঝর্ণা পেরোলাম। সেখানে দেখলাম ঘোড়াদের জল খাওয়ানো হচ্ছে।

আরও কিছুক্ষণ বাদে গাছে ফাকে তাঁবু নগরী দেখতে পেলাম তাহলে কি বালতাল চলে এলাম। আরও নামতে বুঝতে পারলাম জায়গাটার নাম ডোমেল। এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বালতাল বেস ক্যাম্প। ডোমেলের গেটে পৌঁছানো মাত্র RFID কার্ডটা কেড়ে নিল প্রায়।

কেমন যেন হতাশ লাগল। যাহ্ সব সম্পর্ক শেষ। আর তাহলে তো ভাণ্ডারায় খাবার মিলবে না। দেখি ঘড়িতে প্রায় আড়াইটে বাজে। সামনের একটি কল থেকে হাত মুখ ধুয়ে একটু ধুলো মুক্ত হলাম। আরেক একটু এগিয়ে দেখি সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের দলে ‘আই অ্যাম দ্য লাস্ট ম্যান’।

ডোমেল থেকে বালতাল হেঁটে আসতে হল না। দেখি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই তিন কিলোমিটার পথ ছোটো ছোটো বাসে করে বিনা পয়সায় পৌঁছে দিচ্ছেন। লাইন দিয়ে একটা বাস ছেড়ে পরের বাস ধরলাম। বালতালের দিকে এগোতেই দেখি মেলার পরিবেশ। প্রচুর দোকানপাট শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস‌নয়, ড্রাই ফ্রুট, পোশাক-আশাক, মনিহারী সবরকম। পহল গামের বেসক্যাম্প এত জমজমাট নয়। আমার মনে হচ্ছিল এখানে আজকে থেকে গিয়ে এই মেলাটা দেখে গেলে ভালো হতো।
কিন্তু সবাই দুই রাত টেন্টে থেকে তাঁবুতে থাকবার শখ মিটে গেছে। তার ওপর প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তার ধুলো ঝেড়ে সবাই হোটেলে গিয়ে স্নান করে স্বস্তি পেতে চাইছিল।
[ক্রমশ]