• facebook
  • twitter
Friday, 4 October, 2024

উৎসব মানে কি শুধুই বীভৎস মজা?

১২ সেপ্টেম্বর নবান্নে প্রশাসনিক পর্যালোচনা বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচারে মমতা বলেন, ‘‘এক মাস তো হয়ে গেল। আমি অনুরোধ করব, পুজোয় ফিরে আসুন, উৎসবে ফিরে আসুন।’’

আমরা এখন অনেকেই উৎসবের আবহে আমোদিত। সন্দেহ নেই উৎসব জীবনের অঙ্গ। সবার রঙে রঙ মিললে সার্থক হয় উৎসব। অন্যথায় তা ‘শুধু মিছে কথা ছলনা। প্রকৃতির রূপ রস আর গন্ধ মিলে তৈরী হয় উৎসবের আবহ। যেমন শরতের নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘ, মাঠে সাদা কাশ ফুলের মেলা, শিউলি ঝরা সকাল এসব মিলেমিশেই তৈরী হয় ‘মা আসছেন’। কিন্ত এসব আজ কী কেবল অতীত-কথা! ‘এসেছে শরত হিমের পরশ’ কই?

গরমে হাঁসফাঁস দৈনন্দিন সময় কি বিশ্ব উষ্ণায়ণের পতাকা টাঙাচ্ছে দিকে দিকে, পাল্টে যাচ্ছে জলবায়ু? অসময়ের মেঘভাঙ্গা প্রবল বৃষ্টি-বাঁধ বিপর্যয়-প্রচন্ড জলস্রোত-ধ্বংস-মৃত‍্যু সিকিমের মানুষকে আতংকিত করেছে।আমাদের রাজ্যে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অনেকেই। আরও অনেক অজানা বিপদের আশঙ্কা করছেন তাঁরা। উৎসব তাঁদের জড়িয়ে নিতে পারেনি। আমরা যখন আলোর বন‍্যায় ভাসব সদর-মফস্বলে, সিকিমের মানুষ,বাংলার একটা বড় অংশের মানুষ ভাসবেন খরস্রোতা তিস্তার জলে। সিকিমে প্রাকৃতিক জলাধার ভেঙ্গে নেমে আসা জলের তোড়ে ভেঙ্গেছে তিস্তার বাঁধ। বিদ‍্যুৎ তৈরীর জন‍্য দেওয়া বড়ো বাঁধ যে বিপজ্জনক তা এখন স্পষ্ট। হিমালয়কে বাঁধের শৃঙ্খলে বাঁধতে চাওয়াটা আত্মহত‍্যার সামিল। তাই ঘটেছে।

একশ্রেণির মানুষের মুনাফা সন্ধানের পরিনতিতে পরিবেশের রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। পন্যসর্বস্ব ভোগবাদী ব্যবস্থায় বাজার সচল রাখতে অপ্রয়োজনীয় অতি উৎপাদন ও ব্যবহার মানেই শেষ বিচারে তা পরিবেশের বিনষ্টি ডেকে আনে। উৎসবে আলোর রোশনাই, শব্দের দৌরাত্ম, পেট্রল-ধোঁয়া বমন, খাদ‍্যের অপচয় আর সুরাসাগর ভ্রমণ ইত‍্যাদি তবু বেড়েই চলেছে। এই আতিশয‍্য আর অপচয়ের নীচে আমরা কি চাপা দিতে চাইছি মানুষের মৃত‍্যসহ পরিবেশের বিভিন্ন বিপর্যয়কে? উত্তরাখন্ডের যোশীমঠ ও অন‍্যান‍্য বিপর্যয় এত তাড়াতাড়ি বিস্ম‍ৃতির অতলে? চারধামের শিল্পসমন্বিত প‍্যান্ডেল শোভা যে চোখ ধাঁধাঁয় তা বেশ টের পাওয়া যায়। ট‍্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থে চারধাম যাত্রার মসৃন ব‍্যবস্থা করতে হিমালয় জুড়ে চলা ধ্বংসযজ্ঞ, কুলু মানালি শিমলা সহ হিমাচল প্রদেশ আজ বিপর্যয়ের অতল গহ্বরে।

তবুও মগজের তালা খোলে না কিছুতেই! একবারও কি মনে হয় না যে, শারদ উৎসবের দিনগুলো বিজ্ঞাপনের খাঁচা বন্দী হয়ে কেমন ছটফটাচ্ছে? ঠান্ডা পাণীয়ের বিজ্ঞাপণ ও লাগামছাড়া ব্যবহার কর্পোরেটের লালসার কাছে বলি দিচ্ছে প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার হিসাবে পাওয়া মাটির নীচের অমূল‍্য জলস্তরকে। ব্রান্ডেড জামা-কাপড়ের দুটো কিনলে একটা ফ্রি-র প্রলোভন যে শুধু বড়ো-বড়ো দেশী-বিদেশী কোম্পানির মুনাফা বাড়াচ্ছে তাই নয়। বরং এসবের প্রয়োজনীয় রসদ জোগান দিতে রিক্ত ও দূষিত হচ্ছে জল, নি:স্ব হচ্ছে মাটির ঊর্বরাশক্তি ও মাটির নীচ থেকে নির্দ্বিধায় তুলে আনা লক্ষাধিক বছরের প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার পেট্রোলিয়াম ইত‍্যাদি। প্রসাধনীর অলঙ্ঘণীয় বহুজাতিক প্রলোভনে দেশের মানুষের ও প্রকৃতির স্বাস্থ‍্যহানি ঘটছে দ্রুত, বৈদ‍্যুতিক শক্তির বিপুল অপচয় হচ্ছে আর পৃথিবী উষ্ণতর থেকে উষ্ণতম হচ্ছে, সেই সীমাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

অন‍্য একটা দিকও উল্লেখের দাবী রাখে। শিল্প-সুষমায় ঐতিহ‍্যমন্ডিত যে উত্তরাধিকার (তা সে টেরাকোটা থেকে টপ্পা, মহাভারত থেকে মধুবনী যাই হোক না কেন) আমাদের সাহিত‍্যে, শিল্পে, লোকায়ত সমাজজীবনে রয়েছে সেইসব সম্পদ আড়কাটির হাত হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বহুজাতিক সংস্থার হাতে। মূল‍্য যুক্ত হয়ে তথ‍্য-প্রযুক্তির সহায়তায় তা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ‍্যরূপ নিচ্ছে কর্পোরেট মালিকানায়। প্রকৃত শিল্পীরা প্রতারিত হচ্ছেন, লুঠ হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের মতো সামাজিক জ্ঞানও। আজকের উৎসবে কর্পোরেট বদান‍্যতার এসব কয়েকটি নমুনা মাত্র ।

একদিন জমিদার পরিবারের সার্বভৌমত্বের আগল ভেঙ্গে বারো-ইয়ারির পুজো যে সামাজিক উৎসাহ এনেছিলো, আজ তার পরিনতি কর্পোরেটের দাসত্বে। বড়ো মাছের ছোট মাছ গিলে খাবার আয়োজনের জন‍্যই গাছ কেটে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং আলোকিত করা, প্রলম্বিত ‘দেবী-পক্ষ’, মাসাধিক কালব‍্যাপী মস্তির আয়োজন, প্রতিমা ভাসানের নতুন নাম কার্নিভাল। এবারে এই কার্নিভাল উৎসব কলকাতা ছাড়িয়ে অন্য কয়েকটি নগরেও বিজ্ঞাপিত। সঙ্গে রয়েছে নানা দলের নেতা মন্ত্রী সান্ত্রীদের উৎসব উদ্বোধনের উদ‍্যোম ও বিমান ভ্রমণ। সঙ্গে ধর্মের জিগির। জমে গেল বাণিজ‍্য মেলা। বাণিজ‍্য হ’লো, বহুজনকে সব ভুলে মাতিয়ে রাখা গেল এবং যাবেও বেশ কয়েকটা দিন থেকে কয়েকটা মাস । সাপ মরলো, লাঠিও ভাঙ্গলো না।

বাজারের মায়াবী মোহে নিজেদের মনন ও মগজকে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে বন্ধক রাখা কোন আধুনিকতা বা প্রগতি নয়। পাহাড়প্রমাণ মুনাফার লক্ষ‍্যে নিপুণ কৌশলে বোনা বাজারের যে মায়াজাল আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, আসুন তা ছিন্ন করে অপরের কথা, সমাজের কথা ভাবি। পরবর্তী প্রজন্মকে এক নির্মল আকাশ, বুকভরা শুদ্ধ বাতাস, বিশুদ্ধ জল, বিষহীন খাবার, রোগহীন সুস্থ জীবন উপহার দেওয়াটাই হোক উৎসবের অন্যতম অঙ্গীকার।

আরজি কর-কাণ্ডের জেরে রাজ্য জুড়ে যে আন্দোলনের পরিবেশ তাতে এ বারের দুর্গাপুজো উৎসবের চেহারা নেবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ৯ অগস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নির্যাতিতার ধর্ষণ ও মৃত্যু হয়। এর পর থেকে গোটা রাজ্যে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর এক মাস পূর্ণ হওয়ার রাতেও কলকাতা-সহ জেলায় জেলায় পথে নামেন মানুষ। দু’মাস পূর্ণ হওয়ার দিনে ৯ অক্টোবরেই পঞ্জিকা অনুসারে দেবী দুর্গার বোধন। কিন্তু সে ভাবে উৎসবের আবহ তৈরি হবে কি না তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে। আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে যে আন্দোলন তাতে বড় ভূমিকা নিয়েছে সমাজমাধ্যম।

আর সেই সমাজমাধ্যমেই এমন প্রশ্ন উঠছে যে, এ বারের পুজোর রীতি মানা হলেও উৎসবের চেহারা দেওয়া কি ঠিক হবে? তা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও সম্প্রতি এই বিতর্ক উস্কে দিয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি আহ্বান। গত ১২ সেপ্টেম্বর নবান্নে প্রশাসনিক পর্যালোচনা বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচারে মমতা বলেন, ‘‘এক মাস তো হয়ে গেল। আমি অনুরোধ করব, পুজোয় ফিরে আসুন, উৎসবে ফিরে আসুন।’’

মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ‘আহ্বানের সুর’ থাকলেও অনেকেই এর মধ্যে আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেওয়ার রাজনীতি দেখেছেন। তাঁদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন রাজ্যের মানুষ উৎসবে মেতে উঠলে টানা চলতে থাকা জনগণের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। অন্য একটি অংশ অবশ্য মনে করছেন, পুজো মানেই বিরাট অর্থনীতি। বিভিন্ন আর্থিক অবস্থার বহু মানুষ এই সময় বাড়তি রোজগারের সুযোগ পান। উৎসব মার খেলে সার্বিক ভাবে ক্ষতি হবে অর্থনীতির।